সাদিয়া সুলতানা:
যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ বা আচরণ বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষের ধারণাই বেশ গতানুগতিক। আমরা অনেকেই ভাবি একটি নারী শরীরে শিশ্ন অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা বা অনুপ্রবেশ করানোই হলো যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ। কোনো প্রকার আইনি ব্যাখ্যা ছাড়াই এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমার বোধ, বুদ্ধি আর বিবেচনা দিয়েই আমি উপলব্ধি করি যে এটা আমাদের ভুল ধারণা।
কোনো নারীকে তার সম্মতি ছাড়া বা জোরপূর্বক শারীরিকভাবে স্পর্শ করলেই কেবল তাকে যৌন হয়রানি করা হয় না। শরীর স্পর্শ না করেও কথা, চাহনি, লেখা আর অঙ্গভঙ্গি দিয়েও ধর্ষকামী মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রতি যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করতে পারে। হোক সে নারী বা পুরুষ।
এসব বিষয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। লেখালেখিও কম হয় না। তবু যৌন হয়রানি করার মতো আচরণ বা অপরাধ থেকে উত্তরণ ঘটছে না আমাদের। মানুষের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা দিন দিন যেমন কমে যাচ্ছে তেমনভাবে বেড়েই চলেছে পরস্পরের প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ। একই সঙ্গে অপরাধের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি মানুষ প্রথমে তার পরিবার থেকে শেখে, তার পরিবেশ থেকে শেখে। মানুষে-মানুষে মিথস্ক্রিয়ার কারণেও মানুষের আচরণ প্রভাবিত হয়, মানুষ নিজেকে পরিশীলিত করতে শেখে। আর তাই শুরুটা যেহেতু পরিবার থেকেই হয় সেহেতু ছোটবেলা থেকে ছেলে বা মেয়ে সন্তানকে সঠিক শিক্ষাটি দিতে চেষ্টা করা, তাদের ভেতরে সচেতনতা তৈরি করা আমাদের অন্যতম দায়িত্বের ভেতরে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, সন্তানের ভেতরে মূল্যবোধ গড়ে উঠলে সে কেবল নিজেকে নিরাপদে রাখতে শেখে না, সে অন্যকেও নিরাপত্তা দিতে শেখে।
আসলে আমাদের ভেতরে একটা প্রবণতা আছে, আত্মকেন্দ্রিক আমরা সবসময় চাই ‘আমার সন্তান, আমার স্বজনেরা নিরাপদে থাকবে।’ আমাদের সন্তানদের সংস্পর্শেও যে অন্যদের নিরাপদ বোধ করতে হবে সেই বিষয়টা অনেকসময় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
সন্তান সকল বিরূপতা থেকে যেন নিজেকে শুধু নিরাপদ রাখতেই না শেখে, সে নিজেও যেন অন্যের বিপদের কারণ না হয় বা ধর্ষকামী মনোবৃত্তিসম্পন্ন না হয় সেভাবে আমি আমার সন্তানদের গড়ে তোলার চেষ্টা করি। জানি না, কতটুকু পারছি। তবু প্রাণপণে চেষ্টা করি, করবো। শুধু এই চেষ্টাই যে করি তা না, আমার ছেলে বা মেয়ে যখন কোনো মানুষের সামনে সাচ্ছন্দ্যবোধ না করে তখন তার পেছনের কারণটা আমি জানার চেষ্টা করি। ওদের বিশ্বাস করি আমি। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আস্থার অভাব বা বিশ্বাসহীনতার জন্য কতটা যন্ত্রণাভোগ করতে হয়।
যখন মেয়ে বা ছেলে বলে, ঐ মানুষটা কেমন যেন বা সে…ঐ বাসায় যাবো না, তখন আমি ওদের নির্ভার করার চেষ্টা করি, জানতে চেষ্টা করি কেন ও ঐ নির্দিষ্ট মানুষকে পছন্দ করছে না, কেনই বা কোনো একটা পরিবেশে ওরা অস্বস্তিবোধ করছে। আমার এতটুকু সাবধানতার কারণে একবার একটা বড় বিপদ থেকে আমার সন্তানদের আমি নিরাপদ রাখতে পেরেছি। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে বুঝিয়েছিলেন, বিপদ আসছে।
আমি উপলব্ধি করি নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করতে হবে, সে যখন জানায় সে বিপন্নবোধ করছে বা কারো স্পর্শ বা কথা কিংবা অঙ্গভঙ্গি ওর ভালো লাগেনি তখন তার কথার গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু সন্তান নয় নিজের পার্টনার বা বন্ধু বা সফরসঙ্গী যখন জানায় কোনো কারণে সে কোনো পরিবেশে বা কোনো মানুষের সামনে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না তখন তার কথার গুরুত্ব দিতে হবে। হয়তো আমাদের সামান্য মনোযোগ আর সহমর্মিতা তাকে বড় ধরনের কোনো ভুল বা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
আগে মা যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে দূরবর্তী কোনো স্থানে যেতে নিষেধ করতো বা হুটহাট বন্ধুদের বাসায় যেতে না দিতো তবে খুব মন খারাপ হতো, নিজের ভেতরে ক্ষোভ জন্মাতো। ভাবতাম কেবল টাকা দিতে হবে বলেই মা এমন না না করছে। পাঁচটি সন্তান নিয়ে ক্রমাগত একা লড়াই করে চলা মা আমার সঙ্গী হতে পারতো না বলে বা নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাকে যেতে দিতে চাইতো না তা মানতে ইচ্ছে করতো না। পরে যখন খুব কাছের মানুষদেরও এক একটি ভুল পদক্ষেপের কারণে মাশুল দিতে দেখেছি তখন ভালোভাবে বুঝেছি আমার মায়ের সতর্ক থাকার নেপথ্যের কারণ।
তাই আমি যেমন চাই আমার পরিবারের সদস্যরা যেন নিরাপদে থাকে, তেমনি চাই অন্য পরিবারকেও তারা যেন নিরাপদে রাখে। কারণ নিজের পরিবারকে ঘরে বন্দি রেখে ভাইরাস থেকে হয়তো প্রিয়জনদের নিরাপদে রাখার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু মানুষ নামক বিশেষ ধরনের ভাইরাস থেকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। ঘরের ভেতরে ঢুকে বন্ধু বা স্বজনের বেশে এই ভাইরাস আমাদের ছেলেমেয়ের, আমাদের প্রিয়জনের ক্ষতিপূরণের অযোগ্য ক্ষতি করতে পারে। তাই নিজেসহ সন্তানকে সতর্ক করার আর তৈরি করার সময় এখনই।