“সংস্কারের ভাইরাস ও নারীবাদের ভ্যাকসিন”

সুমিত রায়:

মেয়েদের ‘সংস্কার’ শেখানোর কথা শুনলেই আমার সেই ছোটবেলার ছড়াটি মনে পড়ে:

বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস্‌ বাপুরে?
আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা—
যে সাপের চোখ্‌ নেই, শিং নেই নোখ্‌ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস্‌ফাঁস্‌, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ,
নেই কোন উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত—
সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আনত?
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা ক’রে দেই ঠাণ্ডা।

মেয়েদের ‘সংস্কার’ শেখানো মানে তাদের বিষ দাঁত তুলে নাও। এমন সংস্কার শেখাও যাতে তারা জড় পদার্থে পরিণত হয়, যাতে সারাজীবন তাদের কাজের মাসি, নয়তো যৌনদাসী করে রাখা যায়।

আমরা মেয়েদের শিক্ষা চাইনা, কিন্তু মেয়েদের ‘সংস্কার’ শেখাতে আমরা সর্বদাই অতি উৎসাহী। কত ‘মহাপুরুষ’ যে নারীর ব্রতকথা লিখে গেলেন। কেউ সরাসরি লিখেছেন শাস্রের আকারে, আর শিল্পী-সাহিত্যিকগণ ঘুরিয়ে, আকারে, ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। মেয়েরা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়বে, পূজার্চনায় যুক্ত থাকবে, সেবাদাসী হবে, পুরুষের জৈবিক আর যৌন খিদে মেটাবে–এটাই আমাদের ‘সংস্কার’।

এই ‘সংস্কার’ আবার চিরকাল একরকম থাকে না। যুগে যুগে এর রূপ পাল্টায়। এখন যেমন আমরা মনে করি মেয়েরা পড়াশুনা করবে, চাকরি করবে। এই ধারণাগুলি শুরুতে যদিও প্রগতিশীল ছিল, কিন্তু এখন সেটা পুনরায় সেই ‘সংস্কার’এরই অংশ হয়ে গিয়েছে। কারণ আমরা আসলে মেয়েদের পড়াশুনা আর ছেলেদের পড়াশুনা দুটোকে আলাদাভাবে দেখি।

মেয়েদের পড়াশুনা করতে স্কুল-কলেজ পাঠাই ঠিকই, কিন্তু আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে যাতে সে বিয়ের বাজারে একজন যোগ্য পাত্রী হয়ে উঠতে পারে। মেয়ে একজন শিক্ষিত স্ত্রী হবে, মা হবে। ফলে স্বামীর কোন জামা কোন ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুতে হবে, বাথরুমের টাইলস কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে সেটা ম্যাগাজিন পড়ে শিখে নেবে, ইউটিউব দেখে সুইট-কর্ন-সুপ বানাবে, বাচ্চার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পেরেন্টস মিটিং অ্যাটেন্ড করবে, বাচ্চাকে হোমওয়ার্ক করাবে, ভ্যাকসিন ঠিকঠাক দেবে, ভুল ওষুধ খাওয়াবে না। অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই পিতৃতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্যেই মেয়েদের নতুন করে খাপ খাইয়ে নেওয়া হলো। মেয়েরাও খুশি থাকলো–আমি শিক্ষিত হয়েছি, আধুনিক হয়েছি। আবার পুরুষের নিয়ন্ত্রণও একইভাবে বজায় থাকলো। অর্থাৎ নারী সেই পিতৃতন্ত্রের সেবক হয়েই থাকলো। মূল জায়গাটি কিন্তু পাল্টালো না।

আবার বাজার চলতি নারীবাদের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে আবার বলে থাকেন মেয়েরা ক্যারাটে শিখবে, ধর্ষকদের ধরে পিটিয়ে দেবে, অত্যাচারী পুরুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, মলেস্টারের চোখে শুকনো লঙ্কা, নয়তো পেটে সেফটিপিন ফুটিয়ে দেবে। এইসকল আপাত নারীবাদী মহিলারাও কিন্তু মনে মনে একজন ‘আদর্শ’ পুরুষকে কামনা করেন এবং সেরকম কাউকে পেলে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করেন। এমন আদর্শ পুরুষ যে শিক্ষায় তার থেকে এগিয়ে, তার তুলনায় উচ্চ পদে চাকরি করবে, হাইট-এ একটু হলেও তার থেকে লম্বা হবে, বেশ সুপুরুষ চেহেরা হবে যাতে লম্পট ছেলেদের শায়েস্তা করতে আর শুকনো লঙ্কা সঙ্গে রাখতে না হয়। অর্থাৎ, নারীবাদ-কুমফু-ক্যারাটের পর সেই পুরুষই অবলম্বন। আর এতে কোনো দ্বিধা নেই। কারণ সে তো ‘আদর্শ’ পুরুষ। তাই যেহেতু মনের পুরুষ এসে গেছে, তাই নারীবাদ নিপাত যাক। অর্থাৎ, আমার নারীবাদ ততক্ষণই প্রয়োজন যতক্ষণ না একজন ‘মনের’ মানুষ পাওয়া যাচ্ছে। এইভাবে আপাত নারীবাদও পুরুষতন্ত্রেরই সহায়ক হয়ে কাজ করে।

আসলে আমরা সবাই পিতৃতন্ত্রকে বড্ড ভালবাসি। তাই পিতৃতন্ত্র থাকবে না এটা আমরা ভাবতেই পারিনা। খাবারে যেমন নুন না হলে চলে না, তেমনি পিতৃতন্ত্র ছাড়া জীবনের স্বাদ মেটে না। ঘরে-ঘরে নারীপুরুষ বিভাজন, সমাজের স্তরে-স্তরে লিঙ্গ-বৈষম্য, তেল-সাবান-ক্রিম-বাচ্চার খেলনা সবকিছুতেই ছেলে-মেয়ে বিভাজন। আর বিভাজনের অদৃশ্য পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আমরা মহানন্দে সেলিব্রেট করে চলেছি। কখনও এসব আমাদের কাছে আপত্তিকর মনে হয় না, আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে না, ক্ষোভ তৈরি করে না। বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিবাদে আমরা এই বিভাজনের রাজনীতিকে মহান ঐতিহ্য, মহত্তম সংস্কার রূপে পালন করে আসি।

তবে ধর্ষণটা একটু বাড়াবাড়ি। সেটা না হলেই ভালো। তাই শুধুমাত্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই আমরা সবাই সরব হয়ে উঠি। কেউ মোমবাতি মিছিল করে, কেউ ছড়া কাটে, কেউ সুর করে কাব্য বলতে থাকে, কেউ সেফটিপিন, শুকনো লঙ্কা, কুংফুর থিওরি আওড়ায়, কেউ পাবলিক লিনচিং-এর কথা বলে। দুদিন পর সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তারপর আমরা সবাই আবার পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির, লিঙ্গ বৈষম্যের রাজনীতির একেকজন সক্রিয় অংশীদার হয়ে যাই।

আমাদের ঘরে ঘরে পিতৃতন্ত্রের বিগ্রহ। নিয়ম করে প্রত্যহ তাতে আমরা ফুল-জল দিই। ভগবানের মতোই সে অদৃশ্য, আবার সর্বত্র বিদ্যমান। তাই, তাকে ধরা খুব কঠিন। স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী সে প্রতি মুহূর্তে নিজের চেহারা পাল্টাচ্ছে। পিতৃতন্ত্র হলো সর্বগ্রাসী। আমরা যতই নারীবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য, সমকামিতার নতুন-নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসি না কেন, পিতৃতন্ত্র সবকিছুকেই গ্রাস করে নেয়। সবকিছুই পরিশেষে সেই পুরোনো সংস্কারের পাঁকে বাঁধা পড়ে যায়; এক নতুন মোড়কে পিতৃতন্ত্র আরও শক্তিশালী রূপে আবির্ভুত হয়। আর আমরা তার পূজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

তাই, কুংফু আর শুকনো লঙ্কার নারীবাদ দিয়ে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বেশি দূর লড়া যাবে না। নারীবাদী হওয়া আর ক্ষমতাশালী হওয়া দুটো কখনোই এক জিনিস নয়। বরং একটি আরেকটির পরিপন্থী। কারণ নারীবাদ ক্ষমতাতন্ত্রের বিরোধী। কিন্তু পিতৃতন্ত্র বারবার এই দুটি ধারণাকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর আমরা সহজেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে দিই।

কোনো নারী ক্ষমতাশালী হলো, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভাবশালী হলো, কোন উচ্চ পদে চাকরি পেলো, খেলার জগতে বিরাট নাম করলো, সেলিব্রেটি হয়ে গেল, কিংবা খুব প্রতিবাদী হলো, রাস্তায় চারটে ছেলেকে ধরে পিটিয়ে দিল, কী বিরাট সাহসিকতাপূর্ণ কোন কাজ করে দেখালো–এই ধরনের কিছু হলেই সেই নারীকে নারীবাদী ভেবে নিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা ভুলে যাই যে এই সবকটিই আসলে পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতা। অর্থাৎ যেগুলিকে আমরা নারীবাদের সুফল ভাবছি সেগুলি আসলে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকেই প্রতিফলিত করছে নতুন রূপে।

পিতৃতন্ত্র একটি হাইলি মিউটেবল ভাইরাস। প্রতিমুহূর্তে সে নিজের ভোল পাল্টাচ্ছে। নারীবাদ যখনই একটি নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করছে, সেই মুহূর্তেই পিতৃতন্ত্র তার স্ট্রাটেজি পাল্টে ফেলছে। ফলে নারীবাদের ভ্যাকসিন তখন পিতৃতন্ত্রের ভাইরাসকে প্রতিরোধ না করে উল্টে তার সহায়ক হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। তাই যেমন আমাদের কম্পিউটারের এন্টিভাইরাস প্রতিদিন আপডেট করতে হয় নতুন নতুন ম্যালওয়্যারকে ডিটেক্ট করতে, তেমনি নারীবাদের ধারণাকেও স্থান-কাল-পাত্র বিচার করে বারবার আপডেট করতে হয় পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে। আর এই লড়াই চলতে থাকবে যতদিন না পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছি।

শেয়ার করুন: