শাহানা হুদা: ঐশী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার আগ পর্যন্ত আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছি, বাচ্চাটা যেন এই ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না থাকে। বাবা-মাকে হত্যার দায় যেন এই শিশুটির ওপর না পড়ে। কিন্তু সেই প্রার্থনা বিফলে গেল, আশঙ্কা সত্যে পরিণত হলো। ঐশী নিজের অজান্তেই যে কত বড় একটি অপরাধ ঘটিয়েছে এবং সেই সঙ্গে নিজের ও ভাইয়ের জীবনটাকে কতটা আশ্রয়হীন করে তুলেছে—হয়তো এই সত্য এখনো সে অনুভব করেনি। আর যখন অনুভব করবে, ততক্ষণে শেষ হয়ে যাবে সবকিছু।
আমাদের যাঁদের এই বয়সের সন্তান রয়েছে, তাঁরা জানেন, টিনএজ বাচ্চার অভিভাবক হওয়ার মতো এত বড় চ্যালেঞ্জ আর কিছু হয় না। আমরা টের পাচ্ছি সন্তানকে যথাযথভাবে বড় করার প্রক্রিয়াটি দিনে দিনে কতটা জটিল হয়ে উঠছে। চারপাশে তাকালে দেখতে পারছি ১২ থেকে ২০ বছর বয়সী বাচ্চাদের নিয়ে বাবা-মায়ের কত দুশ্চিন্তা। একেকটা বাচ্চার সমস্যা একেক রকম—কারও বাচ্চা পড়াশোনা করছে না, কেউ বা সারাক্ষণ ফেসবুকিং করছে, কেউ মাদক গ্রহণ করছে, কেউ পড়ে আছে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, কেউ ভিডিও গেম বা ইন্টারনেট জগতে ব্যস্ত, কারও কারও সমস্যা প্রেম থেকে পর্নোগ্রাফি পর্যন্ত গড়িয়েছে। কারও বাচ্চা বাবা-মাকে তোয়াক্কা করছে না, বাবা-মায়ের কথা শুনছে না। কেউ বা নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা দিচ্ছে, আবার কেউ বা নাম লিখিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের খাতায়। যে সমস্যাগুলের কথা বললাম—এর প্রায় প্রতিটি আমরা আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে।
আমরা যাঁরা অভিভাবক, একেকজন একেকভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি। হয়তো ঠিকপথে, হয়তো বা ভুল পথে। আমরা অভিভাবকেরা কেউ কেউ বাচ্চার প্রতি ছোটবেলা থেকে উদাসীন থাকি, তাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না বা দিই না, কেউ বা সন্তানকে অতিরিক্ত নজরদারিতে রাখার চেষ্টা করি, ভালোবাসার বাড়াবাড়িও চলে কারও কারও বেলায়, কেউ কেউ সন্তানকে সময় দিতে না পেরে জিনিসপত্র দিয়ে অভাব মেটানোর চেষ্টা করি, কেউ মনে করি বাচ্চাকে গ্লোবাল সিটিজেন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তাই সাতপাঁচ না ভেবেই প্রযুক্তি হাতে তুলে দিই কিন্তু এর ওপর কোনো নজরদারি রাখি না।
সবাই চাই সন্তান শুধু পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করুক—কিন্তু একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠুক তা নিয়ে ভাবি না। দিনরাত কোচিং সেন্টারে, ছবি আঁকা, গানের ক্লাসে বাচ্চার সঙ্গে ছোটাছুটি করছি, কিন্তু তার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি না বা ভালো কিছু শেয়ার করছি না বা তার জন্য সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করছি না। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় বাচ্চারা একা একা, বুয়ার কাছে বা শুধু বাবা-মায়ের কাছে বেড়ে উঠছে। একক পরিবার শিশুকে করে তোলে অসামাজিক, স্বার্থপর, মূল্যবোধহীন এবং সর্বোপরি একাকী। বইয়ের বদলে শিশুর হাতে এসেছে টেলিভিশন ও কম্পিউটার—যে জগৎ তাকে কোনো কিছু ভাবতে শেখায় না বরং অস্থির করে তোলে। কেন আমার সন্তানটি ধীরে ধীরে আমার কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছে? কেন বাবা-মায়ের চেয়েও বাইরের জগৎ তাকে বেশি প্রভাবিত করছে? যখন কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা দূরত্ব তৈরি হয়, তখনই সম্পর্কের মধ্যে অচেনা অংশ বেড়ে যায়।
আজকে আমরা যাঁরা টিনএজ বাচ্চাদের বাবা-মা, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টা কিন্তু অন্য রকম ছিল। সেই সময়ের সঙ্গে যদি আজকের অবস্থা তুলনা করার চেষ্টা করি বা আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, কেন আমাদের সন্তানেরা সেভাবে বড় হবে না ভাবি—তাহলে সেটা ভুল হবে। আর এই ভুলটাই আমরা করে চলেছি চেতন ও অবচেতনভাবে। একজন নামকরা মনোবিজ্ঞানী একবার বলেছিলেন, মা-বাবারা মনে করেন তাঁরা সন্তানের বন্ধু। কাজেই সন্তানের উচিত সবকিছু তাদের সঙ্গে শেয়ার করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সন্তান কিন্তু তাদের বাবা-মাকে বন্ধু বলে মনে করে না। তিনি আরও বলেছিলেন, মা-বাবা তাঁদের মতো করে সন্তানকে দেখতে চান, বড় করতে চান। অথচ সন্তানের চিন্তাভাবনা থাকে একেবারে বিপরীত। আর তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত। বন্ধুবান্ধব বা সমবয়সীদের খপ্পরে পড়ে নেশার জগতে পা রাখছে অনেক ছেলেমেয়ে। অভিভাবকদের মধ্যে যাঁরা পারছেন, তাঁরা সন্তানকে নিয়ে ছুটছেন রিহ্যাব সেন্টারে, কাউন্সিলরের কাছে। আর যাঁরা পারছেন না কিংবা বুঝতে পারছেন না বিষয়ের গুরুত্বটি, তাঁরা সন্তানকে বকাঝকা করছেন, আটকে রাখছেন। কিন্তু এর ফল শুভ হচ্ছে না।
অনেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া বাচ্চাদের সমস্যাকে বড় করে দেখছেন। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়া বাচ্চারাও এর কবল থেকে মুক্ত নয়। সাইবার জগৎ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বাজার, মাদকের ছোবল— এসবই আমাদের সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করছে—সে তারা যে মাধ্যমেই পড়ুক না কেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আজ থেকে তিন বছর আগে শিশুদের পর্নোগ্রাফির ব্যবহার বিষয়ে একটি গবেষণা চালাতে গিয়ে দেখেছে যে ঢাকা মহানগরের স্কুলে পড়ুয়া ৭০ ভাগ শিশু-কিশোর পর্নোগ্রাফি দেখে এবং এদের একটা বড় অংশ নিজেরাই পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহূত হয়। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি বহুদিন আমি মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু তাতে কী, যা ঘটার তা তো ঘটছেই।
১৭ বছরের একটি মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মা-বাবার সঙ্গে তোমাদের বনিবনা হয় না কেন, সমস্যাটা কী? সে জানাল, আমার অধিকাংশ বন্ধুর মা-বাবারা বাচ্চার সঙ্গে শুধু পড়ার কথা বলে। কোনো গল্প করে না, কোনো কিছু শেয়ার করে না। যতটুকু সময় দেওয়া দরকার তা দেয় না। আবার অন্যদিকে অভিভাবকেরা বলেন, বাচ্চারা আমাদের সাহচর্য চায় না। ওরা ওদের জগৎ নিয়ে মেতে থাকে।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টা করছি না বা পারছি না। এই সময়ের একটি শিশু অনেক বেশি জানে, এরা অনেক বেশি স্পর্শকাতর, নিজেকে নিয়ে এরা ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। কাজেই অভিভাবক হিসেবে আমাদের সবার দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যে যে ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে, তা কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনছে না। সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ঐশীদের জীবন বাঁচাতে হবে—তা সে যেভাবেই হোক।
লেখক: শাহানা হুদা, যোগাযোগকর্মী।
(প্রথম আলো থেকে নেয়া)