সিরাজুম মুনিরা তুলি:
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ নং ধারা অনুযায়ী, যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া
বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
এখানে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে, স্বামী যদি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীকে সম্মতি ছাড়া জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন করেন তাহলে কি সেটা ধর্ষণ হবে?
পেনাল কোডের সেকশান ৩৭৫ অনুযায়ী ১৩ বছরের (সেকশন ৩৭৬ অনুযায়ী ১২ বছর) উর্ধ্বে যে কোন মেয়েকে তার স্বামী জোরপূর্বক যৌন মিলনে বাধ্য করলেও সেটা ধর্ষণ না।
যদিওবা ধর্ষণের সংজ্ঞায় ১৬বছরের কম বয়সে কোনো মেয়ের সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণ, কিন্তু ১২ বছরের উর্ধ্বে কোনো নারী তার স্বামী কর্তৃক ধর্ষিত হলে তা কোনো আইনের আওতায় আসবে না।
এক মাসের জেল ও ১-১০,০০০ টাকা জরিমানার আইন থাকা সত্ত্বেও দেশে ব্যাপক আকারে বাল্যবিবাহ প্রচলিত, যার বেশিরভাগই দুই পরিবারের বোঝাপড়ার কারণে আইনের আওতায় আনা হয় না এবং এসকল বিয়ের সিংহভাগেই অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকেন কনে। বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জন্য সংবিধানে আলাদা কোনো আইন তো নেইই বরং এসকল বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে, ১২-১৬ বছর বয়সী যেকোনো মেয়ে বিয়ের পর যৌন নিপিড়নের শিকার হলে তাও সংবিধান অনুযায়ী ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে, বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে সম্মতির ব্যাপারটা আপনি-আমি বা অন্য কেউ কতটা পরিষ্কার বুঝি?
একজন যৌনকর্মী কি ধর্ষিত হন না? তার সম্মতি কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? যৌনকর্মী হলেই কি তাকে যেকোন সময় জোর করা যায়, বা সে সর্বক্ষণ সম্মতির দায় অন্যকে দিয়ে বসে আছে?
২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত “ধর্ষণ ও সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতা” শীর্ষক একটি কলামে ধর্ষণ মামলার সামাজিক বাস্তবতা বিষয়ক একজন গবেষক উল্লেখ করেন, কাজের সূত্রে ব্লাস্টের গবেষক হিসেবে তিনি ধর্ষণ মামলায় কেন ভিকটিমের ‘চরিত্র’ বিষয়টি এতো প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে ২০১১ সালের দিকে একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজ শুরু করেন। তার বছর খানেক আগে গবেষণার উদ্দেশ্যে জেলখানায় ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি, যার বিরুদ্ধে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং তিনি প্রায় তিন বছর ধরে জেলখানাতেই অভিযুক্ত হিসেবে কারাবন্দী ছিলেন। আলাপ চলাকালে তিনি তাকে যতবার ধর্ষণ মামলা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বারবারই ধর্ষক তাঁকে এক কথাই বলে যাচ্ছিলেন, ‘সে ভাড়াইট্টা, ভাড়াইট্টা নষ্ট হয় কেমনে?’
তৃতীয়ত, যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ ভীতি প্রদর্শন পূর্বক সম্মতি আদায় করে এবং সেই সম্মতিতে যৌন মিলন হয় সেটা কি ধর্ষণ না? সেক্ষেত্রে জবরদস্তির কোনো আলামত পাওয়া না গেলে, এবং সম্মতি কেন ছিল সেটার উর্ধ্বে, সম্মতি ছিল এটুকুতে দৃষ্টিপাত করলে সেটা ধর্ষণের আওতায় আসবে কি?
উত্তর হচ্ছে, না! আসবে না। সেক্ষেত্রে “সম্মতি” ধারণাটারই অপব্যবহার হবে।
এবং সবশেষে প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়। কিছুদিন আগেও “বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ” কথাটা নিয়ে বেশ ভালো হাসি তামাশা হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়, -প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মতি নিয়েই যদি সব হয় তাহলে সেটা আবার ধর্ষণ নাকি!! হ্যাঁ, আইনী সংজ্ঞা অনুযায়ী তা ধর্ষণ।
এখানে বলা দরকার আইনে পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে সম্মতি থাকা জরুরি, এবং সেটা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে আদায় করা যাবে না। প্রতারণার আশ্রয় নিলে সেটা অবশ্যই ধর্ষণের আওতায় পড়বে।
যদিও এ আইনেরও অপব্যবহার যথেষ্ট আছে, যেহেতু মেয়েটির সে সময় আসলেই সম্মতি ছিল কি ছিল না তা নিয়ে শক্ত প্রমাণের যথেষ্ট অভাব থেকে যায় কেননা যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিতান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয় যার বোঝাপড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুজন মানুষের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে ফলে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে যে কেউ আইনের অপব্যবহারের শিকার হতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে সম্মতি ও সম্মতি আদায়ের পন্থা দুটোর ব্যাপারেই পরিষ্কার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এবং তা সত্ত্বেও আইনের অপব্যবহার করেই অপরাধীর ছাড়া পেয়ে যাওয়া সম্ভব এবং তা হচ্ছেও অহরহ। তাহলে ধর্ষণ রোধে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও ধর্ষণ আইন ঠিক কতটা কার্যকর সে প্রশ্ন থেকেই যায়!
কিন্তু যে বিষয়টির উপর কোনো আইনী বাধ্যবাধকতাই নেই অর্থাৎ বৈবাহিক যৌন সম্পর্ক, তার ব্যাপারে আমরা ঠিক কতটুকু যত্নশীল? “হেলদি সেক্স” ধারণাটির সাথে আমরা শতকরা কতভাগ মানুষ পরিচিত? যেহেতু কোনো আইনী বাধা নেই, বৈবাহিক জীবনে যৌন সম্পর্কে সম্মতি ও অনুমতির সুস্থ চর্চাটা ঠিক কত ভাগ মানুষের মাঝে আছে?
সুস্থ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে উভয়ের সম্মতির প্রয়োজনীয়তার স্বাভাবিক চর্চা বা শিক্ষাটি যদি নিজের ঘর থেকেই শুরু না হয় তাহলে একটি সমাজে নারীর প্রতি ভোগ্যপণ্যমূলক আচরণ যে বৃদ্ধি পাবে বলা বাহুল্য। বর্তমান সমাজের যৌনচিন্তা ও মানসিকতা কতটা বিকৃত তা জানতে সার্চ ইঞ্জিনে “ধর্ষণ” পুরোটা টাইপও করতে হয় না, শীর্ষস্থানে ফলাফল হিসেবে দেখতে মেলে, “ধর্ষণের মজার গল্প”, “ধর্ষণের পিক” কিংবা “ধর্ষণের ভিডিও ফেইসবুক” ইত্যাদির (যদি না এ নিয়ে আপনার পূর্বের অনুসন্ধান সার্চ রেজাল্ট প্রভাবিত করে, তো)। বলাই বাহুল্য সেসব গল্প বা ছবি যুব সমাজকে পুলকিত করে না রাখলে তা ফলাফলের শীর্ষস্থানে অন্তত জায়গা নিত না।
এখানে ধর্ষণ শুধু তাদের কাছে যৌনসুখ লাভেরই একটি জায়গা না বরং ক্ষমতা, দাপট ও গতানুগতিক পুরুষত্ব(!) জাহিরের একটি পথ, যে পথে ধর্ষণ করতে পারা এবং জোরপূর্বক যৌনসন্তুষ্টি লাভ করা একটা বিশাল বড় অর্জন হয়ে ওঠে। ক্ষেত্র বিশেষে সম্মতির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেয়েও জোর খাটানোর প্রবণতা বেশি বেড়ে যাচ্ছে, কারণ সমাজ ব্যবস্থা ও সে ব্যবস্থা ঘিরে গড়ে ওঠা মন মানসিকতা অনেকাংশেই এটাকে বীরত্বের(!) বা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নিচ্ছে।
এই প্রবণতার সূত্রপাত কোথায়? সুস্থ যৌন শিক্ষায় আমাদের পারিবারিক ভূমিকাটাই বা কী?
আমাদের শতকরা কত ভাগ পরিবার নিজের সন্তানকে দায়িত্ব নিয়ে যৌন শিক্ষা দান করে? তাদের যৌন শিক্ষার গুরু হয়ে ওঠে এলাকার বড়ভাই বা বন্ধু মহলের আড্ডা সাথে “চটি গল্প” বা “পর্ণ ফিল্ম” যেখানে মেয়ে কেবলই ভোগ্যবস্তু, যেখানে একটা মেয়ে গণধর্ষণও উপভোগ করে। ছোটবেলা থেকে যৌনতা নিয়ে তার যে চরম বিকৃত জগত, তার যে অস্বাভাবিক পাশবিক শিক্ষা তা তাকে শুরু থেকেই নারীকে অব্জেক্টিফাই করতে বাধ্য করছে। এই অব্জেক্টিফাইড প্রবণতাটা দূর করার যে পারিবারিক চর্চাটা, তা কি আমাদের মাঝে রয়েছে? যেখানে বিষয়টা এমন হওয়া উচিৎ ছিল যেন প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে যৌনতার প্রথম ধারণা তার পরিবার থেকে পায়, যেন শুরুতেই কোনো বিকৃত ধারণা তার প্রাথমিক শিক্ষা না হয়।
কিন্তু আমরা পারিবারিক যৌনশিক্ষাকে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি, এবং নিজেদের অজান্তে “গাই টক”এর আড্ডায় পটেনশিয়াল রেপিস্টদের বীজ বুনে দিচ্ছি। একদিকে রয়েছে রক্ষণশীল সমাজে ছোটবেলা থেকে সংস্পর্শ না পাওয়া বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, অন্যদিকে সে অধরাকে বিকৃতভাবে পেতে চাওয়ার মনোবাসনা বা ফ্যান্টাসি। পরবর্তীতে যার ক্ষমতা অতটাও নেই, সে সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করছে, আর যার ক্ষমতা আছে সে সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছে। এখানে পারিবারিক শিক্ষা আর পারিবারিক চর্চা দুটির অবশ্যই দুটি ভিন্ন মাত্রার গুরুত্ব রয়েছে।
সন্তানকে শিক্ষাদানের পাশাপাশি এই চর্চা নিজেদের মধ্যেও থাকতে হবে যে – সুস্থ যৌন সম্পর্ক উভয়পক্ষের সম্মতি দাবি করে, সেটা বিবাহে আবদ্ধ স্বামী স্ত্রী হলেও। সেক্ষেত্রে বৈবাহিক যৌন সহিংসতা আইনের আওতায় আনা উচিৎ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিৎ। পারিবারিক চর্চা ছাড়া যেমন সুস্থ যৌনতার সংজ্ঞা ও সম্মতির গুরুত্ব ভেতরে ধারণ সম্ভব না, তেমনি পারিবারিক শিক্ষা ছাড়া নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীও গোড়া থেকে বদলানো সম্ভব না। আর এদুটো যতদিন না বদলাচ্ছে ক্ষমতা প্রদর্শনের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে ধর্ষণ, বাসে-ট্রামে, পার্কে-জঙ্গলে নারী শরীরে ঝাপিয়ে পড়েই পরম তৃপ্তি খুঁজে নেবে অন্যত্র দাপট দেখাতে না পারা কোনো হতাশ পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শারীরিক বা সামাজিক ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ধর্ষণ বাড়তেই থাকবে, তা সে সমাজ যতই নারী নেতৃত্বাধীন হোক।