আসলাম আহমাদ খান:
“বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়
এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়।
এখানে জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বেলে ,
হয় রে সূর্যোদয়….”
উপরে লেখা গানের কলিতে শিক্ষার প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আলোকিত মানুষ গড়ার সূতিকাগার। এখান থেকেই তৈরি হয় ভবিষ্যত রাষ্ট্র নায়ক, বুদ্ধিজীবীসহ জাতির সূর্যসন্তানেরা। জাতির ভবিষ্যত হিরোদের সম্মান জানানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা।
বাংলাদেশের গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেরও ছাত্র সমাজের ছিলো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাজাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেই গৌরবের ভাগীদার শিক্ষকরাও, কারণ তারাই তো ছাত্র-ছাত্রীদের মেন্টর। এজন্য শিক্ষককে শুধু শিক্ষার্থীর শিক্ষক নয়, জাতির শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় দেশের শিক্ষাঙ্গণগুলি বিপরীত স্রোতে চলছে। আমাদেরকে যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-নৈতিকতা-প্রগতিতে আরও উন্নততর হওয়ার কথা ছিল, পরিবর্তে আমরা ভূতের পায়ের মতো পেছনের দিকেহাঁটছি। জাতির সমস্ত অর্জনকে কলুষিত করার জন্য পৈশাচিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত , যাদের মাথায় সারাক্ষণ ভাদ্রমাস কিলবিল করে। মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা আরও ভয়াবহ- সেখানে বলৎকার থেকে ছেলেশিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই পাওয়া যাবে শিক্ষার্থী নির্যাতনের , শিশু নির্যাতনের সংবাদ- যেন চারিদিকে ধর্ষণের পৈশাচিক উৎসব চলছে। সিলেটে যা ঘটেছে, তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা মাত্র।
এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ছিলো ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ। কিন্তু ছাত্রনেতাদের শিক্ষার্থীরা এখন ভয় পায়, অনিরাপদ মনে করে। ছাত্র রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় মানুষরূপী কিছু হিংস্র জানোয়ার দেশের বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বড়বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে ধর্ষণের তাণ্ডব নৃত্যে মেতেছে- যার প্রভাব সমস্ত ছাত্র সমাজের ভাবমূর্তির উপরও পড়ছে। ধরা পড়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষকে ছেলে ভুলানো গল্প শোনায়:
“ওদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে”
“এখানে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কমিটি নেই”
“ওরা অমুক দল, তমুক দল থেকে এসেছে”
ক্ষমতার লোভে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের একটা অংশও রাজনীতিবিদদের পদলেহনের পাশাপাশি ছাত্র নামধারী এসমস্ত দুর্বৃত্তদেরও আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে।
সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলিরও একই অবস্থা। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণের আহবায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে ঐ সংগঠনেরই একজন নারী সদস্য যিনি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তৎকালীন ডাকসু ভিপি’র নিকট ঘটনার প্রতিকার চেয়েছিলো ঐ নারী শিক্ষার্থী, তিনি বলেছেন ঘটনা চেপে যেতে। ঘটনা চেপে যাওয়ার যে পরামর্শ ডাকসু ভিপি দিয়েছেন, ৫০ বছর আগে লোকলজ্জার ভয়ে এ কাজটি অসহায় অভিভাবকরাই করতো। তাহলে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আমরা কী অর্জন করলাম?
প্রতি বছর ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যবলছে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারীও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যাছিল ৩৫৬।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম: ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়াএক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ।
নারায়ণগঞ্জে কওমী মাদ্রাসার এক মৌলভী একাই বলৎকার করেছে ২০ জনের উপরে শিশুকে। সারা দেশে শিশু থেকে শুরু করেকিশোরী, ছাত্রী, গৃহিণী,১০০ বছরের অশীতিপর বৃদ্ধা – ধর্ষণের হাত থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছেন না।
কর্মক্ষেত্র কিংবা শিক্ষা র্প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়িতে ফেরার পথে ট্রেনে-বাসে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। সেনানিবাসের মতো নিরাপত্তারচাদরে ঢাকা এলাকাতেও শিক্ষার্থী ধর্ষিত হয়েছে।
একটা ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন অবস্থা সরমগরম থাকে, কিছুদিন পর যেই সেই। নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য পুলিশের স্মরণাপন্ন হলে, সেখানেও তারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়। শুধু পুলিশ ইনভেষ্টিগেশন নয়, আদালতে আসামীপক্ষের আইনজীবীর জেরায় আরও কয়েক দফা ধর্ষিত হয়। ধর্ষণের শিকার নারী সামাজিকভাবেও নিগৃহীত হয়। কারণ ধর্ষণের শিকার নারীকে সহনশীলতার দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা আজও এ সমাজে তৈরি হয়নি। সহানুভূতি যতটুকু দেখানো হয়, তার যতটুকু মানবিক- হাজার গুণ বৈজ্ঞাপনিক। আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো: একটি নির্যাতিতা মেয়েকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে কতজন অভিভাবক প্রস্তুত?
সর্বত্রই বিকৃত মানসিকতার চর্চা। একটি ঘটনা ঘটলে সবাই মেয়েটির চরিত্র হননে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, অথচ একবারও চিন্তা করে না- মেয়েটি যদি তার নিজের হতো তাহলে কী করতো ! পত্রিকায় ধর্ষণের সংবাদ ছাপা হলে, যে পত্রিকায় ঘটনার রগরগে ধারাবিবরণী থাকে, বিকৃত মানসিকতার মানুষদের কাছে এমন পত্রিকার কাটতি বেশি।
১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ধর্ষণের সেঞ্চুরি পূরণ করার পর আন্দোলনে ফুঁসে উঠেছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা সবাই অভিযুক্তের নাম লিখেছো, ভিকটিম এর নাম তো দেখি না। তখন সমস্ত ছাত্রীরা সমস্বরে জানান দিয়েছিলো – আমরা সবাই ধর্ষিতা। আজ মনে হচ্ছে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয় – সারা বাংলাদেশই ধর্ষিত। এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী মিলিটারিরা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণের উন্মত্ততায় মেতেছিলো। তারা পিতার সামনে কন্যাকে , স্বামীরসামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিলো- সিলেট এমসি কলেজে যা হয়েছে, এ বর্বরতা কি একাত্তরের ঘটনা থেকে কোন অংশে কম ? খাগড়াছড়িতে যা ঘটেছে সেটা ১৯৭১ পৈশাচিকতাকেও হার মানায়, মা-বাবা-ভাই-বোনদের সামনে ধর্ষণ করেছে বোবা প্রতিবন্ধীঅসহায় একটি মেয়েকে।
পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক রাস্তা থেকে বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের অভিযান চলছে। কারণ পাড়ায় মহল্লায় নাকি বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব বেড়ে গেছে। কিন্তু রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরদের তো ভ্যাক্সিন দিয়ে ওদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, কিন্তু যে হারে ধর্ষকের সংখ্যা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণের উপায় কী? ছাত্র রাজনীতির মুখোশের আড়ালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সদর্পে ঘুরে বেড়ানো মানুষরূপী এই দ্বিপদী শ্বাপদদের নিধন করা বেশি জরুরি।
নিউ ইয়র্ক।