সামিনা আখতার:
অনেকদিন আগে ঢাকার প্রিপারেটরী স্কুলে একজন অভিভাবক ‘মা’ তার মেয়ের যৌন নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ করতে নেমেছিলেন, সেদিনও এই মারজিয়া প্রভার অবস্থান এবং কথা আমার পছন্দ হয়নি। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম।
প্রভার বক্তব্য ছিল, ঐ মা প্রমাণ ইত্যাদি দিতে পারেনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, একজন মা তার ছোট্ট মেয়ের যৌন নির্যাতনের কথা যখন সবার সামনে বলছে তখন তার পাশে না দাঁড়িয়ে প্রমাণ খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যে কত ধরন, কত রঙ, কত রূপ তার হিসেব নেই। আর ‘প্রমাণ’ শব্দটা এই ক্ষেত্রে আর একটি বিরাট অস্ত্র, যা নারীর বিরুদ্ধেই প্রয়োগ হয় ভয়ঙ্কররুপে।
আমি উত্তরবঙ্গের একটা উপজেলা সদর থেকে এসএসসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি, তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করে উন্নয়ন সেক্টরে চাকরির সুবাদে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এই পুরো পথটাতে, রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে আমি কতবার কতভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি তার বর্ণনা এই পাতায় কুলাবে না। তবে আমার পরিবার যেহেতু এই কথা শেখায়নি যে তুমি বের হয়েছো কেন, তোমার পোশাকই সমস্যা, সেহেতু এইসব ঘটনায় ঘুরেও যে দাঁড়াইনি, তা নয়। একবার জ্যামিতি বক্সের কাঁটা কম্পাস দিয়ে একটাকে তো প্রায় বসিয়েই দিয়েছিলামই আরকি! বেঁচে গিয়েছে ভোঁ দৌড় দিয়ে। তখন আমি ছাত্রী, কেবল এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় রওনা দিয়েছি ভর্তি পরীক্ষা দেবো বলে। হাতে ছিল কাঁটা কম্পাস, আর বুকে পরিবার থেকে জ্বেলে দেয়া সেই আগুন।
এরপর জাবি। ঢাকা থেকে জাবির বাস না পেলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টই ভরসা। একদিন ক্লাস করবার পর ক্লান্ত হয়ে ফিরছিলাম। উঠেই দেখি নারীদের জন্য বরাদ্দ সিটে কয়েকজন ছেলে বসে আছে, বললাম, ‘এটা নারীদের জন্য বরাদ্দ, আপনারা সিট ছাড়েন’। একটি ছেলে ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘কেন, আপনারা নারীর সমান অধিকার চান, আবার বাসে বরাদ্দ সিটও চান’। মাথা ছিল গরম, আমি ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘দ্যাখেন, সমান মানে ফিফটি পারসেন্ট, কিন্তু আমি চাই সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট অধিকার, আপনি এখন সিটটা ছাড়েন’। সে সিট ছাড়লো না, কিন্তু চুপ হয়ে গেল। আমি কন্ডাকটরকে ডেকে বললাম, এই সিট যদি না পাই, আমি ভাড়া দেবো না, পাশের দুই/তিন জন মেয়ে ছিল ওদেরকেও বললাম, ‘আপনারাও ভাড়া দিবেন না’। এইবার কন্ডাক্টর ওদেরকে উঠিয়ে দিল, আমরা বসলাম।
এই প্রসংগটি তুললাম এই কারণে যে দেখুন, নারীর অধিকার চাই বলে সেটি বুমেরাং হয়ে কীভাবে ফিরিয়ে দেয় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! সেখানে আরও ভীষণভাবে দুুর্গা থেকে কালীমূর্তি ধারণ না করলে এই সমাজ আরও বেশী পিষতে থাকে।
দেখুন, যে ছেলেটি একটি ধর্ষণ ঘটনার প্রমাণ দিচ্ছে, সেখানে সে বলছে যে সজিব তুষার নামের ছেলেটি স্বীকার করেছে যে সে মেয়েটিকে জোর করেছে। তো এটি একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে সজিব তুষার। কিন্তু ছেলেটির লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে কে? মারজিয়া প্রভা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে যাচ্ছে কার নাম? মারজিয়া প্রভা। কারণ মারজিয়া প্রভা নারীবাদী।
আমি মারজিয়া প্রভার পক্ষ নিচ্ছি না। কোনভাবেই না। সেজন্যই প্রথমেই তার বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলেছি। প্রভা ধর্ষণে সহযোগিতা করে থাকলে তার বিচার চাই। সরাসরি। কিন্তু সেইসাথে আপনাদের চোখটাও খোলা রাখতে বলছি, এই সমাজে আমাদের জন্য ‘বুমেরাং’ টার দিকে।
দেখুন কোনো ধর্ষণের ধর্ষককেই যদি পেয়ে যান, সে স্বীকারও করে, তবে তাকেই আগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন নাকি কে সহযোগিতা করেছে, তাকে?
ভুল বুঝবেন না। বুমেরাং’টা বুঝুন।
আর সেই সাথে এও বলে রাখি, আমি এই বিষয়েও একমত যে, যদি কেউ কোন আদর্শের পক্ষে কথা বলে, প্রচার করে, তখন তাকেও সেই আদর্শ ধারণ করতে হয় তার নিজস্ব চর্চায়। না হলে তার দোষ পুরো আদর্শবাদীদের উপর এলে তার দায় আসলে ঐ বিচ্যুত মানুষটির। কোন আদর্শ ধারণকারীর কোনো একজনের লেখা, কথা যদি সে আদর্শকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে, তাহলে কারও বিপরীত আচরণের উপর আঘাত আনবে সেটাই স্বাভাবিক।
নারীবাদের যাত্রায় যে পর্যায়ে এসে বিবাহিতা স্ত্রীর ‘না’কে ‘না’ হিসাবে গণ্য করার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে একজন প্রেমিকা/বান্ধবীর ‘না’ কোন গুরুত্বই পেলো না, কেবলই ফান হয়ে গেল! তাও আবার একজন নারীবাদীর কাছে! এটি শুধু দুখঃজনক নয়, মারাত্মক বিচ্যুতি।
আর বরাবরের মতো এবারও বলি, অপরাধ অপরাধই, সেটা যেই করুক, তার শাস্তি চাই।
তাই সজিব তুষারের শাস্তি চাই। সহযোগিতা করেছে প্রমাণ হলে মারজিয়া প্রভার শাস্তি চাই। নারীবাদিরা কোন অন্যায়/অপরাধ করে না, এমন কথা নারীবাদ বলে নাই কোথাও।
তবে, এই নারীবাদ নিয়ে বুমেরাং করে আঘাত ফিরিয়ে দেয়াকেও সহজ চোখে দেখার অবকাশ নেই।