আব্বে সমীরণ, আস্তে কতা ক…, দেয়ালেরও ভি কান আচ্ছে…

তানিয়া সুলতানা:

সমীরণ চিৎকার করে যাচ্ছে…। এ চিৎকার সমীরণের অপমান হওয়ার, প্রতিশোধের চিৎকার। তার দুর্বলতা ঢেকে, অসহায়ত্ব ঢেকে তার অপমান হওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে চিৎকার বেছে নিয়েছে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সমীরণ। পঁচিশ বছরের সংসার জীবন, দুটো সন্তানের মা সে। সংসার করতে করতে সন্তানের মা হওয়া। পড়ালেখা শেষ করা বা চাকুরি কোনটাই তার সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই স্বামীর অত্যাচার এবং দুবার মানবাধিকারে সালিশ- বিচার হয়ে সমীরণ জয়ী হয়েই এসেছে। এরপর কিছুদিন সমীরণের মনে সমীরণ বয়ে যায়।

তার প্রতি স্বামীর আলাদা ভালোবাসা- যত্ন তৈরি হয়। কিন্তু হায়, কুকুরের লেজ কি এতো সহজে সোজা হয়! স্বামীর চরিত্র ক’দিন ভালো গেলেও আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। সমীরণ মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে। তার স্বামী তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই গালি। তরকারিতে লবণ একটু বেশি হলেই যা ইচ্ছে তাই বলবে। টেবিলের চারদিকে লবণের বাটি খুঁজে নিয়ে এক বাটি লবণ পুরো তরকারির মধ্যে ঢেলে দিবে। তারপর বলবে, “এবার খা, কত লবণ খাবি?” ভাত যদি একদিন নরম হয়ে যায়, “সেই ভাতের মধ্যে হাত দিয়ে ভাতকে ভর্তার মতো চটকে বলবে, ‘নরম ভাত খাবি, এবার খেয়ে নে’।” একবার পোলাওতে ঘি কম হওয়ায় খাবার ফেলে উঠে গেলো।
তার স্বামীর অনেক রাগ। রেগে গিয়ে বলবে, “শরীরের বিষে সে মরে যাচ্ছে।” সমীরণ হেসে বলে, “কীসের এতো বিষ তোমার? কোন অপরাধ হলো আমার?”
সমীরণের হাসি দেখে তার স্বামীর সহ্য হয় না। চিৎকার করে বলে উঠে, “রঙ্গে আছো? এতো হাসি কীসের?” সমীরণ এখন হাসতেও ভুলে গেছে। সংসার টিকিয়ে রাখতে দুটো বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে তার স্বামীর ইচ্ছাতেই হাসে।

বিয়ের পর থেকেই তার প্রতি স্বামীর সন্দেহ। সন্দেহ রোগে নিজেও শান্তিতে থাকেনি, সমীরণকেও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। বাইরে বের হলে ধমকের উপর রাখে। এটাই তার পুরুষত্বের ক্রেডিট। রিকশাওলার সামনে ধমকাবে। দারোয়ানের সামনে ধমক। ঘরের কাজের লোকের সামনে ধমক। ঘরে কোনো মিস্ত্রি কাজ করতে এলে তাদের সামনে ধমক। দুটো বাচ্চার সামনে অকথ্য গালাগাল।

সমীরণের অনেক দোষ। সমীরণ কিছুই জানে না, কিছুই পারে না। কোনো যোগ্যতা নেই তার। তাকে কোথাও কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় না। কারণ তার সব কথাই ভুল।

সমীরণ বলে, “গালাগাল না দিয়ে কথা বলা যায় না? যেটা ভুল আস্তে করে আমায় বলো, আমি শুধরে নেই।” একথা বলতেই বলে ওঠে তার স্বামী, “তোর কোন নাঙ সুন্দর কথা কয়, তার কাছে চলে যা।” সন্তানদের সামনে সমীরণ প্রথম প্রথম চুপ করে সহ্য করলেও এখন আর তার সহ্য হয় না।
সমীরণ একটা বয়সে দাঁতে দাঁত চিপে সব সহ্য করেছে। সে ভাবতো, বয়স হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ছেলেমেয়ে বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বয়সের ভারে স্বামীও হয়তো আরো সংযত হবে।
যে বয়সের কথা ভেবে সমীরণ নিজেকে নিজে বোঝাতো, এখন সমীরণ সেই বয়সেই দাঁড়িয়ে।

নাহ্, কিছুই পাল্টায়নি। বরং নোংরা ভাষায় আঘাত আরো বেড়ে গেছে। এরপর ছেলের বউয়ের সামনে অপমান। মেয়ে- জামাইয়ের সামনে অপমান হতে বাকি আছে। আরো কত অপমান বাকি?

এখন সমীরণের আর কোনো বয়সের সুখের স্বপ্ন দেখার সময় নেই। তাঁর সব স্বপ্নেরা মরে গেছে। তার এখন একটাই স্বপ্ন, মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বাঁচা। কিন্তু যে সম্মান সে এতোদিন পায়নি, তা এই চল্লিশে এসে কীভাবে অর্জন করবে?

স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে সে, কিন্তু কোনোদিন ঘরের চৌকাঠ পার হয়নি। এতো বড় পৃথিবীতে তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এদেশের সমাজ ব্যবস্থা সমীরণকে বিকলাঙ্গ করে রেখেছে। সে ভাবে আজ ঘরের বাইরে গেলে, কাল রাস্তায় দশ দিক থেকে শিয়াল- কুকুরেরা ছিঁড়ে খাবে। তাই একজনের অত্যাচার মাথা পেতে নেয়াই ভালো। অন্তত শ্যাম না থাকলেও কুল রক্ষা তো হলো তার!

এ ভাবনা তার পরিবার তার সমাজ শিখিয়েছে। গলা চেপে ধরেছে প্রথমেই তার মা। স্বামীর নোংরা বাজে কথার উত্তর দিতে গিয়ে চিৎকার করে সমীরণ। তখনই তার মা বলে উঠে, “আব্বে সমীরণ, আস্তে কতা ক, দেয়ালেরও ভি কান আচ্ছে…।” একবার তার ভাই এসে সমীরণের স্বামীকে কিছু না বলে সমীরণকে গম্ভীর গলায় বলে যায়, “সাবধানে কথা বলো, দ্বিতীয়বার কোনো চিন্তাও করো না। তোমার পরে আরও তিনটা বোন আছে, তাদেরও বিয়ে দিতে হবে।”
সমীরণ সেই থেকে চুপ করেই সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। তার স্বামীর অনেক সমস্যা থাকার পরেও সংসার সে ছাড়েনি।

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সংসারে প্রাণ দিতে যেয়ে বুঝি নিজের জীবনই শেষ হলো! তাতে কী হলো? ছেলেটা বড় হলো, হয়তো বাবার মতোই হবে। আর মেয়েটা শিখে গেলো মায়ের মতো সহ্য করতে হবে! অচেতন মনে সংসার থেকে শিখে নিল তাদের পরবর্তী জীবনের শিক্ষা!

সব শুনে মনে হলো স্বামী Inferior complex এবং superior complex- এ ভুগছেন।
দুটো সমস্যাই তার মধ্যে আছে। তাই বউকে যা তা বলে মাটির সাথে মিশিয়ে রাখতে চায়। দশ জনের সামনে যেন মাথা উঁচু করে কথা না বলতে পারে। এতো ছোট করে রাখবে, অথচ ডিভোর্সও দিবে না! আশ্চর্য সম্পর্ক!
একবারও কি ভদ্রলোকের মনে হয় না যে সে যাকে অপমান করছে, তিনি তার স্ত্রী! তার সন্তানের মা। তাকে অপমান করলে কী ভদ্রলোকের সম্মান বাড়ে না কমে?

আমি সমীরণকে একটা উদাহরণ দিয়ে বললাম, এই যে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি যখন লাইভ বক্তব্য রাখেন, সেটা ফেসবুকে প্রচার হয় এবং সারা বাংলাদেশের কত শত পুরুষেরা কত যে নোংরা ভাষায় গালি দেয়, তা মুখে আনাও যায় না। আমি নিজে পড়েছি সেই গালি। কিন্তু ম্যাডাম সেগুলি কানে তোলেন না।

নিজেকে প্রবোধ দাও সমীরণ, “যে দেশে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী পুরুষের স্ল্যাং ভাষা থেকে মুক্তি পায় না, সে দেশে তুমি একটা ঘর সামলাতে যেয়ে এগুলো শুনবেই। অতএব Ignore….Ignore…..Ignore….”।

30- 08- 2020

শেয়ার করুন: