বাসন্তি সাহা:
একের পর এক ধর্ষক গ্রেফতার হচ্ছে! স্বস্তি পাচ্ছি। ভালো লাগছে। ধর্ষকদের প্রায় সবাই একাধিক মামলার আসামি ছিল। জামিন নিয়ে বেরিয়ে আবার একই কাজ করেছে। তাহলে এবারও কী? জানি না। হয়তো আবারও তারা আগেরবারের মতোই ছাড়া পেয়ে যাবে, আবারও তাদের পুনরুজ্জীবন হবে। অসহায় মানুষ চোখ মেলে দেখতেই থাকবে এইসব হায়েনার চিৎকার।
এক একটি ধর্ষণের ঘটনা শুনি আর আতঁকে উঠি। মেয়ের মুখ, মেয়ের বন্ধুদের মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। নীলার মায়ের ছবিটির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে গিয়ে কেঁপে উঠি। কত কষ্ট করে সন্তানকে একটু একটু করে বড় করে তোলা। তার জীবনের এমন পরিণতি! কী করে মেনে নেবে মা! প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে মেরে ফেললো ১৪ বছর বয়সী মেয়েটাকে। রাস্তায় তখন কি কোনো মানুষ ছিলো না? নাকি সবাই মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলো! কেউ কেনো এগিয়ে এলো না? এই বালিতে মুখ গুঁজে উটের মতো বেঁচে থাকার সংস্কৃতি আমাদের কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে??
আমরা ছোটবেলায় ধর্ষণের ঘটনা দু’একটা শুনিনি তা নয়, কিন্তু এমন প্রতিদিনকার ব্যাপার ছিলো না। ক্লাস নাইন পর্যন্ত অবাধে সকাল -সন্ধ্যা ঘুরে বেরিয়েছি। কাকা, মামাদের সাথে অবাধে মিশেছি। সবাই একরকম ভালোমানুষ ছিলো তাও নয়। তবু এতো আতঙ্ক নিয়ে আমাদের বাবা-মা আমাদের বড় করেনি। আজ কাছের মানুষের কাছেও মেয়েকে রেখে যেতে দু’বার ভাবি। আমাদের একসাথে বড় হওয়ার মুল্যবোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। একা আতঙ্ক নিয়ে বড় করছি আমাদের নতুন প্রজন্মকে।
যেই মেয়েটি হাসবেন্ড এর (তথাকথিত রক্ষক) সাথে এমসি কলেজে সন্ধ্যায় ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হলো। সেই মেয়েটি কী তার উপুযুক্ত বিচার পাবে? স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে স্বামী সন্তানদের নিয়ে। নাকি অন্য এলাকায় গিয়ে থাকতে হবে। স্বামী কী মেনে নেবে তাকে? পরিবারের অন্যরা? সামনের দিনগুলোতে মেয়েটির জন্য কী পৃথিবী অপেক্ষা করছে। একটা অপমান একটা শারিরীক নিগ্রহ তার সমস্ত জীবনটাকে ওলটপালট করে গিয়ে গেলো তার ক্ষতিপূরণ হবে কী কোনোভাবে? রাস্তায় বের হলে তার দিকে আঙুল তুলবে না এমন গ্যারান্টি দিতে পারি আমরা। আর যারা তাকে মেনে নেবে না তাদের কী শাস্তির আওতায় আনা যাবে!
আমরা ধর্ষকের বিচার দাবি করি, সেটাই করতে হবে, কিন্তু যারা মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দিলো না তাদের জন্য কী করি? তাদের জন্য কী কর্মসূচি আছে আমাদের যারা নারী আন্দোলন বা নারীমুক্তি নিয়ে কাজ করি! তাদের কী বোঝানো উচিত নয় যে শরীরে কিছু লেগে থাকে না । একবার কেবল একবার স্নান করেই ধুয়ে ফেলা যায় সব নোংরা। কিন্তু মনের অপমান, ক্ষত দূর করতে অনেক সাপোর্ট লাগে। পরিবারের সবার উচিত সেই সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে আসা।
অনেক মানুষ ধর্ষণের কথা উঠলেই নারীর পোষাক, নারীর অবাধ চলাচলের উপর দোষ চাপান। কী পোষাক ছিলো যে স্বামীর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলো যে মেয়েটি তার! নিশ্চয়ই শাড়ি বা অন্য যে কোনো সোকলড শালীন পোষাকই তো! আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আদিবাসী বোনটি, তার কী পোষাক ছিলো? কী পোষাক ছিলো নুসরাত আর তনুর। এইসব কুটতর্ক দিয়ে ধর্ষণের ঘটনাকে যারা হালকাভাবে দেখেন তাদের মনের মধ্যে এই প্রবণতা থাকা বিচিত্র নয়।
সিনেমাগুলোতে দেখানো হয় ধর্ষণ বিরাট একটি কাজ, তা কেবল ক্ষমতাবান পুরুষরাই করতে পারে। মেয়েদের দেখানো হয় শাড়ি জড়িয়ে কাঁদতে বা পায়ে পড়তে। দিনের পর দিনের এইসব দৃশ্য কয়েকটা প্রজন্মকে ধর্ষকাম করে তুলেছে। শুধু কী সিনেমা, নাটক, জোকস সব জায়গায় নারী দুর্বল ভোগের বস্তু। নারী শক্তি ও বুদ্ধিহীন সে কীভাবে রক্ষা করবে নিজেকে! তাইতো দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নারীর উপরে তার পুরুষত্ব জাহির করার জন্য।
ধর্ষণ, জবরদস্তি সেক্স পুরুষকেও যে কিছু দেয় না, এটা কেবল পাশবিক বলপ্রয়োগ একজন মানুষের উপরে, এটাও খুব বেশি করে উঠে আসা উচিত। ধর্ষণ আর যাই হোক এটা কেবল যৌনতার বিষয় নয়। এটা দুর্বলের উপর প্রয়োগ করা সবচেয়ে নারকীয় অস্ত্র। যখন একজন নারীকে হুমকি দেয়া হয় তখন সেটা খুনের বা শারিরীকি নিগ্রহের না হয়ে ধর্ষণের হুমকি হয়ে ওঠে কারণ এই সমাজে এটাই প্রতিষ্ঠিত নারীকে দমন করার এটাই সবচেয়ে বড় আয়ুধ।
প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে নারীর নিগ্রহের বহুমাত্রিকতা বেড়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধায় নিজে ধর্ষণ করে প্রেমিকাকে আরও চারজন যুবেকের হাতে তুলে দেয় প্রেমিক। একসাথে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় তারপর মোবাইল ফোনে প্রেম। প্রেম থেকে মোবাইলে প্রেমিকাকে ডেকে আনা তারপর অবারিতভাবে ধর্ষণ। ধর্ষণ কেবল একবারেই থেমে থাকছে না আজকাল। মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সেটা দিয়ে ব্লাকমেল আবার ধর্ষণ। বেশিরভাগ ঘটনাগুলো রিপোর্টেড হয় না। কত মেয়ে যে এভাবে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে তার খবরও আমরা রাখি না।
আমার এই লেখা কিছুই পাল্টাবে না হয়তো, তবে একজন মা হিসেবে কিছু করতে না পারার যে যন্ত্রণা, সেটা হয়তো কিছুটা প্রশমিত করবে। কিন্তু সবাই যদি প্রতিবাদ করি, কিছুটা তো পাল্টাবে। সবার প্রতিবাদেই তো গ্রেফতার হয়েছে ধর্ষকরা। হয়তো আইন তাদের উপযুক্ত শাস্তিও দেবে। কিন্তু ঘরে মেয়েটির যে জায়গা সেখানে আমরা সবাই কী কিছু নিয়ে মেয়েটির পাশে থাকতে পারি না? মেয়েগুলোর যে এখন মানসিক সাপোর্টের বড় বেশি প্রয়োজন, ওদের প্রয়োজন প্রফেশনাল কাউন্সেলিং। আছে কোনো প্রতিষ্ঠান, যারা এগিয়ে আসবে এই সেবায়?
ধর্ষণ তো শরীরে লেগে থাকে না মেয়ে। তাই ভাঙলে চলবে না, উঠে দাঁড়াতে হবে সেই আগের মতোন, তুমি হেসে ওঠো আগের মতো। আমরাও সবাই আগের মতোই আছি। আমরা তোমাকে বিকশিত দেখতে চাই ফুলে ফলে। মনের ক্ষত ধুয়ে মুছে যাক তোমার। আমরা পাশে আছি।
বাসন্তি সাহা
প্রকল্প পরিচালক, দর্পন