অনলাইন বুলিয়িং: শুধু আইনের অভাব নয়, রুচি আর শিক্ষার অভাবও দায়ী

সালমা লুনা:

সাকিব আল হাসানের মেয়ের একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ফেসবুকে।
বাবা অথবা মা সূর্যমুখী বাগানে বাচ্চাটার একটা ছবি পোস্ট করলে তার নিচে কিছু দুপেয়ে জীব আজেবাজে কথা লিখে দেয়।
কদিন ধরে সেসব নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে। নিউজফিড ভর্তি একটা বাচ্চার ছবি, যেখানে তার গায়ে সেঁটে আছে সেই বাজে কমেন্টগুলির লেবেল। প্রথমদিকে শুধু ছবিটা দিলেও পরে এই কমেন্টযুক্ত ছবিটাই সবাই পোস্ট দিয়েছে।

আমার বুক ফেটে যায় দেখে। ওখানে আমার মেয়েটা হলে আমার কেমন লাগতো!
চিৎকার করে উঠতাম আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে, চাই না বিচার। আমার মেয়ের ছবি দেখে ওই নোংরা কথার লেবেল সরাও।
আর না। অনেক হয়েছে। আমার মেয়ের ছবি আর শেয়ার দিও না।
শুনলাম সাকিবের স্ত্রী, অর্থাৎ ওই শিশুকন্যাটির মা শিশিরও এমন মনোভাবই রাখেন। ধন্যবাদ তাকে, সমস্যার গোড়ায় ধরতে পেরেছেন উনি।

ফেসবুকের একটা গ্রুপ অপরাধীদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করে শেয়ার দিচ্ছে। বাচ্চাটার ছবি প্রকাশের চেয়ে এটা বরং ভালো একটা কাজ হয়েছে।
তাদের আইনের আওতায় নেয়া হবে মর্মে খবরও পাওয়া গেছে। হয়তো তাদের শাস্তিও হবে।

কিন্তু তারপর?
তারপর কি থেমে যাবে সব?
সবাই ভালো হয়ে যাবে?
নারী ও শিশুরা আর সাইবারবুলিং এর শিকার হবে না?
মানুষ হয়ে যাবে সব দুপেয়ে পশু?

না হবে না।

যে কালচার শুরু হয়েছিল অনলাইনে খালেদা জিয়াকে গালি দিয়ে, খালেদা জিয়ার সাজসজ্জা কল্পিত প্রেম নিয়ে নানান সেক্সিস্ট মন্তব্য দিয়ে, শাবানাকে ট্রল করে, সাহারা খাতুনের ভিডিও আর ছবি নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, নারীর সিগারেট খাওয়ার ছবি ভাইরাল করে সেটার নিচে লাগাতার যৌন নিপীড়কদের কমেন্টের মাধ্যমে, সেটাই এমন ফুলেফেঁপে উঠেছে যে এখন প্রধানমন্ত্রীও ছাড় পান না। বিদেশে থাকার সুবাদে তাদের কেউ ধরতে পারে না বলে অনেকেই যে সব কমেন্ট করে, তা রীতিমতো ধৃষ্টতা। প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো খবরের কমেন্টবক্স দেখলে এর সত্যতা মিলবে।

নারী ও শিশুদের লাগাতার ধর্ষণের মধ্য দিয়ে যে সমাজ বয়ে চলেছে, সেখানে এই সাবার বুলিয়িং ডালভাত হয়ে যাচ্ছে। দ্রুততম সময়ে শাস্তি তো দূর, রাষ্ট্রের তরফ থেকে যেখানে নির্বিকার উদাসীনতাই দেখে আসছে এই নাগরিকরা, সেখানে শিশুর ছবির নিচে কুৎসিত মন্তব্য খুবই স্বাভাবিক।

কেন তারা এসব করে?
প্রথম যে উত্তরটা আসে তা হলো এটাকে তারা স্বাভাবিকভাবে দেখে। এধরনের কমেন্টে শাস্তি হতে পারে তা তারা মনেই করে না।

এখন এই স্বাভাবিকভাবে দেখার কারণ কী?
কারণ তারা ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের সামনে, মার্কেটে বাসে ট্রেনে মেয়েদের দেখলে তাদের কাকা মামা বড় ভাইরা কী আচরণ করতো, কেমন মন্তব্য করতো।
তাদের শিক্ষা এবং সুরুচির হাতেখড়ি তখনই হয়ে যায়।

শুধুই কি তাদের শিক্ষাদীক্ষা, সুরুচির অভাব?
না। তারা জানে যে এমন মন্তব্য করলে তাদের ঠেকানোর কিছু নেই, অর্থাৎ আইন নেই।
যেখানে ধর্ষনেরই বিচার হয় না। ধর্ষক জামিনে বের হয়ে ভিকটিমকে আবার ধর্ষণ করে, নয়তো মেরে ফেলে। সেখানে, ও মনু পাটক্ষেতে কী কর!’ বললে কেউ শাস্তি পাবে এ যে তাদের চিন্তারও অতীত!

এসব তো অনলাইনে একদিনে হয়নি। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে নারী ও শিশুদের নিয়ে এইসব জঘন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনমূলক যৌনগন্ধী কথাবার্তা।
মনে পড়ে কতগুলো পেইজ ছিলো, ওই মাইয়া উড়না গলায় না বুকে দে টাইপের। তাতে নারীদের নিয়ে অবিরাম বাজে পোস্ট আসতো।
অনেক ফ্যান ফলোয়ার ছিলো সেসবের। শেয়ারের কমতি ছিলো না।
পেইজগুলো না থাকলেও এখনো নারীদের আচরণ, কাজ, শরীর নিয়ে আজেবাজে ট্রল বন্ধ হয়নি। ফলে এরা ভাবে এসব খুবই স্বাভাবিক। এবং এমন মন্তব্যে অন্যায় নাই।

তাই হেনস্থাকারীর ছবি ভাইরাল করে খুব বেশি কিছু করা যাবে না। সামাজিকভাবেও যে খুব একটা হেনস্থা হবে তাও মনে হয় না। কারণ ওরা এই সমাজেরই লোক যেখানে এইরকম মন্তব্যকে অপরাধ ধরাই হয়না।

এর সমাধান করতে হবে কঠোর আইন করে। এবং যথাযথভাবে এই আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে।

আর সুশিক্ষায় শিক্ষিত রুচিবোধ থাকতে হবে। পরিমিতিবোধ লাগবে।
ভদ্রতার জ্ঞান থাকতে হবে।

প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইলে কোন কথাটা চাইলেই বলে ফেলা যাবে না। কোন কথায় মানুষকে মানসিক নির্যাতন করা হয় সেটার জ্ঞান রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বাবা-মা এবং শিক্ষকদেরও থাকতে হবে। তবেই না ফুটফুটে সৎ মানবিক সুনাগরিক বাড়বে সমাজে।

নইলে কপাল থাপড়াতে হবে আজ সাকিব কন্যার জন্য। কাল নিজের পরিবারের কোন কন্যার জন্য।
আর এভাবেই দেশটা ভরে উঠবে যৌন নিপীড়কে।

তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে।
আজ সেই গোকূলও নেই আর সেখানে কৃষ্ণ ভগবানও বেড়ে উঠেন না। সেখানে এখন শয়তান বাড়ে। কাজেই গোকূলে কেবল গোবরছড়া না দিয়ে কিছু শিক্ষার আলো ফেলতে হবে । এটুকু বুঝলে আজ ছোট্ট একটা বাচ্চার ছবিতেও যৌন নিপীড়কদের ভীড় লেগে যেত না। নারীর ছবি ভাইরাল করে তাকে ট্রল করা হত না।

আর একটা কথা বললেই নয়। আমরা খারাপ যা কিছু তা দেখানোর সময়, প্রতিবাদ করার সময় আরেকটু সাবধানী হই।
যা খারাপ লাগছে তা দিয়ে নিজের ঘর সাজানোর মানে হয়না।

অনলাইনে একটিভ যারা থাকেন তারাই জানেন ভার্চুয়াল জগতের মানুষের চিন্তায় কতটা বিষ থাকে।
সেই বিষ কীভাবে মানুষের মগজ থেকে আঙ্গুল বেয়ে কালো কালো অক্ষর হয়ে মানুষকে তীব্র যন্ত্রণা দিতে পারে। সুস্থ্যতার ছদ্মবেশে থাকা কিছু অসুস্থ্য, মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ, অবদমিত যৌন তাড়নায় ভরপুর, কুশিক্ষিত, আক্রমণাত্মক কিছু মানুষ স্রেফ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে কীভাবে নারী ও শিশু নির্যাতকের মত আচরণ করে।
সমাজ কখনো সমভাবে ডেভেলপ হয়না।
মানুষের আর্থিক সামাজিক অবস্থার সাথে পারিবারিক শিক্ষার কিছুটা সংস্রব থাকায় বাংলাদেশের মত একটি দেশের নাগরিকদের মন ও মগজও তাই সমানভাবে ডেভেলপ হতে দেখা যায় না।

তাই তো পুলিশের উচ্চপদে চাকরি করেও দুজন পুলিশকর্তা একজনের প্রাইভেসিতে অনায়াসে নাক গলাতে পারেন।
সেটা দেখে আদিম আনন্দে হইহই করে উঠে সমাজের সমমনোভাবাপন্ন অংশ। তারাও অবিরাম নাক গলায় অন্যের প্রাইভেসিতে। পরনের কাপড় টেনে খুলে নেয়ার বিকৃত আনন্দসম অভিলাষ নিয়ে ফেসবুক ঘেঁটে এমন কিছু ছবি বের করে আনে এবং তাদেরই সহমত সমাজের সাথে মিলে উল্লাস করে। আমরা হায়হায় মাতম করে সমকালীন সমাজের বিকৃত নোংরা রূপ প্রত্যক্ষ করি।

এটা বাড়ছে।
কেউ কেউ ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই দায়ী করেন এর কারণ হিসেবে।
সমাজ নিয়ে গবেষণা যারা করেন তারা জানবেন ভালো। তবে প্রযুক্তি কিছুটা দায়ী হলেও সুস্থ্য চিন্তা লালন করলে এসব করা যায় না।
চাইলেই অন্যের জীবনের গোপন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা যায়না। ব্যক্তিগত ছবি ছাপিয়ে দেয়া যায় না। প্রকাশ্যে যে ছবি দেয় তার নিচে বাজে মন্তব্য করা যায় না। পাবলিক পোস্ট দিলেও না। মতামত লেখা পছন্দ না হলেও বাজে মন্তব্য করা যায় না।
যায় না এবং যায় না।

কথায় বলে লাঠিওয়ালার লাঠি ধরা যায়, কিন্তু মুখওয়ালার মুখ ধরা যায় না।
আজ আর সেই দিন নেই। লাঠির সাথে মুখওয়ালার মুখ ধরারও পথ আছে। বিভিন্ন আইন এবং ধারা তো তাই বলে।
কিন্তু আইন করেই কি সব হয়?
আইন করে বিবেক জাগানো যায় না।
বরং মানুষের উপরেই ভরসা রাখতে হবে।
মানুষ যেন নিজেই বুঝতে পারে কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়। মানুষ যেন তার অধিকারের সীমানা বোঝে, সেই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ।
আর রুচি ব্যাপারটা খুবই সুক্ষ্ম। উচ্চশিক্ষিত হলেই তা থাকে না।
লেখায়, ছবিতে যারা কুরুচিপূর্ণ আর ব্যক্তি আঘাত কতে মন্তব্য করেন ওই সুক্ষ্মতা দিয়েই তাদের বেড়ে উঠা,পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, শিক্ষার বহর কিছুটা মাপা যায়।
এদের জন্য দয়া হয়, করুণা হয়। এদের সাথে কথা বলার বা বোঝানোর রুচিটা আর হয় না।

নারী ও শিশুদের নিয়ে নানান নোংরামি দেখলে অনগ্রসর সমাজে বেড়ে উঠা মানুষগুলোর রুচি ও শিক্ষার দৈন্যতাই প্রকট হয়ে উঠে।
তাদের সাথে যারা উল্লাসে অংশ নেয় তারাও একই পথের পথিক। তাদের নানাবিধ অবদমন তাদেরও হাহা আর লাভ রিয়াক্ট দেয়া, সহমত আপু ভাইয়ায় পরিণত করে।

এদের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। আমার মুখ আমি খুলব, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খুলব – ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ।
সিংহভাগকে এই ভাইরাসের কবলে পড়ে পর্যুদস্ত হতে দেখলে সুরুচির আশা ম্রিয়মান হয়ে যায়।

রুচির এই অধঃযাত্রার শেষ কোথায়?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.