‘ধর্ষণ মহামারী’ বন্ধে প্রয়োজন জোরালো কিছু পদক্ষেপ

সুপ্রীতি ধর:

‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ – এই শ্লোগানের পাশাপাশি এটাও এখন বলা যেতে পারে, বেটিকে ধর্ষণ করো, দুই হাত বা চৌদ্দ হাতে চেপে ধরে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দাও, তার যৌনাঙ্গে আস্ত লোহার শিক ঢুকিয়ে দিয়ে দেখো সে ব্যথা পায় কিনা, তাকে ধর্ষণশেষে চলন্ত বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দাও, বেটিকে পুড়িয়ে মারো, জন্মের আগেই খুন করে ফেলো, পদে পদে তাদের অপমান করো, অসম্মান করো, আত্মবিশ্বাসহীন করে গড়ে তোলো, পরিবারে সবচাইতে কম দামি, মূল্যহীনভাবে বড় করে তোলো…এই তো??? এই তো আমাদের রাষ্ট্র, এই তো  রাষ্ট্রের মোটো, এই তো চাওয়া? তাহলে আর মেয়েদের বাঁচানো এবং পড়ানোর ধোঁয়া তোলা কেন? শেষ করে দাও অংকুরেই, তাও ভালো।

সেদিন ভারতের উত্তরপ্রদেশের আগ্রা অঞ্চলের হাতরাশ গ্রামে ঘটে যাওয়া এক নির্মম, বর্বর, লোমহর্ষক, বিভৎস খবরটি পড়ার পর থেকে এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল। মণীষা নামের সেই দলিত মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিল উচ্চবর্ণের কয়েকটি যুবক। বীভৎসভাবে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয় এবং ধর্ষণের ভয়াবহতায় দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে গিয়ে মেয়েটির জিভ কেটে যায়। হাসপাতালে নেয়া হলেও মেয়েটি বাঁচেনি। লাশটা গুম করে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। কতোটা উদ্ধত, পৈশাচিক, বর্বর হলেই না কোনো মানুষ এই কাজ করতে পারে! অথচ মেয়েটি দরিদ্র বলে এবং ঘটনাটি উত্তর প্রদেশে ঘটেছে বলে এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদ ভারতে দেখিনি।

একই সময়ে বাংলাদেশের খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধী নারীকে এবং সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে যাওয়া একটি মেয়েকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলো। পাহাড় থেকে সমতল, আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ, কোথাও নারী জীবন নিরাপদ না। উন্নত দেশগুলোতে তবুও রাষ্ট্র পাশে থাকে ভিকটিমের, কিন্তু আমাদের দেশে নারীর পাশে কে থাকে? সেই নারী যদি আবার ভিকটিম হয়, তখন তো আরও থাকে না কেউ। পরিবারও মুখ ফিরিয়ে নেয়।

আরও একটি ঘটনা ঘটলো। গির্জার একজন ফাদার ধর্ষণ করে এক কিশোরীকে, শুধু তাই না, তাকে আটকেও রাখে। পরবর্তিতে পুলিশের সহায়তা নিয়ে সেই মেয়েকে উদ্ধার করতে হয় তার পরিবারের। ক্ষমতাই কি তাহলে ধর্ষকের মূলশক্তি?

গতকাল ভাইরাল হলো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক মধ্যবয়সী নারীকে তার স্বামীর সামনে পিটিয়ে বিবস্ত্র করে, যৌনাংগে হাত দিয়ে, টর্চ ঢুকিয়ে দিয়ে অত্যাচার করেছে একদল ছেলে। আবার সেটা ভিডিওতে ধারণও করেছে । ঘটনা ৩২ দিন আগের। তারপর থেকেই ওরা ওই পরিবারটির কাছে টাকা দাবি করে আসছিল, নইলে ভিডিওটি ছেড়ে দেবে এই হুমকি দিয়ে। গরীব, দরিদ্র পরিবার বাড়িছাড়া হয়ে যায় এরপর থেকেই। শেষতক টাকা না পেয়ে গতকাল সেই বখাটে ছেলেরা ভিডিওটি প্রকাশ করে দেয়ার সাথে সাথে তা ভাইরাল হয়ে যায়। শিউড়ে উঠেছি আমরা এই ভিডিওটি দেখে এবং নারীটির ‘বাবারে, বাবারে’ বলে আর্তচিৎকার শুনে আমরা কেউ স্থির থাকতে পারিনি, ছটফট করেছি কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায়। মনে হয়েছে আমাকেই যেন বিবসনা করা হলো, আমিই যেন সেই নারীটি!

আমরা সাধারণেরা হতবিহ্বল, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কোনো হেলদোল নেই। একটি বাড়িতে এমন একটি ঘটনা ঘটলো, আশেপাশের বাড়িগুলোর কেউই আগ বাড়িয়ে আসেনি মেয়েটিকে বখাটেদের কাছ থেকে উদ্ধারে। এই বখাটেরা শুনেছি ওখানকার দেলোয়ার বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত। ওরা এতোটাই প্রভাবশালী ওই এলাকায় যে একটি মেয়েকে স্বামীর সামনে এমন পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করতে পারে? এবং কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না ওদের বিরুদ্ধে? এই উঠতি বয়সী ছেলেগুলোর গডফাদার কে বা কারা? এর আগে আমরা নয়ন বন্ডদের চিনেছি। এইসব বন্ডদের যারা তৈরি করছে, সময় হয়েছে এদেরকে সামনে এনে যথাযথ বিচার করা, নইলে নষ্ট সামাজিক  ও রাজনৈতিক এই ব্যাধি ক্রমশ বাড়বেই।

একদিক থেকে ঘাড় অন্যদিকে ফেরাতে না ফেরাতেই আরও বীভৎস বর্ণনা নিয়ে হাজির হচ্ছে একেকটা ধর্ষণের বা নির্যাতনের ঘটনা, একেকটি হত্যার ঘটনা। গণধর্ষণ এখন মচ্ছবে পরিণত হয়ে গেছে। আফসানা কিশোয়ার লোচন গতকাল এক লাইভ প্রোগ্রাম বলছিলেন, “এই সরকারের উন্নয়ন, ঘরে ঘরে গণধর্ষণ” – ঠিক কতোটা ক্ষুব্ধ হলে পরেই এমনভাবে অভিযুক্ত করা যায় কোনো একটি রাষ্ট্রের সরকারকে।

প্রতি বছর ঠিক কতসংখ্যক মেয়ে কেবল মেয়ে বলেই না, কেবল তার যোনি আর স্তনের কারণেই নয়, তার সম্প্রদায়গত কারণেও লালসার শিকার হয়, শুধুমাত্র এর জন্য হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে রাখা উচিত, আমার মতে। বিচার চাইতে চাইতে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ, কোনো প্রতিবাদ, লেখালেখি, কিছুই ‘ধর্মের কল’কে নাড়া দিতে পারছে না।

কানিজ আকলিমা সুলতানা‘র মতোন কেবল বলি, “কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করছে। ধর্ষণ অত্যাচারের শিকার হাজারও নারীর আর্তনাদের প্রতিক্রিয়ায় আসমান ভেংগে পড়ুক এইদেশের প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, রাজনীতি, ক্ষমতা, সবকিছুর উপর। ধ্বংস হয়ে যাক সব”।

মূলত এই ধর্ষণ মহামারী থেকে কীভাবে রক্ষা পেতে পারি আমরা? একদিন-দুদিনের আন্দোলন, প্রতিবাদে কিছুই হবে না। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদে কিছু পরিকল্পনা হাতে নেয়া।

এক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক এর পোস্ট থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম:

“ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ঘটনাভিত্তিক করে লাভ কম।। এমসি কলেজে ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ এরেস্ট করে ফেলেছে-আন্দোলন শেষ। নোয়াখালিতে ঘটনা ঘটেছে, এরেস্ট করে ফেলেছে-সুতরাং আন্দোলন আর কী নিয়া করা হবে! এইসব বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ধর্ষণ কমাতে পারছে না। আজকে এখানে, কালকে ওখানে প্রতিদিন, প্রতিরাত ধর্ষণ চলছে, নারী নির্যাতন চলছে।

এখন প্রয়োজন দফা ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন। নারী নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজকে কী কী দায়িত্ব নিতে হবে সেগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং সেই মোতাবেক দীর্ঘ আন্দোলন তৈরি করে অর্জনে বাধ্য করা দরকার। নইলে হাওয়াই মিঠাই আন্দোলনে সমাজ পরিবর্তন হবে না।

১. আইন সংশোধন :
প্রথমেই দাবি করতে হবে আইন পর্যালোচনা করে সংশোধন করা। বিদ্যমান আইন ধর্ষণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে, তা তো দেখাই যাচ্ছে। তাহলে আইনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সেই ধাপগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনে সেই পরিবর্তন আনতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আইনে কী কী সংশোধন দরকার সে বিষয়ে বিজ্ঞ আইনজীবী, পুলিশ প্রশাসন, ভিকটিমদের সাপোর্ট প্রদানে অভিজ্ঞ মানবাধিকার কর্মীবৃন্দের মতামত নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। শুধু আইন মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করে ফাঁকা ‘সংশোধন করো’ দাবিতে ফল হবে না।

  • এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য যে নারী নির্যাতন দমন আইনের অপপ্রয়োগও ঘটতে দেখা যায় বহুক্ষেত্রে। সেটা বন্ধেরও উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে করে সত্যিকার অপরাধীকেই আইনের আওতায় এনে সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, সেদিকটাতে গুরুত্ব দিতে হবে।

২. নারী নির্যাতন দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল :
শুধুমাত্র নারী নির্যাতন, যৌন নির্যাতন এসবের দ্রুত বিচারের জন্য প্রতিটি জেলায় ডেডিকেটেড আদালত স্থাপনের দাবি করতে হবে। আমরা অবশ্যই চাই সব অপরাধের দ্রুত বিচার হোক, কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে। তাই আলাদা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনার রায় পাওয়া গেলে সম্ভাব্য অন্যান্য অপরাধীরাও সতর্ক হবে।

৩. সামাজিক প্রচারণা :
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর নাম বদলে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় করতে হবে এবং এই মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়কে নারী ও যৌন নিপীড়নবিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচুর কাজ করতে বাধ্য করতে হবে। কেউ নির্যাতিত হলে কীভাবে দ্রুত পুলিশে রিপোর্ট করবে (যেমন ৯৯৯ নম্বর) এগুলোর প্রচার দরকার। নারী (মহিলা) অধিদপ্তরকে কার্যকর করে তুলতে হবে আগের মতোন।

৪. শিক্ষা ও সংস্কৃতি :
শিক্ষা কারিকুলামে নারী অধিকার বিষয়ক বেসিক জ্ঞানকে কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারীরাও যে মানুষ, পাওয়ার স্ট্রাকচারের কারণে যে তাঁদেরকে দমন করার রাজনীতিরই অংশ যৌন হয়রানি, এসবের অন্তত একেবারে বেসিক জ্ঞান একজন কিশোর বা তরুণকে দিতে হবে। সেটা সমাজ বিজ্ঞানের একটা চ্যাপ্টার হলেও সই।

জেবতিকের এই পয়েন্টগুলোর সাথে মোটামুটি একমত পোষণ করেই আরও কিছু পয়েন্ট যোগ করতে চাই।

৫. বয়ো:সন্ধিকালে বা ক্লাস সিক্স-সেভেনে পাঠ্য তালিকায় সেক্স এডুকেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এবং শিক্ষকরা যাতে বিষয়টি সঠিকভাবে পাঠদান করেন সেজন্য তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

৬. প্রশাসনের সর্বস্তরে জেন্ডার সেন্সিটিভিটি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.