সালমা লুনা:
রাজশাহীর তানোরে চার্চে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চার্চের ফাদার প্রদীপ গ্যা গোরী, চার্চের পাশে ঘাস কাটতে যাওয়া ওই মেয়েটিকে চার্চের ভেতর ডেকে নিয়ে চার্চেরই এক ঘরে বন্দী করে রেখে দুদিন ধরে ধর্ষণ বা তথাকথিত নির্যাতন চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই মেয়ের পরিবার মেয়ে নিখোঁজ মর্মে জিডি করেছে। দুদিন পর জানা গেছে তাদের মেয়ে গির্জায় ফাদারের কাছে বন্দী। গ্রামের মোড়ল ও সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কার্মেল মার্ডির গ্রাম্য সালিশে ঘটনা প্রমাণিত হয়ে ফাদার প্রদীপ দোষী সাব্যস্ত হলো।
এরপর থানা পুলিশ হবে। জিডি যেহেতু করাই আছে, পুলিশ আসবে। অপরাধী গ্রেফতার হবে, এবং যথারীতি সকল ধর্ষণের পরিণতি যা হয় তাই হবে।
কিন্তু না। অত জটিলতা হয়নি। একদম সরল হয়ে গেছে এরপর।
সালিশের পরই ফাদারকে দ্রুত অপসারণ করে রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর মেয়েটিকে চার্চে সিস্টারদের জিম্মায় রাখা হয়েছে। পরিবারের কাছে মেয়েটিকে ফিরিয়ে না দিয়ে আটকে রেখে মেয়ের পরিবারকে শর্ত দেয়া হয়েছে, যদি মেয়েটির পরিবার নিখোঁজ হওয়ার জিডিটি প্রত্যাহার করে নেয় তবেই মেয়েকে তারা ফেরত দেবে। এবং মেয়েটি সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত তার খরচ বহন করবে চার্চ।
ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মেয়েটি নাবালিকা। মাত্র ১৫ বছর বয়স। এবং সে উপজাতিদের কোন এক গোত্রের।

এরপর মেয়ের পরিবার জিডি তুলে নেয়। কিন্তু চার্চের প্রধান ফাদার প্যাট্রিক গোমেজ মেয়েটিকে আর ফেরত দিতে চান না পরিবারের কাছে। প্রধান ফাদার প্যাট্রিক গোমেজ আর সালিশ প্রধান কার্মেল মার্ডি মিলে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়েটিকে আটকে রাখলে অবশেষে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে৷
গল্প ফুরোলো নটে গাছটি মুড়লো হলো না। এটি কোন নটেগাছই নয় আসলে।
ইদানীং ধর্ষণের ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট ভাবে ধর্ষণ গল্পের মহিরুহটিকে যেমন দেখা যাচ্ছে, তা আর কোনদিন মুড়োবে না। কেউ হয়তো মুড়োতে পারবেই না আর। পেসিমিস্ট না হই আমরা।
কিন্তু এমন একটা করে ঘটনা সামনে আসতে থাকলে আশা আর কতটা থাকে। আশা ফুরোতে ফুরোতে শেষ যে আশাটুকু ছিলো, হয়ত শাসক নয়, আইন আদালত নয়, মানুষ -কেবলমাত্র সাধারণ মানুষই একদিন ধর্ষকদের প্রতিহত করবে। ধর্ষকের লালসাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। ধর্ষণের শিকার নারীদের বেদনা বুঝতে পারবে। সে আশাও মরীচিকায় পরিণত হয়ে যায়।
এইখানে ধর্ষক একজন চার্চের ফাদার। সে চার্চে কারো সহায়তা ছাড়াই একটি নাবালিকাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে। অথবা চার্চের কেউ টের পায়নি এটা বিশ্বাস যদি করিও তবে সালিশ কর্তা, প্রধান ফাদার মিলে কেন শর্ত দিয়ে মেয়েটিকে আটকে রাখলো সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যাবে না।
যারা ফাদারকে পুলিশে সোপর্দ না করে শহরে সরিয়ে দিলো তারাও কি ধর্ষক? সালিশকর্তা কিংবা প্রধান ফাদার, তারাও হয়তো ধর্ষণ করতে চেয়েছিল মেয়েটিকে। নইলে তাদের সকল কর্মকাণ্ড ধর্ষক প্রদীপের পক্ষেই কেন। পুলিশ ডেকেই কেন তাদের কবল থেকে নিজের নির্যাতিত মেয়েকে উদ্ধার করতে হলো পরিবারকে?
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ধর্ষণ ঘটনা নাকি নতুন নয়। আরো ঘটেছে এবং সেগুলোর ভিক্টিম প্রেমিক প্রেমিকা ছিল বলে তারা আড়ালেই থাকতে চেয়েছে, তাই প্রকাশ হয়নি। এখন ভিক্টিম স্বামী স্ত্রী বলে প্রকাশ পেয়েছে। বুঝলাম ভিক্টিম প্রকাশ করেনি, তাহলে যারা জানতো বলছে, তারাও তো জেনেশুনেই দিনের পর দিন প্রেমিক জুটিদের সাথে এসব ঘটতে দিয়েছে। তারা তো এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের সেই ধর্ষনের অভয়াশ্রমকে গুড়িয়ে দেয়নি, চেনা সেই ধর্ষকদের প্রতিহত করেনি। আজ সাধু সেজে সেসব আবার প্রচারও করছে, এমন নাকি আগেও হয়েছে।
পাহাড়ে ধর্ষণ হয়। পাহাড়ি মেয়েদের ধর্ষণ খালি বাঙালি সেটেলাররাই করে, তাই কি! আর কারা কারা করে আমরাও তো মাঝেমধ্যে শুনতে পাই। সেটা বন্ধ করার কোন চেষ্টা কবে নেয়া হয়েছে?
এসব বিবেচনা করলে ধর্ষকরা কেন আরো ধর্ষণে আগ্রহী হচ্ছে বুঝতে বাকি থাকে না আর। ধর্ষকদের দল কেন ভারী হচ্ছে এটা শিশুও বুঝবে এখন। জাত ধর্ম সম্পর্ক কোন বাছবিচার নাই। কে নাই ধর্ষকের সারিতে?
মৌলানা, পুরুত, ফাদার …বাপ শ্বশুর চাচা মামা খালু ফুপা ভাই বন্ধু বস পাড়া প্রতিবেশি গুণ্ডা ছাত্র শিক্ষক ডাক্তার রোগী আর্মি পুলিশ রাজনৈতিক নেতা কাজের ছেলে এমনকি স্বামীও।
কে নাই এই লিস্টে!
প্রতিবাদে মুখর হতে ক্লান্তি আসে আজকাল। মান অপমান বোধ মরে গেছে। কান্নাও পায় না। ক্রোধের আগুন নিভে যাচ্ছে।
তবে সমস্ত যন্ত্রণা একত্র করে শেষ শক্তি দিয়ে কোনমতে মাথা তুলে এইটুকুই বলতে পারি, এখনো সময় হয়নি কি একটা আইন করার? সর্ব্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কয়েকটা ধর্ষকের অন্তত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার।
কেউ কি নাই দেখার? কেউ কি বুঝছেন না, এই ধর্ষকরা কেমন দানব হয়ে উঠেছে। কেমন ঝাড়েবংশে বাড়ছে! বাড়ছে, এবং ক্রমাগত বাড়ছে।
শাসকদের বলি, আপনাদের কি লজ্জা করে না এতবছরের শাসনামলে একটা ধর্ষকেরও দ্রুত বিচার করে শাস্তি দিতে পারছেন না, কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছেন না। অথচ ক্রমাগত নিজেদের গুণগান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। হাসছেন নাচছেন গাইছেন।
আপনাদের কি এমন নারী জন্ম দেয়নি যাকে ভেবে অন্তত একটি ধর্ষিত নারীর বেদনা নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারেন! নাকি আপনারাও ওই প্রধান ফাদার আর সালিশের মোড়লের মতো ধর্ষককে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে ধর্ষিত নারীর সাথে খেলাধুলার দলের লোক? আসলে ঠিকই বলে সবাই, ধর্ষণ হয় নারীরই দোষে।
দোষ নারীর।
যে ধর্ষণ করে সে বলে, যারা ধর্ষণেচ্ছা পুষে রাখে তারা বলে। আইনের লোক বলে, সমাজের হর্তাকর্তারা বলে। যারা বলেন ধর্ষণ কোথায় নেই তারাও মনে মনে এমন বলেন। নারীর প্রথম দোষ, সে নারী। তার আছে আস্ত একটা শরীর। সেই শরীরে হস্ত-পদ কেশ চোখ নাক ঠোঁট ছাড়াও আছে স্তন। আছে যোনীপথ। যারা ধর্ষণ করে তারা এসব দেখে। যারা লালসার দৃষ্টিতে তাকায় তারাও এসবই দেখে। অথচ তারা ভাবে না কোন কারণে এইরকম একটা নারীশরীর যদি তাকে ধারণ করতে না চাইতো, তবে তার স্থান হতো আস্তাকুঁড়ে নর্দমায়। ঠিক জন্মমুহূর্তে ওরকম একটি যোনিদেশে যদি কোন কারণে সে আটকে যেতো, তাহলে পৃথিবীর আলো সে আর দেখতে পেতো না। এইরকম কোন একটা স্তন থেকে সুধা পেয়েছে বলেই সে জন্মের কয়েকঘন্টার মধ্যেই মরে যায়নি। কোন এক নারীর ঠোঁটই তাকে প্রথম চুম্বন করেছে মায়ায় স্নেহে। মায়ার চোখে আগলে রেখেছে। হাতদুটো তার পরিচর্যা করেছে কত কত বছর।
এসব ওই লোকগুলো কখনো ভাবে না।
কাকেই বা কী বলছি! এসব চিন্তা করতে মগজ লাগে। ধর্ষকের তো মগজই নেই। তার আছে কামুক শিশ্ন। আর আছে শিশ্নধারী রক্ষাকর্তারা, যারা বলেন ধর্ষণ সবদেশেই, সর্বত্রই আছে।
কোন ক্ষমতা নয়। কোন দাপট নয়। শিশ্নের বড়াই নয়। সকল শ্রেণির ধর্ষকরা এতোকিছু বোঝে না। তারা বোঝে এইরকম দুইচারটা মাইয়ামানুষের সাথে এসব করলে রাষ্ট্র আমার ইয়েটা করবে।
কাজেই এইরকম মহামারী আকারে ধর্ষণ হয় একটা শক্তপোক্ত আইনের অভাবে। আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য। শাসকের নারীদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। ধর্ষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থকরদের জন্য। যা এখন স্পষ্ট।
রাষ্ট্রের উচ্চপদে নারীদের ধরে ধরে পুতুলের মত বসিয়ে দিলেই যার পরিবর্তন অসম্ভব।
বরং কঠোর আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ করে ধর্ষণে তার কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই রাষ্ট্রকেই এটা প্রমাণ করতে হবে।