ধর্ষণ যখন অপ্রতিরোধ্য

শাহানা লুবনা:

ধর্ষন যখন অপ্রতিরোধ্য. তখন করণীয় কী? নানা মুনির নানান মত। কেউ কেউ সরকারের কাছে আবেদন রেখেছেন প্রতিটি জেলা শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পতিতালয় গড়ে তোলা হোক। যেন ধর্ষক নামক প্রাণিরা অন্যদিকে হাত বাড়াতে না পারে। ধর্ষকদের মনোবৃত্তীয়, শারীরবৃত্তীয় চাহিদা যেন পতিতালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পতিতালয় = পতিত + আলয় দুটো ভিন্ন শব্দের সমন্বয়। বিষয়টি এমন দাঁড়ায় — সমাজ থেকে যারা পতিত, যাদের নিবাস পৃথিবীর অতল গহ্বরে, যাদের স্বপ্ন ডানা মেলার অধিকার নেই, তাদের কাছেই যাবে ধর্ষকরা। আমাদের এই সভ্য সমাজে কেন?

যারা এই আবেদন করেছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন….এইসব পতিতালয়ে যেসব কন্যা সন্তান পতিতাবৃত্তি করবে, তারা কোথা থেকে আসবে ?? এত অগণিত যৌনকর্মীর যোগান হবে কীভাবে??? বিকৃত যৌনাচারের চাহিদা মেটাতে কে দিবে তার শিশু সন্তান, কিশোরী, কিংবা তরুণী কন্যা…. ???
একজন যৌনকর্মী , সেও চায় না তার সন্তান পতিতাবৃত্তি করুক, কিংবা যৌনকর্মী পরিচয়ে বেড়ে উঠুক। যে নরকের জীবন এই সমাজ , এই পৃথিবী তাকে দিয়েছে, তার সন্তান যেন সেই নরক যন্ত্রণা কখনো ভোগ না করে। সেও চায় তার সন্তান স্বপ্ন দেখতে শিখুক। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে শিখুক। নাইবা থাকুক তার পিতৃ পরিচয়। তবুও তার সন্তান খোলা আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে বাঁচুক।

সভ্য সমাজের নামধারী এই আমরাই ঢাল হয়ে দাঁড়াই তাদের বিপক্ষে। নিরাপরাধ কন্যা সন্তানদের সাথে সংঘটিত অপরাধকে ধর্ষণের শিকার বা ভিকটিম নাম দিয়ে আমরাই তাদের সমাজ থেকে পতিত করি। নিজের সন্তানের স্বপ্ন বাঁচাতে অন্যের সন্তানের স্বপ্ন কুঁড়িতেই বিনাশ করতে মরিয়া হয়ে উঠছি এই আমরাই। হায়রে সভ্য সমাজ!!!

অনেক মায়েরা ইদানিং ফেসবুকে লাইভ করে কিংবা স্ট্যাটাস দিয়ে সন্তানের সাথে সংঘটিত অপরাধের জন্য মায়েদের দোষারোপ করছেন। সন্তান ধর্ষণের শিকার হওয়ার দায়ভার যেন মায়েরই! মায়ের ঔদাসীন্য, নিজের ক্যারিয়ার, চাকরি প্রভৃতি কারণে সন্তান নাকি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে! বেড়ে চলছে এই অপরাধ।

বলুন তো, কোন মা চায় তার সন্তান এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাক? অনেকে বলছেন, আমি মা হয়ে সার্বক্ষণিক আমার সন্তানকে দেখেশুনে রাখি। খুব ভালো কথা। আপনার সেই সুযোগ আছে বলে আপনি দেখে শুনে রাখছেন। কিন্তু যে মা কাজে না গেলে তার সন্তানের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো আহার জোটে না, স্বামী স্ত্রী দুজনের আয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোটে, তারা কী করবে? এখন তারা কাজ করে বলে তাদের সন্তানদের কপালে যে কোনো সময় ধর্ষণের তিলক লাগবে? আপনি না হয় চাকরি করেন না মানলাম। কিন্তু যে কন্যা সন্তানকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন, যাকে আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, সে তো ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ঘরে বসে থাকবে না। তার কন্যা সন্তানের কী পরিণতি হবে?? মা ছাড়া তো কেউই বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বাস অবিশ্বাস দুজায়গায়তেই মায়ের স্থান তথাকথিত এই সমাজে সবার উপরে। অনেকটা কচু পাতার উপর টলটলে পানির মতোন। একটু নড়া দিলেই গড়িয়ে পড়ে। আর এই গড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে নিজের অজান্তে আপনার ভূমিকাও সক্রিয়। এ ধরনের অবিবেচক মন্তব্য একজন ধর্ষকের মনোবল বাড়িয়ে দেয় , জন্ম হয় আরেকজন ধর্ষকের। ধর্ষণের মতো অপরাধ করে সে বা তারা ভিক্টিমের উপর আঙ্গুল তোলার সাহস পায়।

ধর্ষণ পুরুষের এক ধরনের যৌন বিকৃতি। এটা যতোটা না শারীরিক, ততোটাই মনস্তাত্ত্বিক। তার মানে এই সমাজই তৈরি করছে একেকজন ধর্ষককে। পরিবারের চেয়েও এখানে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো সময় যেকোনো বয়সী পুরুষের এই বিকৃত লালসার শিকার হতে পারে যে কেউ। রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, অফিস আদালত, এমনকি নিজের ঘরটিও আজ নিরাপদ নয়। এসব বিকৃত পুরুষের বিচরণ সর্বত্র। আর এদের জন্মদাতা পিতা-মাতা তো এই সমাজেরই বাসিন্দা। তারাও আমাদেরই মতোন।

ধর্ষণের মতো মনোবৃত্তি পুরুষের মধ্যে একদিনে গড়ে উঠে না। একজন কন্যা সন্তানকে যেভাবে চোখে চোখে রেখে লালন পালনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা যদি পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে করা হয় তবে ধর্ষকের সংখ্যা কমে আসার সম্ভাবনাই বেশি। একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সে অপরাধী হয়ে যায় না, ধর্ষকই অপরাধী। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে এই চেতনাবোধ জাগ্রত করা জরুরি। পরিবার বা সমাজ সন্তানের অপরাধী হয়ে ওঠা নিয়ে যতটা না বিচলিত, তার থেকে অনেক বেশি বিচলিত অপরাধের শিকার সন্তানটি নিয়ে। ফলে দিন দিন অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সন্তানকে যথাযথ নৈতিক শিক্ষায় মানুষ করার দায়িত্ব প্রথমত পরিবারের। এরপর সমাজ এবং রাষ্ট্রের।

একজন ধর্ষক নিশ্চয় কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো স্বামী ,কারো পিতা। তাই প্রথমে পরিবার থেকেই এসকল ঘৃণ্য অপরাধীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় সমাজও এ ধরনের অপরাধীর জন্ম দেয়। অপরাধীর পাশে দাঁড়িয়ে সবরকমের সহায়তা প্রদান করে। সেক্ষেত্রে তা প্রতিহত করার দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রের উপর। রাষ্ট্রের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর দ্রুত বাস্তবায়নই পারে এসকল অপরাধ প্রতিহত করতে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন নিজেই অপরাধীর জন্ম দেয় কিংবা অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয় তখন তার পুরো কাঠামোটাই ভেঙে পড়ে। এবং আমরা আজ সেই ভেঙে পড়ারই দ্বার প্রান্তে উপনীত।

দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি এ ধরনের অপরাধকে প্রতিহত না করা হয়, নোংরা রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বের করে অপরাধীর শাস্তির বিধান কার্যকর করা না হয় তবে অচিরেই এর খেসারত রাষ্ট্রকেই গুনতে হবে।

মুক্ত আলো বাতাসে কন্যা সন্তান বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা প্রদান রাষ্ট্রের কাছে আজ জনগণের দাবি। সোচ্চার হোক রাষ্ট্র। এটাই কাম্য…।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.