ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
“বাবা” ডেকে অনুনয় করেও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি মেয়েটি – বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীর ঘটনায় ধর্ষণের ভয়ংকর ভিডিওচিত্র দেখার পর অনেকেই লিখছি আমরা।
এ কথা ভাবছি মানে পক্ষান্তরে ধর্ষকের কাছ থেকে বিবেক আশা করছি আমরা। ভুলে যাচ্ছি ধর্ষক সমাজ বিচ্ছিন্ন জীব নয়, কারো পিতা – পুত্র – ভাই, প্রেমিক – কিংবা পতি পরমেশ্বরই অবলীলায় ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চলেছে। ধর্ষণের শিকার নারীর পক্ষে ওই পরিস্থিতিতে এভাবে অনুনয় করাটা বাঁচার শেষ আকুলতা।
কিন্তু বাপ- ভাই-ছেলে ডাকলে ধর্ষকের বিবেক জাগ্রত হবে, এমন আশা করা আমাদের জন্য অর্বাচীন বলে মনে করি।
প্রতিদিনের ধর্ষণের পরিসংখ্যান নাও যদি জানি আমার নারীজন্ম আমাকে জানিয়ে দেয় ধর্ষকের সমাজে বাস করছি আমরা। জন্ম থেকেই শ্বাপদসংকুল থুড়ি ধর্ষকসংকুল জীবন আমাদের।
ধর্ষককুল যখন-তখন তার নারকীয় তাণ্ডব দেখিয়ে চলেছে আমাদের। অথচ আমরা এখনো আশা করছি “বাবা” ডাকেও কেন জেগে উঠলো না ধর্ষকের মানবতাবোধ! ধর্ষকের আবার বিবেক! আমার প্রশ্ন বরং ঘটনাস্থলের আশেপাশের মানুষের কাছে। ধর্ষণ করেই পালিয়ে যায়নি ধর্ষকের দল, মেয়েটির বিবস্ত্র শরীরে অনবরত আঘাত করে গেছে, ভিডিও করে পৈশাচিক উন্মাদনায় মত্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছে অপরাধীরা। এতো বড় অপরাধ সংঘটিত হবার সময় বা পরবর্তীতে কেউ এগিয়ে আসেনি, পুলিশে খবর দেয়নি৷ কেন? এলাকাশুদ্ধ লোক জড়ো হলে এদের দমন করা খুব কি কঠিন ছিলো?
অবশ্য যেখানে পথেঘাটে কোনো মেয়েকে হেনস্থা হতে দেখলে একটি মানুষ প্রতিবাদ করে না, উল্টে মেয়ে যদি প্রতিবাদ করে তাকে আরো বেশি অপমানিত – অপদস্থ করতে একদল লোক জড়ো হয়, মাপতে থাকে মেয়ের পোশাক, শরীর আর চরিত্রের অলিগলি। এরপর যেচে পড়ে কেউ বিচারের রায় দিতে চলে আসে – “যান, যান আপা। ওই মহিলা মানুষ হয়ে এতো কথা বাড়ায়েন না…”
সেই সমাজে দাঁড়িয়ে এমন আশাও বোধ করি দুরাশা।
ওড়না ঠিক নেই মানে মেয়ে অসভ্য, স্বাধীন চলাফেরা করে মানে মেয়ে বেশ্যা, প্রতিবাদ করে মানে মেয়ে চরিত্রহীন, নারীবাদী। জলের মতো সহজ অংক। আর কী লাগে মেয়ের অপরাধ প্রমাণে, ধর্ষণের সাফাই গাইতে?
এতো কিছু জানার পরও কেন এই ভিডিও দেখে আমরা মুর্চ্ছা যাচ্ছি? প্রতিটি ধর্ষণের শিকার শিশু বা নারীর অভিজ্ঞতা এমন বা এর চেয়ে শতগুণ ভয়াবহ। সেইসব ভিডিও সামনে আসে না তাই আমরা এড়িয়ে যেতে পারি।
নোয়াখালীর ঘটনায় যখন প্রতিবাদ চলছে, এরই মাঝে নাহলেও আরও চার থেকে পাঁচটি ধর্ষণের খবর চলে এসেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এই যখন অবস্থা সেক্ষেত্রে ধর্ষণের বিচারে আইনের দ্রুতগতি কেন ত্বরান্বিত হবে না?
ধর্ষক ও ধর্ষকামী মগজে, চিন্তাভাবনায়, দুষ্কর্ম্মে সয়লাব চারদিক থেকে “সব পুরুষ ধর্ষক না” শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। ধর্ষক দলের লেবাসধারী হলে তারে নিয়ে টেনিস – ফুটবল খেলারও দরকার নেই। ধর্ষক ধর্ষকই। সবার আগে তাকে দল থেকে লাথি মেরে আইনের আওতায় আনা হোক। ধর্ষক ও তার পরিবারের পরিচয় ফলাও করে প্রকাশ করা হোক। পরিবার তাকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দিয়ে থাকলে সামাজিকভাবে বয়কট করা হোক, রাষ্ট্রীয় সুবিধাবঞ্চিত করা হোক। দ্রুত বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শক্ত ও জোরালো ভূমিকা চাই। আসলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বরং এতোদিনে আলাদা করে পূর্ণাংগ একটি নারী মন্ত্রণালয় এবং এর কার্যকর অবস্থান থাকা উচিৎ ছিলো আমাদের। যৌন অপরাধ প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে ছেলে শিশুদের নারীর প্রতি যথাযথ আচরণ ও মনোভাব গড়ে তুলতে কাজ করা দরকার।
পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে, নারীর চরিত্র আর পোশাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী করার মনোভাব না বদলাতে পারলে ধর্ষকের সাথেই বসবাস করতে হবে জীবনভর।
ধর্ষকের বিবেক জাগ্রত হবার অপেক্ষা না করে নিজের বিবেক জাগ্রত রাখুন।
বেগমগঞ্জের ধর্ষণ মামলা শুধু না প্রত্যেক যৌন অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হোক।