ধর্ষণ-বেশ্যা-জারজ-সতীত্ব!

tania morrshed
তানিয়া মোর্শেদ

তানিয়া মোর্শেদ: ‘ধর্ষণ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও অনেকে অনিচ্ছুক। কয়জন উচ্চারণ করেন, ১৯৭১-এ পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের বাংলাদেশী দোসররা ২~৪ লক্ষ্য বাংলাদেশী নারী ধর্ষণ করেছিল? ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা যেভাবে আছে (যতটুকুই আছে), কয় জায়গায় এই নারীদের কথা আছে? “বীরাঙ্গনা” নাম দিয়ে আমরা কি তাঁদের পরিবার, সমাজ, ইতিহাস কোথাও স্থান দিয়েছি না আলাদা করে দিয়েছি?

একজন মানুষকে মানুষের মর্যাদা দূরে থাক, প্রাণীর মর্যাদা না দেবার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ধর্ষণ। নারীই যেহেতু সিংহভাগ এর শিকার, তাই নারীদের কথাই বলছি, পুরুষ  ধর্ষিতদের উপেক্ষা করে নয়, মনে রেখেই। মানব জন্মের শুরু থেকেই এই জঘণ্য আক্রমণটি/ আক্রমণের সম্ভাবনা  প্রতিটি নারী শিশু বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়ান। সম্ভাবনা শুরু হয় নিজের বাড়ী/ পরিবার থেকে, এর শেষ কোনো স্থান/ দেশ আছে কি?

বাংলাদেশে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে একজন নারী এই সম্ভাবনা থেকে মুক্ত। অথচ সমাজ  কি চোখে দেখে একজন ধর্ষিতাকে? কোনো ধর্ষণের কথা জানবার সাথে সাথে শুরু হয় নানা প্রশ্ন, মেয়েটির সব কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ, নানা মন্তব্য ইত্যাদি। একবারো কি প্রশ্ন করা হয় কে/ কারা ধর্ষক, তাদের শাস্তি দেবার কি হলো? একজন ধর্ষিতাকে পারিবারিকভাবে (অনেক সময়ই), সামাজিক ভাবে আস্তাকুঁড়েতে ছুঁড়ে ফেলা হয়, ১৯৭১-এও তা  হয়েছে। তার মৃত্যুই সবার কাম্য।

বাংলাদেশেও/ বাংলাদেশীদের মধ্যেও “অনার কিলিং” আছে। “অনার কিলিং” শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পাশ্চাত্যে ধর্ষণ আছে, ধরা পরলে শাস্তি আছে। নেই প্রশ্ন, নেই চুলচেরা বিশ্লেষণ (আচরণ/ জীবন যাপন/ পোশাক ইত্যাদি বিষয়ে), নেই মন্তব্য, “কেন তুমি ঐখানে গিয়েছিলে, কেন এধরণের পোষাক পরো/ কেন এভাবে চল ……………………”।

একজন নারী অনেক বৎসর ধরে এদেশে বাস করেন, একদিন বললেন যে, এদেশের মেয়েদের পোশাক একটি কারণ ধর্ষণের! আমি বললাম, পাকিস্তান/ আফগানিস্তান/ আরব দেশগুলোর কি কারণ? কথা অন্য প্রসংগে নিয়ে গেলেন! আমার বলা হোলো না, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের নারীরা কি পোশাক পরতেন?

এই উদ্ভট চিন্তা আমার আশেপাশে অনেক উচ্চ শিক্ষিত/ প্রতিষ্ঠিত নারীদের মধ্যেই আছে, পুরুষদের কথা কী ভাববো! অথচ প্রতিটি বাবা-মা’র উচিৎ সন্তানদের (বিশেষত পুরুষ সন্তানদের) ছোটবেলা থেকে শেখানো কোনো মানুষকে তার পোশাক দিয়ে বিচার না করা। কেউ সংক্ষিপ্ত পোশাক পরলেই খারাপ হয় না/ তার সাথে কোনো খারাপ  আচরণ করবার অধিকার কারো নেই। আরেকটু বড় হলে শেখানো, কারো অধিকার নেই কাউকে ধর্ষণ করবার। কারো অধিকার নেই বান্ধবী/ স্ত্রীকে ধর্ষণ করবার। কেউ যখন ‘না’ বলে, তখন সেটিই চূড়ান্ত ‘না’।

একবার এইসব কথা এখানে  একজন বাংলাদেশী নারীকে বলেছিলাম। তিনি কয়েক পলক তাকিয়ে বলেছিলেন যে, আমার এইসব কথা অনেক  বাংলাদেশী নারীই (এখানে কি বাংলাদেশে) বুঝবেন না! তারা বুঝবেন না যে, বররাও যে স্ত্রীদের ধর্ষণ করে/ করতে পারে,  ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে বররাও যে ধর্ষক তা! পুরুষরা বোঝা তো আরো পরের কথা! আমার প্রশ্ন আর কত পরের কথা? আমরা রকেট সায়েন্স বুঝি/ আমরা ব্রেইন সার্জারি বুঝি/ আমরা কেউ কেউ এগুলো করেও থাকি, অথচ আমরা  নারীদের পূর্ণ মানুষের অধিকার বুঝি না/ বিশ্বাস করি না!

আমরা কথায় কথায় বিভিন্ন অধিকারের আন্দোলন করি অথচ মা/ বোন/ স্ত্রী/ বান্ধবী/ কন্যা সন্তান/ অচেনা যে কোনো নারীর অধিকারের বেলায় নীরব থাকি!

আমরা দিল্লীর মেয়েটির  জন্য কাগজে/ ফেইসবুকে কিছু প্রতিবাদের কথা লিখি (অবশ্যই লিখবো) আর নিজের জন্মভূমিতে একই সময় ঘটে যাওয়া আদিবাসী মেয়েটির বেলায় একটি কথাও বলি না! কেন আমরা প্রতিটি ধর্ষিতার জন্য রাস্তায় নামি না? কেন ধর্ষকদের পরিচয় জানতে চাই না? কেন ধর্ষকদের পরিচয় জানবার পরও বিচার চাই না/ পাই না/ করি না?

যে কোনো মানুষকে গালি দিতে গেলেই বেশীর ভাগ মানুষ “বেশ্যা”, “জারজ” এই শব্দ দু’টি উচ্চারণ করেন, কেন? আমার প্রশ্ন খবর নিয়ে দেখেছেন কেউ যে, কয়জন ইচ্ছে করে জারজ হয়েছে? কয়জন ইচ্ছে করে বেশ্যা হয়েছে? ইদানীং প্রায় সবাই একটি শব্দ ব্যবহার করেন “বুদ্ধিবেশ্যা”।

দয়া করে অন্য শব্দ খুঁজুন, আবিষ্কার করুন! বেশ্যা বললে আপনাদের চোখে কি ভাসে জানি না, আমার চোখে ভাসে একজন চরম অসহায় নারী যার যাবার আর কোনো জায়গা নেই, বেঁচে থাকবার জন্য তাকে এই রাস্তায় আসতে হয়েছে, কখনো তার সন্তানদের/পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আসতে হয়েছে, কখনো ধর্ষিত হবার অপরাধে পরিবার/সমাজচূত হয়ে আসতে হয়েছে, কখনো দালালের খপ্পরে পরে আসতে হয়েছে, কখনো প্রেমিকের প্রতারণার কারণে আসতে হয়েছে …………! কিসের জন্য/কাদের বাসনা পূরণের জন্য নারীরা বেশ্যা হয় একবার ভেবে দেখেছেন?

বেশ্যা ছাড়া পৃথিবী চলে না আর গাল দিতে গেলে “বেশ্যা” ছাড়া আর শব্দ খুঁজে পান না। ১৯৭১-এ যে ২~৪ লক্ষ মা/বোন ধর্ষিতা হয়েছিলেন তাদের সবাই কি আত্মহত্যা করেছিলেন? সমাজ/পরিবার কয়জনকে মেনে নিয়েছিল? কয়জন নারী পুনর্বাসনের সহায়তা পেয়েছেন? এঁদের মধ্যে কারো কারো যে অন্ধকার গলিতে ঠাঁই হয়নি তা জোর দিয়ে বলতে পারেন? (রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর (মিছিল) পড়ে দেখেন)।  নারী (শিশু থেকে শুরু করে) কেন বেশ্যা হয় তা ভাবুন। একটি শিশু কেন জারজ হয় ভাবুন। “বেশ্যা”, “জারজ”, “সতীত্ব” এগুলো আমার কাছে চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিক শব্দ!

লেখক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.