নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক:
ফেসবুকে ঢুকলে অসুস্থ লাগে। এইজন্য এই আইডি ডিএক্টিভ করে প্রায় আড়াই মাস ফেসবুকের বাইরে ছিলাম। অফিসিয়াল কাজের জন্য আরেকটা আইডি আছে তা সত্য, কিন্তু সেটা থেকে ওই অফিসিয়াল কমিউনিকেশনের জন্যই দিনে সর্বোচ্চ ১০-১৫মিনিটের জন্য লগইন করে কাজ শেষ করে আবার হাপিশ।
কিন্তু ফেসবুকের দৌড় তো ব্রাউজারে সামান্য কয়টা ট্যাব আর ফোনের আ্যপের মধ্যে সীমাবদ্ধ, চাইলেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। বাস্তবতা থেকে বের হবো কিভাবে? অফ সুইচটা কই??
গতকাল ছোটভাই সজীবের স্ট্যাটাস সযত্নে এড়িয়ে গেছিলাম। তার প্রশ্ন ছিলো এই যে পাহাড়ী মেয়েটা গ্যাংরেইপ হলো, এইটা নিয়ে সিলেক্টিভ কিছু মানুষ ছাড়া কারো কোন বিকার নেই কেন? ঘুরেফিরে কয়টা মানুষই এগুলা নিয়ে হাউকাউ করে, স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে বিরক্ত করে। বাকীদের এগুলো নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই কেন? সবাই কি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, নাকি নিজের গোত্র/ধর্ম/জাতের সাথে না মিললে এগুলো আমাদের নাড়া দেয় না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি নিজেও গত দশ বছর ধরে খুঁজে ক্ষান্ত দিয়েছি। বেশি প্রশ্ন করলে ইফতারের টেবিল থেকে কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়; সমস্যা সমাধান তো পরের কথা, সমস্যার মূল খুঁজতে গেলে ৫২দিন নিরুদ্দেশ থেকে পরে সীমান্তে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার হওয়া লাগে। কি দরকার? নিজের মত আছি, ভালই তো আছি। যেচে-পড়ে নিজের ফ্যামিলির উপর ভোগান্তি টেনে আনবো কেন? কাপুরুষের মতো পালিয়ে বাঁচতেছি, অস্বীকার করতে কোন দ্বিধা নাই। বরং কতটা কাপুরুষের মত বাইচা আছি নিচে আরো ভালভাবে বর্ণনা করতেছি দাঁড়ান।
এই প্যান্ডেমিকের কারণে সিলেট ছাড়ার আগে পাক্কা তেরো বছর সিলেটকে নিজের ঘরবাড়ি মনে করেছি, যদিও আমার পরিবারের একজনও সিলেট থাকে না। ঢাকায় আসলে দুইদিনের বেশি টিকতে পারি না, সিলেট যাওয়ার জন্য অস্থির লাগা শুরু হয়। এই একটা শহরেই নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে হয়, যদিও মাহিদ মারা যাওয়ার পর থেকে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে।
কিন্তু শুধু সিলেটেই কেন আমার নিরাপদ বোধ হওয়া লাগবে? বাকি দেশ কি দোষ করলো? প্যান্ডেমিকের শুরুর দুইমাস যখন সিলেটে আটকা পড়েছিলাম, তখন নিজেকে স্বান্তনা দিতাম অতিমারী শেষ হলে তিন সপ্তাহের জন্য কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাবো। এক সপ্তাহ থাকবো ঢাকা, এক সপ্তাহ চিটাগং, এরপর এক সপ্তাহ কক্সবাজার ঘুরে ব্যাক টু সিলেট। অনেক বছর হয়ে গেলো সমুদ্র দেখি না। মেজর সিনহা’র ঘটনার পর কক্সবাজার লিস্ট থেকে বাদ পড়েছে। ডিফেন্সের লোকজনকে মেরে যেখানে ইয়াবা মামলায় ফাঁসায় দেওয়া যায়, সেখানে আমি তো কিছুই না। কীটপতঙ্গের মত বেঁচে আছি, মরার পর তেলাপোকার মত ঘৃণিত হতে চাই না। গেলাম না কক্সবাজার, দেখলাম না সমুদ্র। আল্লাহ দিলে একদিন টাকা-পয়সা জমায় থাইল্যান্ড ঘুরে আসবোনে। এমনিতেও কক্সবাজারে এক সপ্তাহ থাকা আর বালিতে এক সপ্তাহ ঘুরে আসা প্রায় কাছাকাছি খরচ বিমান ভাড়া সহ। পাহাড়ও দেখতে যাওয়া যায়, কিন্তু সাজেকের ইতিহাস মাথায় আসলে বিবেক সাড়া দেয় না। তারচেয়ে বরং ওপারে শিলং-মেঘালয় কোন এক জায়গায় ঘুরে আসা যাবে কম খরচে। বিবেক শালাও প্যারা দিবে না।
দেশটা এমনিতেও ছোট, এইসব চিন্তা করলে নিজের কাছেই আস্তে আস্তে আরো ছোট মনে হয় দেশটাকে। ভাবমূর্তির ছোট না৷ মানচিত্রের ছোট হয়ে যাওয়াই বললাম উপরে। ভাবমূর্তি নাড়া দেওয়ার দুঃসাহস করা ঠিক না।
তারপরেও মাথায় চিন্তা আসে। আমার সাত জনমের ভাগ্য আমি বাংলাদেশে ছেলে হয়ে জন্মাইছি। একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছে দেখে ভরসা পাই কোন বিপদ-আপদে আওয়াজ দিলে কেউ না কেউ হয়তো আগায় আসবে। নাইলে কোন ভরসায় বাঁচতাম? যদি মেয়ে হতাম, সাজেক-কক্সবাজার যাওয়া তো দুরের আলাপ, এলাকার দোকানে যাইতেই দশবার চিন্তা করা লাগতো এলাকার কোন ছেলেটা দিনের কোন সময় রাস্তার কোন পয়েন্টে দাঁড়ায় আর কিভাবে তাদের নজর এড়ায়ে কেনাকাটা করতে যাওয়া যায়! আর ওই যে একটা আলাপ আছে না যে মেয়েরা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আলাপ করলেই মা’রা থামায় দেয় “বিয়ের পর জামাই নিয়ে ঘুরতে যাইস”- এইটা তো ক্লিশে হইতে হইতে মিম হয়ে মিমও পঁচে গেছে! একটা দেশের অর্ধেক নাগরিক নিজের ঘর থেকে দশ কদম বের হতে ইতস্তত বোধ করে, চমৎকার না বিষয়টা?
বাই দা ওয়ে, এমসি কলেজের ভিক্টিম মেয়েটা জামাই নিয়েই বেড়াতে গেছিলো। কক্সবাজার-সাজেক না, নিজের শহরের ভিতরেই।
তাও একদিক থেকে বাঁচোয়া, সাথে হাজব্যান্ড ছিলো দেখে কেউ ভিক্টিমের ড্রেসের দোষ খোঁজা শুরু করে নাই এখনো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো একজন আপাদমস্তক বোরকাবৃত হওয়ার পরেও হেনস্তা হলো, সেটার ভিডিও-ও ফেসবুকেই ঘুরছে। তবে সিলেটের আফটারম্যাথে ভাল লাগছে এইটা দেখে যে দল-মত নির্বিশেষে সবাই অপরাধীর বিচার চাচ্ছে।
ওহ, দল-মতের আলাপ থেকে মনে হলো, অপরাধীর কোন দল থাকে না। তার কাজের দায় শুধুমাত্র তার একার। একসময় আমিও সংগঠন করতাম। রাজনৈতিক সংগঠন না, সাংস্কৃতিক সংগঠন। মনে পড়ে গেলো ওই সংগঠন আমাকে কোন অপরাধে উৎসাহ না দিলেও সেই সংগঠনের কলেবর, আকার, ঐতিহ্য আমাকে কতটা অভয় দিতো ক্যাম্পাসে বুক ফুলায়ে চলার পিছনে। সংগঠন কেন করে মানুষ? সমমনা লোকজন একজোট হয়ে অভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করার লক্ষ্যেই তো? আমি অন্তত তাই জানতাম। রাজনৈতিক সংগঠন করি নাই তো, তাই জানি না। রাজনৈতিক সংগঠন সম্ভবত ভিন্নভাবে কাজ করে, কে জানে? নাহলে তো অঘটনগুলা ঘটার আগেই আন্দাজ পাওয়ার কথা কে অনুপ্রবেশকারী আর কে পটেনশিয়াল ক্রিমিনাল।
তবে একটা জিনিস বলতে পারি। শুধু এমসি কলেজ না, এই ঘটনা সাস্টে ঘটা সম্ভব, ঢাবি’তে ঘটা সম্ভব, বুয়েট-কুয়েট-রাবি কিংবা দেশের যেকোন মেডিকেলেও ঘটা সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদ দেন। ঢাকার রাস্তায় ফ্লাইওভারে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এয়ারপোর্ট রোডে ঢাকা ভার্সিটির মেয়েটাকে রেইপ করেছে ছিন্নমূল একটা লোক।
হ্যাঁ, আমি স্বীকার করে নিলাম ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির দায় কোন দল/গোষ্ঠীর না। ধর্ষকের পরিচয় সে শুধুই ধর্ষক, মুসলমান/হিন্দু/সেটেলার/আদিবাসী না। আপনারাও স্বীকার করে নেন তাইলে যে পুরা দেশটাই ধর্ষণের অভয়ারণ্য হয়ে গেছে। স্বীকার করেন যে ধর্ষণের জন্য আমাদের টক্সিক মিসোজিনিস্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠার দায় বেশি ভিক্টিমের পোশাকের চেয়ে। স্বীকার করেন যে মেয়েদের চলাফেরা ধর্ষণে উৎসাহ যোগাচ্ছে না, বরং মেয়েদের চলাফেরা যে ভিন্নচোখে বিচার করা লাগবে যেন তারা আলাদা একটা প্রজাতি- এমন ধ্যানধারণাই পরবর্তী দুর্ঘটনার গ্রাউন্ড তৈরি করে দিচ্ছে।
স্বীকার করবেন এগুলা? আমি আশা করি না। করলে এইগুলো নিয়ে আপনারা আরো আগেই চিন্তা করতেন, এরকম আরো হাজারটা ঘটনা ঘটেছে, আমাদের চিন্তার কোন পরিবর্তন আনতে পারে নাই। আনতে পারবে বলেও মনে হয় না। তারচেয়ে বরং আমি আবার ফেসবুক ডিএক্টিভ করে ডুব দেওয়াটাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর হবে।