ফরুজানদের জীবনে সুখ, দুঃখ আর মহামারী

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে গত ১৪ জুলাই, ২০২০ প্রকাশিত ইরানি-কানাডিয় আলোকচিত্রী ও সিনিয়র TED ফেলো কিয়ানা হায়েরি রচিত ‘She Went to Prison for Killing Her Husband. The Pandemic Set Her Free’ ফিচারটির ভাষান্তর। এর মূল লেখক কিয়ানা হায়েরির সাথে যোগাযোগ করে তার পূর্ণ অনুমতি নিয়েছেন অনুবাদক তাসবীর ইফতেখার

তাসবীর ইফতেখার:

আফগানিস্তানের এক গহীন কারাপ্রকোষ্ঠের পাথুরে খাঁজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল কয়েকটি নারীকন্ঠ। এরই মাঝে শোনা যাচ্ছিল ফরুজানের কন্ঠস্বর। ছিল আরও একজন ফরুজানের ‘মায়ের মতন’ কন্ঠ। আর তারপর, আরেক ফরুজানের নিস্পৃহ গলার নিরর্থক বাক্যবিনিময়। মিহি, সুরেলা গলায় একজন ফরুজান হয়তো আফসোস করছিলেন, দুপুরের খাবারে আরেকটা রুটি কেন বাড়িয়ে দেওয়া হয় না। তার জবাবে ঈষৎ বয়োজ্যেষ্ঠা, ভারী কিন্তু কৌতুকপূর্ণ কন্ঠের আরেক ফরুজান জবাব দিচ্ছিলেন, ‘অন্তত মুটিয়ে যাওয়ার ভয় থেকে তো রেহাই পেলি!’ হেরাতের বিশেষায়িত কারাগারের ছাদে পুব থেকে ক্রমশ পশ্চিমে হেলে পড়া আফগান মরুসূর্যের খেলা দেখতে দেখতে এমন অন্তত ২০ জন ফরুজান সেদিন নিজেদের মধ্যে এসব খুনসুটি নিয়ে মেতে ছিলেন। সহস্র কথার এক কথা হয়ে সহসা ছাপিয়ে উঠছিল তাঁদের ‘বন্দী হয়েও মুক্ত’ থাকার উচ্ছাস, শেকল পরেও ডানা মেলতে পারার কৃতজ্ঞতা।

মে মাসের এক সকালে কিছু কেনাকাটা করার জন্য ফরুজান তার মায়ের বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন বাজারের উদ্দ্যেশ্যে। সেই সকালের আগ পর্যন্ত হেরাতের ব্যস্ত সড়কে শেষবার তার পা পড়েছিল ছয় বছর আগে। পশ্চিম আফগানিস্তানের সরগরম নগরী এই হেরাত, যে জনঅরণ্যে আরও একবার মিশে যাওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে নিয়ে ফরুজান গুনে চলেছিলেন কারামুক্তির পথে বাকি একেকটি দিন। কিন্তু যখন সত্যিই সেই দিনটি পার হয়ে গেল, বিক্ষিপ্ত, বিব্রত পায়ে বাজারের পথে চলতে চলতে ফরুজান আবিষ্কার করলেন, এক অদ্ভুত আতঙ্ক প্রতি মুহুর্তে তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে। ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো আর এদের একজন নই। কয়েদীর ভারী পোশাক যেন এখনও আমার শরীরের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কারাবন্দী দিনগুলোতে আমি সারাক্ষণ স্বপ্নে বিভোর থাকতাম – দেওয়ালের ওপাশের স্বর্গটাকে যদি আরেকবার ফিরে পাই! যদি আরেকবার ওই স্বর্গবাসীদের মন ভরে আলিঙ্গন করতে পারি! কিন্তু ঠিক যখনই সেই অধরা স্বর্গ আমার হাতে ধরা দিল, আমি যেন তার ভারে কেবলই ন্যুব্জ হয়ে পড়লাম!’

ফরুজানের পরিবার যখন তার বিয়ের আয়োজন করেছিল, তখন সে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। পাত্রের বয়স ছিল তার চাইতে পঁচিশ বছর বেশি। যথাসময়ে ধুমধাম করে সম্পন্ন হয় কন্যাদান, আর তারপর ফরুজানের জীবনে নেমে আসে দীর্ঘ পনেরো বছরের এক নৃশংস, অন্ধকার অধ্যায়। স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ফরুজানের নিষ্পাপ, স্বচ্ছ কাঁচের মত হৃদয়ে ক্রমশ চির ধরতে থাকে। তারপর এক সকালে, সবগুলো ফাটল ভেঙে ছুঁচালো আঘাতে হৃদয়ের ফিনকি দিয়ে রক্তধারা বইয়ে দিলে, ফরুজান দুহাতে তুলে নেয় একটা বেলচা। তার স্বামী তখন তাঁদের দুই শিশুকন্যার একজনকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে। একটা জোরালো আঘাতে প্রথমে সে মাটিতে শুইয়ে দিল পশুর মতন তেড়ে আসা স্বামীকে। তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লোকটাকে মারতে লাগলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার দেহের নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

ফরুজান সেদিন পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি। বরং যখন পুলিশ তাঁকে হাতকড়া পরাতে আসে, ফরুজানের এগারো-বারো বছর বয়েসী ছেলে মাকসুদ এগিয়ে এসে বলে, সে-ও তার বাবার হত্যাকান্ডে তার মাকে সাহায্য করেছে। পরিণাম – হত্যা মামলার আসামী করে ফরুজানকে ১০ বছরের জন্য কারাগারে প্রেরণ করা হয়, আর পরবর্তী আড়াই বছরের জন্য মাকসুদের ঠিকানা হয় এক কিশোর পূনর্বাসন কেন্দ্র। ফরুজানের দুই মেয়ে মোজদাহ এবং মাহতাবকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

হেরাতের উইমেন প্রিজনে এমন আরও অসংখ্য ফরুজানের দেখা মিলবে। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ স্বামীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। তাঁদের অতীত জীবনে ছিল না কোনও বিলাসিতা। ছিল না আহামরি কোনও উচ্চাকাঙ্খা কিংবা স্বামীর কাছে কোনও অন্যায্য অভিলাষের বায়না। স্ত্রী-সন্তানের ওপর আফগান পুরুষদের যখন তখন চড়াও হওয়ার চিরায়ত অভ্যাসের বিরুদ্ধেই শুধু ছিল তাঁদের অভিযোগ। সেই অভিযোগের পাহাড় জমতে জমতে, চোখের পানি শুকোতে শুকোতে একসময় ফরুজানদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। আত্মরক্ষার্থে বা সন্তানদের বাঁচাতে গিয়েই এই নারীদের প্রায় সকলে তাঁদের স্বামীকে হত্যা করতে বাধ্য হন। এ ধরণের অপরাধের জন্য হেরাতে সাজা কমিয়ে আনার কোনও নজির নেই, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, হেরাত কারাগারের এই নারীরা তাঁদের সাজা কমে আসার কোনও প্রার্থনাও করেন না। বন্দীত্বের প্রথম কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করেন যে, এই কারাগারের চার দেয়াল আর মোটা গরাদের ভেতরেই গড়ে উঠেছে স্বাধীনচেতা, অপরাজেয় নারীদের অংশগ্রহণে এক অনন্য যৌথ পরিবার। যে পরিবার তার প্রতিটি সদস্যকে প্রতিদিন নতুন করে যোগায় সাহস, বলে – ‘ফরুজান! তুমি ভয় পেয়ো না, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও! তুমি তো স্রোতে ভেসে যাওনি। বরং তুমিই পেরেছিলে রুখে দাঁড়াতে। তবে তোমার কীসের ভয়?’

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব জেঁকে বসতে আরম্ভ করলে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সিদ্ধান্তে বেশ কিছুসংখ্যক নারী, কিশোর ও অসুস্থ কয়েদীকে সাজার মেয়াদ পূরণের আগেই মুক্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়। মূলত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। নির্বাচিত বন্দীদেরকে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল তাদের মালপত্র যা কিছু রয়েছে তা নিয়ে কোর্টইয়ার্ডে অপেক্ষা করতে। সেদিনের সেই অগণিত পিপাসার্ত চাতকের সারিতে একটি চাতক ছিল আমাদের ফরুজান। কিন্তু পোড়া কপাল, কয়েক ঘন্টা যেতে না যেতেই প্রিজন ম্যানেজারের কঠিন নির্দেশ এলো – ‘হিসেবে কোথাও একটা গড়মিল হয়ে গেছে। আজ আর কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না।‘ কল্পনার রাজ্যে এরই মাঝে মোজদাহ আর মাহতাবদের সাথে পুতুল খেলায় মেতে ওঠা ফরুজান তখন এক ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে এসে বুঝতে পারলেন – নিরাশার চাইতে আশাভঙ্গের কষ্ট শতগুণ বেশি।

এর পরদিন গোটা কারাগারে যেন তাণ্ডব নেমে এলো। রাগে, ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে পড়া একদল বন্দীর হামলায় চুরমার হয়ে গেল কারাগারের দরজা জানালা। কিশোর বন্দীদের খেলার মাঠ আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আর এসবের মাঝখানে আহত অন্তত এক ডজন কয়েদীকে ভর্তি করতে হলো হাসপাতালে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ কয়েদীদের উন্মাদনা পুরোপুরি থামানো গেলো না। ভাঙা কাঁচের টুকরো হাতে খোদার কসম কেটে কেউ কেউ নিজেকেই রক্তাক্ত করলেন, আর কেউ বসে পড়লেন আমরণ অনশনে। যাকে একবার মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর আর কোন সান্তনা পুরষ্কারই বা তার মন ভরাতে পারে?

তবে ফরুজানের আকাশের অন্ধকার মেঘ শীঘ্রই কেটে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি ভোরের আলো সহাস্যে ঘোষণা দিল, ‘ফরুজান! আজ তোমার মুক্তির দিন!’ সরকারি নিয়ম জারি হলো – কারাবাসের বকেয়া মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট হারে জরিমানা পরিশোধ করার সাপেক্ষে আবার হেরাতের রাজপথে ফিরতে পারবে নির্বাচিত বন্দীরা। অদৃশ্য ভাইরাস প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেঁচে থাকা বন্দীদের জীবন প্রতি মুহুর্তেই সংকটাপন্ন। বরং এই সুযোগে কিছুটা অর্থ যদি আদায় করে নেওয়া যায়, তাতে উভয় পক্ষেরই লাভ। অতঃপর মে মাসের ১১ তারিখে, ধারদেনা করে জোগাড় করা এক হাজারের ডলারের কিছু বেশি অর্থের জরিমানা পরিশোধ করে, আরেকবার নিজ সন্তানদের কাছে ফিরে গেলেন আমাদের ফরুজান।

‘যে ভাইরাস অনেকের জীবন কেড়ে নিয়েছে, সেই ভাইরাসই আমাকে দিয়েছে আমার নতুন জীবন’, ফরুজানের কন্ঠে কৃতজ্ঞতা। মোজদাহ আর মাহতাবের মুখেও বহুদিন পর আবার ফুটে উঠেছে হাসি। ‘গত দুটো মাস আমাদের জীবনে নরকের দুর্যোগ নেমে এসেছিল। আমরা স্কুলে যেতে পারিনি, বাড়িতে দাদিমার কাছে ফিরতে পারিনি। গোটা মাসে কেবল একবার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ পেতাম। মনে হচ্ছিল, যেন বাইরে থাকা স্বত্তেও আমরা নিজেরাও এক অদৃশ্য কারাগারে ঢুকে পড়েছি,’ তের আর পনের বছর বয়েসি দুই বোনের কান্না জড়ানো স্মৃতিচারণ।

আমাদের ফরুজান তার মেয়েদের সাথে এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে সত্যি, কিন্তু পুরুষশাসিত আফগান সমাজে এখনও প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে এমন অসংখ্য ফরুজান। কারাগারের বন্দী দিনগুলোতে সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করে অল্প কিছু আয় করতেন ফরুজান। কিন্তু মুক্তির পর তার সেই আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। মহামারীর ছোবলে অসংখ্য খেটেখাওয়া আফগান তাদের চাকরি হারিয়েছেন। তাই মেয়েদের হাসিমুখ ফিরে পেলেও তাদের অন্ন-বস্ত্র জোগানের চিন্তা এখন ফরুজানকে ভাবিয়ে তুলছে।

মাকসুদ বর্তমানে অবস্থান করছে জার্মানিতে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রায় তিন বছর কাটিয়ে ছাড়া পাওয়ার পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মাকসুদ প্রায় পায়ে হেঁটে জার্মানিতে পৌছায়। এক দালালের মাধ্যমে মাকসুদকে সেখানে পাঠিয়ে দিতে গিয়ে ফরুজান তার সঞ্চয়ের প্রতিটি পাইপয়সা শেষ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু জার্মান সরকার তার আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। ধারণা করা যাচ্ছে যে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হবার পর মাকসুদকে নিজ দেশ আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু সমাধানের দিকে এগুচ্ছে মনে হলেও বাস্তবে ফরুজান এখনও প্রতিদিন অনুভব করতে পারেন অতল অনিশ্চয়তা। মৃত স্বামীর পরিবারের লোকজন তাঁকে এখন নজরদারিতে রাখছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। যেকোনও সময় প্রতিশোধের বলি হতে পারেন তিনি, অথবা তার ফুলের মতন দুই কিশোরী কন্যার যে কেউ।

যার জীবন আগে থেকেই এতো শত বাধায় জর্জরিত, করোনাভাইরাস নতুন করে তার অন্তরে তেমন কোনও ভয় জাগাতে পারেনি। এখন ফরুজানের দিন কাটছে একহাতে একটা নতুন সংসার গোছানোতে মন দিয়ে। ‘সেদিন মেয়েটা শুধু বলেছিল এক দৌড়ে নিচ থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে আসবে। অতটুকুন আবদার, অথচ দোকানে যাওয়া আসার পথে কত ভাইরাস, কত মানুষরূপী পশুর লোলুভ দৃষ্টি আর কত নিন্দুকের সমালোচনা অপেক্ষা করছে, সেকথা ভেবে এই মায়ের মন কেমন করে কেঁপে উঠেছিল – হয়তো বোঝাতে পারবো না। কারাগারের চার দেওয়ালের ভেতর আমার সামনে লক্ষ্য ছিল কেবল একটাই, বেরিয়ে আসা। আর এখন যখন বেরিয়ে এসেই পড়েছি, সহস্র দায়িত্বের বোঝা আমার একার কাঁধে এসে জুটেছে। এটাই হয়তো নারী হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার একমাত্র পুরষ্কার।‘

ছবিগুলো তুলেছেন  মূল লেখক কিয়ানা হায়েরি, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

মূল লেখাটির লিংক নিচে দেয়া হলো –

https://www.nytimes.com/2020/07/14/magazine/afghan-women-prison-coronavirus.html?

শেয়ার করুন: