মাতৃত্ব

সুরভী হাসনীন:

১.

– খানকির বাচ্চা, এতো বছর হয়ে গেলো তাও একটা কামের কাম পারস না। পারস কী? ভাত গিলতে?

হাতের লোকমাটা মুখের ভিতর পুরে চিবোতে থাকে রেহানা। সোলায়মান এর ভাত খাওয়া শেষ। হাঁড়ি, বাসন ধুয়ে পাটা মুছে খানিকটা ভাত, ডাল ভর্তা আর মরিচ টালা নিয়ে বসতে গিয়েই হুকুম এলো পান নিয়ে বিছানায় যাবার। তার আগে সোলায়মানের পা টিপতে হবে, কোমরে নিমের বাটা ডলে ব্যথা নামিয়ে, তেল পানি দিয়ে পা মুছে দিতে হবে।

– আইলি না? তোর গিলন শ্যাষ হয় না, সব গিলা বইসস।

চোখের কোনে বাষ্পীয় জলের ক্ষীণ ধারা মুছে নেয় রেহানা। যে পানির কোন দাম নেই কারো কাছে, সে পানি ঝড়িয়ে লাভ কী? পাশের ঘর থেকে শ্বশুর তীব্র কাশছে। তার বুকেও একফাঁকে গরম তেল ডলতে হবে। শাশুড়ি বেঁচে থাকতে এই কাজগুলো তার কপালে ছিলো না। গপাগপ ভাতের শেষ দানাটা মুছে খেয়ে, হাতের তেলোর উল্টো দিয়ে প্লেট ধুয়ে পানি খেতে খেতে ডাক পড়ে সালাম মিয়ার।

– ঐ আবাগীর বেটি, তোর নাগর সোহাগ বন্ধ কইরা আমারে একটু তেল দিয়া যা। রাইতের কষ্ট সইজ্য হয় না।

রেহানা গায়ের কাপড় জড়িয়ে স্টোভ জ্বালায়। স্টিলের বাটিতে তেল গরম করে, অর্ধেকটা সোলায়মানের পিঠে ডলে। ঘুমিয়ে গেলে বাকি তেলটা নিয়ে শ্বশুরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সত্তর বছরের সালাম মিয়া এখনও হাতের পাঁচ, তিন কানি জমি রেখে দিয়েছে। সারাদিন সাইটের কাজে ইট বালুর হিসাব রাখায় দিন প্রতি একশ টাকা পায়। তাতে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর রাতে ঘরের ভাত। বিড়ি – পানের টাকা আসে ইট সরিয়ে, নয়তো রডের পিস বিক্রি করে। সোলায়মান সারা দিন সিএনজি চালিয়ে যা পায়, তার অর্ধেকও ঘরে আসে না। রেহানা নামের একটা মানুষ ঘরে থাকে, তার কথা মনে রাখার প্রয়োজন নেই। রাতে তার খোঁজ পরে শরীর সঙ্গমে।

– আহ্হা, এতো দূরে বইয়া তেল দেস কেন! কাছে আইয়া তেল লাগা। আমি কি তর পরনি! পোলায় তো ঘুমাইছে, লাথি ঝাঁটা খাস, আমি না হয় বুড়া হইছি, আশনাই কমছেনি কুনু?

– আব্বা, আপনে এমুন করলে হেরে কয়া দিমু আমি। আপনের ঘরে আইতে চাই না এই লাগি। ছাড়েন হাত, নইলে গরম তেল ফালায় দিমু।

নীরবে দ্রুত তেল ডলে ঘরে আসে রেহানা। ছয় মাসের পেটটার নিচে ব্যথা হচ্ছে খুব। পেট হয়েছে বলে তো আর স্বামীর হক মারা যায় না। সোলায়মান সেটা ঠিক আদায় করে নিয়েছে। এবারও মেয়ে হবে রেহানার। তবু তো এই বাচ্চাটা ছয় মাস বেঁচে আছে। শাশুড়ি থাকতে কোনটাই তিন মাসের বেশি পেটে থাকেনি। এবার পেট না বাড়া পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছে। পাশের বাড়ির সুফিয়া খালার জন্য এখনও সোলায়মানের ঘরে রেহানা।

নয়তো শ্বশুর আর জালিম স্বামীর অত্যাচারে অনেক আগেই গলায় দড়ি দিত। কাপড় সামলে বিছানায় উঠে আস্তে ডান কাতে শোয় রেহানা। বিসমিল্লাহ, কবুল বলে লাল শাড়িতে টুকটুক একটা বউ নতুন রিকশা চেপে স্বামীর ঘর চলেছে। হাসি মুখে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে রেহানার। স্বামী-শ্বশুর বেরিয়ে গেছে। দরজা বন্ধ করে কলোনির রাস্তা ধরে। আজও কাজে না গেলে কালকের মতো উপবাস থাকতে হবে। খালাম্মা দুপুরে ভাত দেয়। সকাল সকাল গেলে নাস্তা।

২.

– রেহানা, তোমার ভিসার কাগজ হয়ে গেলে সাত দিন সময় পাবে। এর মধ্যে ঘুরে এসো বাড়ি থেকে। সৌদিতে ভালো থাকবে। আর ওই বিষয়টা…

– আফা, আমি যামু না। যা করার এহানেই হইবো, আমার ডর লাগে আফা।

রুবা শক্ত চোখে রেহানার দিকে তাকায়। রেহানা একমনে সবজি কুটে যাচ্ছে। এ বাসার কাজ শেষে অন্য বাসায় গিয়েও রান্নার কাজ সারতে হবে। ভারী কাজগুলো ছেড়ে রান্নার কাজ নিতে এসে রুবার বাসায় কয়েক মাস ধরে কাজ করছে রেহানা। আদর-যত্ন ভালোই করে তাকে। নিয়ম করে ঔষধ, ডাক্তার দেখানো। আর ফল – ফলাদিসহ সব রকম সুযোগ। পরের কাজটা ছেড়ে দিতে বলেছে অনেকবার। তাছাড়া দেশের বাইরে গৃহকর্মী হয়ে যাবার সুযোগটা রুবাই করে দিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে থাকা ভাইয়ের সূত্রে।

শফিক – রুবার বিয়ে হয়েছে প্রায় দশ বছর। অটুট শরীরের রুবাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিলো না যে সুস্থ মেয়েটার ডিম্বাশয় সন্তান ধারণে অনুপযুক্ত। স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রেম এসেছিল দুরন্ত গতিতে। রাতগুলো ছিলো জোৎস্নামাখা, আদর জড়ানো সুন্দর। দিনগুলো ভাসছিলো পাখির ডানায়। সন্তান ধারণের ইচ্ছা জাগছিলো, তারপরের রাত-দিনগুলো দুঃস্বপ্নের জাল বিছিয়েছে দ্রুততায়।

পরিবার -পরিজন একের পর এক অপবাদে বিষিয়ে তুলেছে জীবন। রুবা অবাক চোখে চেয়ে দেখে রেহানাকে। দু’জন নারী, একই বয়স, নামের মিলেও যেন একসূত্রে বাঁধা। তবুও একজন সব থেকেও একটি সন্তানের জন্য ব্যাকুল। অন্যজন, কিছুই হয়তো নেই, তবু বছর বছর না চাইতেও দায় নিভিয়ে যাচ্ছে সম্ভোগের।

ভাত খাও ঠিকমতো। বাবুর তো গ্রোথ কম। তুমি আমার এখানে এসে থাকো। ওমন স্বামীর ঘর দিয়ে কী করবে!

রুবার প্রশ্নে চুপ করে ভাত খায় রেহানা। সোলায়মানকে ছেড়ে এখানে এলেও তার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। সোলায়মান তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। শাশুড়ি মরার আগে গ্রামের ভিটা লিখে দিয়েছিল তার নামে। সেই ভিটা বিক্রির টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনে পোস্ট অফিসে রেখেছে রেহানা। মাসিক টাকার বেশির ভাগ সোয়ালমানও পায়। বাকিটা রেহানা পাঠায় তার মায়ের কাছে। এখানে কাজে আসার পর সবটা শুনে রুবা ওকে প্রস্তাব দেয়।

– বাচ্চাটা মেয়ে হলে আমাদের দিয়ে দিও। তোমার স্বামীকে বলার দরকার নেই। বাচ্চা হওয়ানোর দায়-দায়িত্ব সব আমাদের। তুমি বলবে, মরা বাচ্চা হয়েছে। তারপর সব ঠিক থাকলে সৌদি চলে যাবে, এখানে যে কাজ করে টাকা কামাও, তার দ্বিগুণ কামাবে।

নীরবে মেনে নিয়েছিলো রেহানা। বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটাই বেশি কাজ করেছিলো তখন। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে বাচ্চাটার উপর মায়া জন্মে যাচ্ছে। সোলায়মান এখনও জানে ছেলে হবে। হাত চালিয়ে কাজ শেষে বাসা থেকে বেরোনোর সময় রেহানার হাতে মাসের বেতন দেয় রুবা।

রেহানাকে ওর ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। বার বার পেটের দিকে তাকায়। আর তিনটা মাস। এর পরই একটা নরম পুতুল ওর দুটো হাতের মধ্যে খেলবে। দরজা বন্ধ করে নামাজ সারে রুবা। ছোট ছোট জামা কাপড়গুলো বের করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শুয়ে পড়ে।

৩.

চার মাস পর…

নিজের বিছানায় পিঠে কালচে দাগ নিয়ে উঠে বসে রেহানা। ঠিক চল্লিশ দিন আগে হাসপাতাল থেকে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে সে। এতোদিন সোলায়মান সুযোগ পায়নি। পুরোটা সময় রুবার বাসায় ছিলো রেহানা। ভালো হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে প্রসবপরবর্তি সময়টা যেন বেহেশত। আরাম, যত্ন আর খাবারের কমতি ছিলো না। ভালোবাসা, মমতা দিয়ে আপা আর ভাই তাকে মুড়িয়ে রেখেছিলো।

কাল বাড়ি ফিরতেই শ্বশুর খেঁকিয়ে উঠে ফোন করেছিলো সোলায়মানকে। সোলায়মান অবশ্য রুবার বাসার দরজা থেকে ঘুরে এসেছে। মরা বাচ্চা হয়েছে শুনে খেপে রেহানাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলো। শরীফ থানা – পুলিশের ভয় দেখিয়ে আটকে দিয়েছে। কাল বাড়ি ফিরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো রেহানার উপর।

– তর হেই ভাতারের লগে থাইকা আইসস মাগী? অহন কি জ্যাতা পোলা বিয়াইবি? আয় তোর মজা মিডাই।

জোর করেই সম্পর্ক, তারপর প্রচণ্ড মারে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো রেহানা। বাড়ি ফিরে আসা, নিজের শেষ সম্বল কিছু কাপড় আর বিয়ের একজোড়া মাকড়ি নিতে। ধীর পায়ে একটা ব্যাগে সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে দরজার বাইরে পা রাখতে গিয়ে দেখে শ্বশুর ঘরের দরজা বন্ধ করছে।

– আব্বা, আপনে কী চান। এহানে কি জইন্য আইছেন?

সালাম মিয়া ঘুরে তাকিয়ে রেহানার হাতের ব্যাগ দেখে। সোলায়মান কাল যা করেছে, আজ আর বাড়ি ফিরবে না। রেহানাও অসুস্থ। এই সুযোগের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করেছে সে। সকালের সময়টায় সব কলোনির সব ঘরের পুরুষেরা কাজে, নারীরা বাচ্চা নিয়ে স্কুলে। সুবর্ণ সুযোগ, দুই দুই চার মিলিয়ে আজকে ঘরে ঢুকেছে সালাম মিয়া।

– ব্যাগ নিয়া কই যাস, পলাইতাছস নাগরের লগে?

মুখ সামলে নিয়ে বুড়োকে দেখে রেহানা। অনেকদিন আগে বউ হয়ে এসে শ্বশুরকে সালাম করার সময় যেমন জাপটে ধরেছিলো বুড়ো, তেমন টান দিয়ে সরিয়ে ছিলো শাশুড়ি। আর সাতদিনের মাথায় বুড়োকে দেখিয়ে রেহানার হাতে একটা টোঁটা দিয়েছিলো। বিছানার নিচে আজও সেটা রাখা আছে। সালাম মিয়াকে দরজা খুলতে বলে রেহানা দরজার দিকে পা বাড়াতেই বুড়ো তাকে জাপটে ধরে।

– আব্বা…

বুড়োকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রেহানা। বিছানার কাছে পৌঁছানোর আগেই বুড়ো তার পা চেপে ধরে ফেলে দেয় নিচে। হাত দিয়ে এক হাত চেপে বুকের ওপর চড়ে বসে। খোলা হাতে বিছানার চাদর টানে রেহানা। একটা সময় টোঁটার বাটটা হাতে ঠেকে। বুড়োর পিঠে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এলোপাতাড়ি ঘাঁই বসায়। বুড়োটা পাশে ঢলে পড়তেই ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। চারপাশটা শুনশান। কেউ নেই। এখন একটাই লক্ষ্য। যে করেই হোক পৌঁছতে হবে আপার বাসায়।

৪.

“রহমতগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কম্প্লেক্স” এর নতুন মেডিকেল অফিসার রুম্পা খুব বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। আজকে তার ছুটি। কতদিন পর বাবা- মা আসছে। বাসায় টিনএজার মেয়েটা বায়না ধরেছিলো চপসি খাবে। সেখানে হুট করে ইমার্জেন্সি রোগীর ডাক। ষাট বছরের এক নারী। ইউরিনাল ট্র্যাকে রক্ত যাচ্ছে বলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আসলেই ইমারজেন্সি। দক্ষ হাতে নার্সসহ ব্লাড ক্লিন করে রুম্পা। একটা আল্ট্রাসনো আর এন্টিবায়োটিক লিখে এডমিট হতে বলে ওই নারীকে।

– সাথে কে এসেছে আপনার?

– মাইয়া জামাই। খুব ভালো জামাইডা, জানেন আফা। বৃদ্ধার মুখে প্রশান্তি দেখে ভালো লাগে রুম্পার।

বাবা -মাকে স্টেশন থেকে নিয়ে এতোক্ষণে বাসায় পৌঁছে গেছে ফাহাদ। ফোনে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে কাছের বাজারে রিকশা থামায়। একজোড়া শালিক চালের দোকানের সামনে একমনে দানা খুঁটে চলেছে। মা শালিকটা কী যত্ন করে গা খুঁটছে নিজের। ছোটবেলায় পাখি দেখার অভ্যেস গড়ে উঠেছে মায়ের সাথে। মা-ই ওর বোন-বন্ধু সব। কিছু লাল শাক, দেশি মাছ আর লাউ কেনে রুম্পা। স্বাবলম্বী সে কেমন করে যেন ছোটবেলা থেকেই। দৌঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেলে নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতো। বাবা বলতো, ওর শরীরে নাকি যুদ্ধ জয়ের ধারা বইছে। সত্যিই তো, এই যে বিয়ের পর সংসার, সন্তান সব সামলে কেমন সমান তালে সফল একজন গাইনোকলোজিস্ট হবার পথে রুম্পা।

– আফা, আম্নে এহানে, কই যাইবেন। আহেন, পৌঁছায় দেই।

পেছন ফিরে তাকিয়ে জব্বারকে দেখে রুম্পা। সেই বুড়ির মেয়ে জামাই, রিকশা নিয়ে দাঁড়ানো। বাসার সামনে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে বুড়ো মহিলার খবর নেয় রুম্পা। আবার এক সপ্তাহ পর চেকাপ এর তারিখ মনে করিয়ে দেয়। বাসায় উৎসব পরিবেশে মাকে জড়িয়ে ধরে রুম্পা। মেয়ে দৌড়ে এসে মাকে জাপটে ধরে। তিন প্রজন্মের ভালোবাসার মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করে নেয় ফাহাদ। খেতে বসে ডাল ভর্তার বাটি টানে রুম্পা।

__ ওহ্ মা, কী যে মজা হয় তোমার এই ভর্তাটা। অন্য কিচ্ছু লাগবে না।

রুম্পার বাবা- মা হেসে ওঠেন। খাবার টেবিলটা এক নিমিষে পারিবারিক আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার মুখে আযানের শব্দে জানালা দরজা বন্ধ করা শুরু করেন রুম্পার মা। আযানের দোয়া পড়ে ঘরের চারদিকে ফুঁ দেন। রুম্পার মেয়েটাকে নিয়ে নানাভাই গেছেন বাসার পাশের পার্কে। নতুন জায়গা, অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে, ফাহাদও বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। অন্ধকার হয়ে গেলে পথ চিনতে সমস্যা হবে মেয়ের আর রুম্পার বাবার। নামাজ শেষে রুম্পা মাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে পার্কের দিকে।

– রুম্পা, টুপু’র এভাবে তোমার বাবার সাথে যাওয়াটা ঠিক হয়নি, রুম্পার মা রাগ করে বলে ওঠে।

– থাক না মা, কতদিন পর তোমাদের দেখলো টুপু। চিন্তা করো না। রুম্পা মনে মনে মাকে আশ্বস্ত করলেও নিজে চিন্তায় মরে যাচ্ছে। ঐ তো সামনেই ফাহাদ। আর এই পথের বাঁক ঘুরলেই পার্কের শেষ মাথা। এদিকটা হালকা অন্ধকার। দিনের আলো কমে যাচ্ছে। আজ স্ট্রিট লাইটও জ্বলেনি।

সামনেই একজন মহিলা এদিকেই হেঁটে এলো। হুট করেই যেন চোখের সামনে বাবাকে পড়ে যেতে দেখে ফাহাদ আর রুম্পা। মা পেছনে। টুপু’র দুই হাত আর গলা চেপে ধরে আছে তিনটে ছেলে। এর মাঝেই একটা ছেলে বাবাকে ধাক্বা দিয়েছে, রুম্পা আর ফাহাদ চিৎকার করে দৌড়ায় সামনে। ততক্ষণে সেই মহিলা পৌঁছে গেছে, আর হাতের লাঠি তুলে অন্ধের মতো পেটাচ্ছে ছেলেগুলোকে। টুপু’র একটা হাত খুলে যেতেই জুডোর প্যাঁচ কষে পেট বরাবর ঘুরিয়ে মারে দুটো ছেলেকে। রুম্পা নিজেও কারাতে শিখেছিলো সেই ছোটবেলায়, পাঞ্চ চালায় চোয়াল বরাবর। জ্বলে ওঠা স্ট্রিট লাইটে অবাক চোখে রুম্পার মা, তিনজন লড়াকু নারীকে একসাথে লড়ে যেতে দেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

সেদিন নিজের ঘর থেকে পালিয়ে এসে রেহানা আশ্রয় নিয়েছিলো রুবার বাসায়। ঠিক বিকেলে ফ্লাইটের আগ পর্যন্ত কাকপক্ষীও জানতে পারেনি রেহানার খবর। সৌদিতে একটানা তিরিশ বছর কাটিয়েছে, মাঝে কেবল খোঁজ নিয়েছে মায়ের আর মায়ের কাছে বড় হতে থাকা তার আরেক মেয়ের। প্রথম দু বছর রুবা নিয়মিত খোঁজ নিত। সোলায়মান আরেকটা বিয়ে করেছিলো। সালাম মিয়াও বেঁচে ছিলো বহাল তবিয়তে। এতো বছর পর দেশে ফিরে বড় মেয়ের সংসারে আশ্রয় নিয়েছে রেহানা। রুবার আগের বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছে অনেক বছর আগে বাসা ছেড়ে চলে গেছে তারা।

আজ ঠিক তিরিশ বছর পর রেহানা বাঁচিয়ে দিলো তার নাতনিকে, ঠিক যেভাবে সে নিজে লড়ে গিয়েছিলো। টুপু আর রুম্পা লড়ে গেলো তাদের রক্তে থাকা যোদ্ধার সাহসে। রাতের মেঘ সরে আকাশে গোল সোনার থালায় রাখা চাঁদের আলোয় রেহানা সোনার পাথরবাটি মুখে রুম্পাকে দেখে।

অবাক বিস্ময়ে রুবা ও শরীফের দিকে তাকায়। তার সেদিনের নরম কাঁদামাটির দলাটি নিজেই আরেকটি সাহসী সন্তানের মা। কৃতজ্ঞতায় রুম্পা, টুপু জড়িয়ে ধরে রেহানাকে। রুবা চোখের জল মোছে সঙ্গোপনে। রক্তের টান বোধহয় ফেরানো যায় না, না যায় খণ্ডানো। তিনটি প্রজন্মের মাতৃত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়া সময়ে পরিযায়ী পাখিরা নারী মুক্তির আহ্বানে ঘরে ফেরে ভালোবেসে।

(শেষ)

কবি ও লেখক
আবৃত্তিশিল্পী, শিক্ষক
ব্যাংকার (এক্স)
ই- মেল – [email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.