জলি তালুকদারকে কেন অনশন করতে হয়?

সুপ্রীতি ধর:

জলি তালুকদারকে আমি ঠিক কতদিন ধরে বা কত বছর ধরে চিনি, মনে নেই। তবে সেটা অনেক বছরই হবে। এক্টিভিস্ট হিসেবে নিজে মাঠে নামার আগে থেকেই তার ছবির সাথে, তার বক্তৃতার সাথে আমার পরিচয় সাংবাদিকতার সুবাদে। এমন তেজদীপ্ত, বলিষ্ঠ নারী নেতৃত্ব, শারীরিক উচ্চতায়ও যেকোনো বাঙালী নারীকে যে পাশ কাটিয়ে যায়, সেই মেয়েটি কাছ দিয়ে হেঁটে গেলে একবার তাকাতেই হয়, এমন একজন আমাদের জলি তালুকদার।

‘আমাদের’ শব্দটা জোরের সাথে বলতে চাই এই কারণে যে এই সময়ে যে কয়জন নারী রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, জলি তাদের একজন। মনীষা আছেন, লাকি আছেন। এদের সবাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বারংবার স্যালুট জানাই। কারণ রাজনীতির এই বন্ধ্যা সময়েও এরা আমাদের মেয়েদের পথপ্রদর্শক হিসেবে আছেন। নিজেরা যারা চাইলেই এই পথ থেকে সরে গিয়ে ভালো একটা ‘সুশীল’ জীবনযাপন করতে পারতেন, তা না করে তারা মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। যা খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সবসময়ই এমন এমন মানুষের আবির্ভাব হয় যারা অন্যের জন্য নিজেদের জীবনের সমস্ত সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দেয়। অন্যের পাশে দাঁড়ায়।

জলির সাথে যতগুলো মিছিলে-মিটিংয়ে দেখা হয়েছে, সবগুলোই প্রগতিশীল দলের ব্যানারে। আর হয়েছে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের মিছিলে। এমনভাবে তিনি মিশে আছেন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় যে শ্রমিকরা অনায়াসেই তাকে তাদেরই একজন হিসেবে মেনে নিয়েছে, সেও বহু বছর ধরেই। ওই একটা জায়গায় আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, জলিও তাই করেছেন। কিন্তু হয়তোবা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি নিজে একজন নারী, আর নারীদের জায়গাটা সবসময়ই পঙ্কিল, যে কেউ যেকোনো সুযোগে নারীকে ডিঙিয়ে চলে যেতে পারে, অন্যেরা তখন বাহ্বা দেয়ার জন্য থাকে, সমানুভূতি জানানোর জন্য নয়।

সাম্যবাদের আদর্শে লড়তে গিয়ে নারী অধিকারও তার বিষয়বস্তু বলেই জানি। এবং খুবই বলিষ্ঠভাবেই সেই অধিকারের কথা পরতে পরতে লেখা আছে, ইতিহাসে অসংখ্য নারীর সব বাধা-বিপত্তি পায়ে ডলে এগিয়ে যাবার কথা লেখা আছে। কিন্তু জলি কি এসব জানতো না? অবশ্যই জানতো। আজই সুচিত্রা সরকারের একটা লেখায় পড়লাম যে সুচিত্রা নিজেই যখন বিপাকে পড়েছিল এমন একটি ঘটনার, তখন জলিকে সে পাশে পায়নি। কষ্ট পেলাম এটা জেনে। নিজের দলের মধ্যে যে বহু বহু বছর ধরে এমন অসাম্য লালিত হয়ে আসছে, সেটা তার উচিত ছিল আরও বহু আগেই উন্মোচন করা। এটা হলে এখন পর্যন্ত আরও অনেক মেয়েকে পাশে পাওয়া যেতো এই লড়াইয়ে। অনেকেই মাঝপথে থেমে গেছে শুধুমাত্র ‘নোংরামির’ শিকার হয়ে। সবার পক্ষে আদর্শিক এই লড়াইয়ে এসব নোংরামিকে পাশ কাটানো সম্ভবপর হয় না। তাই ঝরে যায়।

যাই হোক, জলি নিজে আজ আক্রান্ত। খবরে পড়লাম, তিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন আরেকজন সহযোদ্ধার দ্বারা, সেই কথা উনি জানিয়েছিলেন নিজের দলকে। কিন্তু সেই দল কী তদন্ত করেছে, তাতো বুঝলামই জলির মতোন বলিষ্ঠ একজন নেতৃত্বের অনশনে বসার ঘটনায়।
খুবই অনভিপ্রেত এই ঘটনা। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমাদেরই সব নেতাদের মুখচ্ছবি, যাদের আমরা মানি, বিশ্বাস করি, সম্মান করি। কিন্তু তারা কি একটিবারের জন্যও এই ঘটনাকে আমলে নেননি? সিরিয়াসলি?

সাদিয়া নাসরিন যথার্থই লিখেছেন, এদেশের সমস্ত পুরুষশাসিত প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারি দফতর, কর্পোরেট কালচার নারীর বিরূদ্ধে যেভাবে সংগঠিত, যেরকম একাট্টা হয়ে তারা নিপীড়কদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়, নিরাপত্তা দেয় সেখান থেকেই নিপিড়কদের স্পর্ধা এতো বাড়ে, এতো নির্ভয় হয় যে, তারা শক্তপোক্ত নারীদের দিতে পারে, জলি তালুকদারদের মতো পোড় খাওয়া কেন্দ্রীয় নেতাকেও মলেস্ট করতে পারে।
দিনশেষে, এই দেশ নিপীড়কের দেশ, এই সমাজ পুরুষের সমাজ। এই দেশে কোনো নারীর জন্য কোনো সুবিচার আমি আশা করি না। বিচার পাওয়ার রাস্তা এতো খানা খন্দ আর কাঁটায় ভরা যে, সেই রাস্তায় হাঁটার মতো জুতোও সব মেয়ের পক্ষে এফোর্ট করা সম্ভব নয়। সুতরাং আঘাত যার, লড়াইও তার। বাকি সব প্রতিবাদ সিলেক্টিভ। অতএব, এসব বিচার টিচার না চেয়ে মেয়েরা বরং ঢিলের বদলে নিজেই পাটকেলটা মারতে শিখুক। এবং যে নারীর ক্ষমতা আছে সে অশি মসি যা কিছু দিয়েই পারে এসব নিপীড়কের রাতদিন নরকগুলজার করে দিতে থাকুক। আমি বিশ্বাস করি, জলি তালুকদার জানেন ‘হাউ টু ফাইট ব্যাক’। আমরা অনেকেই পারি না, পারতে পারি না। জলি নিশ্চয়ই পারবেন। জলির জন্য আমার সলিডারিটি থাকলো। (ফেসবুক থেকে)

শুধু সাদিয়াই নন, আরও অনেকেই জলির প্রতি তাদের সলিডারিটি প্রকাশ করেছেন। তা করারই কথা। যে মেয়েটি বছরের পর বছর ধরে রোদ-বৃষ্টি-খরা-বন্যা উপেক্ষা করে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ছুটে গেছে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের, হাওরবাসীর মন জয় করেছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের মাধ্যমে, শ্রমিকদের নেতা হয়ে জেল খেটেছেন, সেই মেয়েটি আজ অনশনে বসেছে তার প্রতি হওয়া যৌন নিপীড়নের বিচার চেয়ে, এই দৃশ্যটা বড্ড বেমানান। আমি মানতেই পারছি না। জলিকে এমন দুর্বলভাবে কোনদিন দেখিনি, দেখবো বলেও আশা করিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, জলি উঠে দাঁড়াবে, মাথা নিচু করে থাকা তার সাথে যায় না, যে ছবিটা তার সবসময় আমার মানসপক্ষে ভাসে, সেই অঙ্গুলিনির্দেশক জলিকে দেখতে চাই। সেইসাথে এটাও চাই, প্রগতিশীল নামধারী দলগুলোর ভিতরে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি, তাদের নতুন করে আন্দোলনের পাঠ জরুরি, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের আত্মশুদ্ধি না হলে কোনোকিছুই অর্জন হবে না দিনশেষে, এটা বোঝার ক্ষমতা তারা অর্জন করুক।

জলি তালুকদারের প্রতি আমার ভালবাসা, সলিডারিটি সব রইলো।

শেয়ার করুন: