উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক: বিদেশে কাজ করতে যাওয়া অনেক নারী শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এদের একটি বড় অংশই যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
বিবিসি অনলাইনে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
সম্প্রতি কাতার থেকে ফেরা দু’জন নারী শ্রমিকের শরীরে নির্যাতনের নানা ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। তাদের দাবি, দেশটিতে গৃহকর্মীর দায়িত্ব পালনের সময় এবং পরে রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকর্তাদের হাতে তারা নির্যাতিত হয়েছেন।
বেসরকারি একটি সংস্থার অনুরোধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখা ‘সিআইডি’ এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে বলেও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কাতার থেকে ফেরা ফরিদপুরের কুলসুম আক্তার নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, দেড় মাস আগে গার্মেন্টসে কাজের কথা বলে তাকে পাঠানো হলেও তার কাজ হয় গৃহকর্মী হিসেবে। কিন্তু মালিকের বাড়িতে অন্যান্য পুরুষ সদস্যের অশোভন আচরণের কারণে টাকা পয়সা খরচ করে কাতার যাওয়ার দেড় মাসের মাথায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তিনি।
তিনি বলেন, “মালিকের শ্যালক হাত ধরে টানাটানি করে এবং আমি একটা থাপ্পড় দেই। এছাড়া মালিকের পাঁচজন ছেলে, রাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে দিতো না তারা। তারা বারবার এসে বিরক্ত করে। এক দুই ঘন্টাও ঠিকমত ঘুমাতে পারি না।”
ফিরে আসতে এজেন্সি অফিসে গেলে সেখানেও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে। তিনি জানান, শুধু গৃহকর্তার বাড়িতেই নয়, ফিরে আসার অপেক্ষায় আটদিন এজেন্সি অফিসে থাকাকালেও প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
এজেন্সি অফিসারাই বেশি নির্যাতন করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এজেন্সি অফিসাররা সেখানে ব্যাচেলরদের মতোই থাকে, তারা বেশি নির্যাতন করে। এমনকী অফিসের নারী কর্মীদের দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়।”
স্বামী উপার্জনে অক্ষম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আছিয়া বেগম পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে কাতারে যান ঈদের কয়েক দিন আগে। একই ধরণের ঘটনার শিকার হতে হয়ে তাকেও। নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায় তার শরীরেও। এর আগে ওমানেও কাজ করেছেন তিনি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মারধরের কারণে তার ডানপাশের চোখটিতে জমাট হয়ে রয়েছে রক্তের দাগ।
তিনিও জানান স্থানীয় এজেন্সি অফিসে নির্যাতনের কথা।
দুজনের কেউই নিজেদের উপার্জিত টাকা পয়সাও ফেরত আনতে পারেন নি বলেও জানায় তারা।
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী নারীরা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও বিষয়টিতে সেখানকার দূতাবাস অফিসগুলোর কার্যক্রম অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় না।
সালমা আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের মেয়েরা যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। প্লেস অব অকারেন্সটা এখানে একটা বিষয়। সেখানে সেই দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা যদি সেরকম না থাকে আর এম্ব্যাসি যদি ভূমিকা না নেয়, সেখানে যদি তাদের অ্যাকসেস না থাকে, সেগুলো মনিটর করা না হয় তাহলে এগুলো চলতেই তাকবে। এগুলো কিন্তু আমরা অনেকবার বলেছি। তারপরও সেভাবে কিছুই করা হচ্ছে না।”
বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কাতারে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে। কিন্ত তারপরও তারা বলবে আমরা তো কিছু জানিনা।
এই দুই মহিলার বিষয়টি বর্তমানে সিআইডির কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন।
এদিকে এসব নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে এবং তাদের কর্মস্থলে সুরক্ষার ব্যপারে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কতটা যত্নবান? প্রশ্ন করা হলে বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “সরকার অনুমোদিত কিছু এজেন্সি মূলত নারীদের বিদেশে কাজের জন্য পাঠাচ্ছে যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই এবং দুই প্রান্তে বিষয়টি সঠিকভাবে তদারকিও করা হচ্ছে না। আমাদের মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটিং এজেন্সিকে এই নারী শ্রমিকদের পাঠানোর কাজ দিয়েছে কিছু অতিরিক্ত সিক্যুরিটি মানি নিয়ে। দুই দিকেই যদি জবাবদিহিতা থাকতো তাহলে এই সমস্যা হতো না।”
এদিকে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তারা যথেষ্ট তৎপর বলে দাবি করেন জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ইমিগ্রেশন বিভাগের পরিচালক আব্দুল লতিফ খান।
তার দাবি, কর্মীদের পাঠানোর আগে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য কিছু ফোননাম্বারও দেওয়া হয়। যদিও বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন।
যে দেশে যাচ্ছে সেদেশে দেখোশোনার দায়িত্ব লেবার অ্যাটাশের বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে এইসব নারীকর্মীরা তাদের অভিযোগগুলো নিয়ে পৌছাতেও পারেন না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নির্যাতনের খবর পেলে নিশ্চয়ই তারা ব্যবস্থা নেবে।
বর্তমানে সরকার হংকং থাইল্যান্ডসহ নতুন যেসব দেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
যদিও ফিরে আসা এই দুই নারী জানান, তাদের মতো আরো কয়েকজনকে তারা দেখেছেন এজিন্স অফিসে নির্যাতনের শিকার হতে এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।