নাফিয়া ফারজানা অমিয়া:
সমাজে যেমন গুণাবলিকে “ম্যাসকুলিন এট্রিবিউট” ধরা হয়, ছোটবেলায় তার বেশিরভাগই আমার মধ্যে ছিলো আরকি। কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বাবা বলতেন, “আমার তো এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেজোটাও আমার ছেলেরই মতোন। ভীষণ সাহস, ভীষণ প্রতিবাদী।” তখন না বুঝেই বড্ড খুশি হতাম এমন প্রশংসায়৷ অস্বীকার করছি না, তখন মনে হতো “অমিয়া তো পুরো ছেলেদের মতো” এটা বিশাল এক এনটাইটেলমেন্ট।
আবার আশেপাশে অনেক মেয়েকে দেখতাম, শুধুমাত্র সো কল্ড “ফেমিনিন এট্রিবিউট” ধারণ করা বা নরমসরম হবার কারণে কত ঝামেলা, কষ্ট পোহাতে হচ্ছে তাদের। তো আমার মধ্যে একটা ধারণা জন্মে গেলো যে ভুলেও জীবনে নরম কোমল হওয়া যাবে না। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে হবে, আর এজন্য শক্ত থাকতে হবে সবসময়। ভেঙ্গে পড়া যাবে না। সোসাইটি যেভাবে মেয়েদের বানিয়ে রাখতে চায়, সেরকম মোটেও হওয়া যাবে না। একদম প্রাইমারি লেভেলের ফেমিনিজম থটস আরকি! পড়িও তখন সবে মাত্র ক্লাস টু কি থ্রিতে। কিন্তু আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, যে একটু নরম হলেই মানুষ আমাকে অন্যান্য সব মেয়েদের দলে ফেলে দিবে। কিন্তু আমি সেটা চাই না, আমি কোনোমতেই ভঙ্গুর হতে চাই না।
তো গেলো এমন করে পিচ্চিকাল। তো ছোটবেলায় তো আর বেশিকিছু বুঝতাম না। আশেপাশের মেয়েদের ন্যাকা লাগতো। স্কুলে দাদাগিরি করে বেড়াতাম। বিকালবেলা ক্রিকেট খেলতাম। এলাকায় ছেলেদের সাথে গ্যাঞ্জাম করতাম। রীতিমতো বিশাল হুল্লোড়। আর এমন না যে জোর করে এসব করতাম, আমি এমনই ছিলাম। আর এই এমন হওয়াটাই হয়তো কাল হলো আমার জন্যে।
আস্তে আস্তে স্কুলেও ম্যাক্সিমামের মধ্যে ধারণা হলো আমি ভীষণ তেজী। আমাকে সবাই টমবয়ই ডাকতো হাইস্কুল পর্যন্ত। জুনিয়ররা আমাকে ভাবতো খুবই কঠিন ধরণের সিনিয়র আপু৷ বাসায় তো আম্মু প্রায়ই বলতো, “তুই এমন পাথর হৃদয়ের কেন!” ততদিনে অবশ্য সাহস বা জেদের ক্ষেত্রে ছেলেদের সাথে তুলনাটা যে আদতে প্রশংসা না তা বুঝতে শিখেছি৷ নিজে টিকে থাকার জন্যেই যে আমাকে মেন্টালি স্ট্রং থাকতে হবে, তা আমি ছেলে হই বা মেয়ে সেই বোধও এসে গেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে আমি এটাও আবিষ্কার করলাম যে আমি শক্ত থাকতে পারছি না। আমি ভেঙ্গে পড়ছি৷ বারবার ভেঙ্গে পড়ছি৷ আর সব সমস্যাকে ছাপিয়ে তখনই বড় সমস্যাটা শুরু হয়।
শুরুটা আমার নিজের মধ্যে থেকেই। এই যে আমি এতোগুলা বছর ধরে চেষ্টা করলাম নিজেকে একজন শক্ত মানুষ বানানোর জন্য, কঠিন হৃদয়ের মানুষ বানানোর জন্যে, তা আমি পারলাম না; এই ব্যর্থতা যেন আমাকে অন্যসব সমস্যার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট দিতে থাকে। আমার নিজের প্রতিই লজ্জা লাগতে থাকে যে আমি কী করলাম! সবাই আমাকে কীভাবে চিনে, আর আমি আসলে কি রকম! রীতিমতো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা শুরু করলাম। কাছের কয়েকজন মানুষই বললো, “নারীদের উদ্ধার করতে এতো লম্বা লেকচার দিস, এখন নিজেই এতো অল্পে ভেঙ্গে পড়িস?”, “এতো কম সহ্যক্ষমতা নিয়ে আবার ফেমিনিজম নিয়ে লেকচার দাও!” আমি তাদের বোঝাতে পারি না যে নারীমুক্তির আন্দোলনের সাথে একজন মানুষ হিসেবে আমার দুঃখ-কষ্টের কোনো যোগসূত্র নেই। একজনের ব্যক্তিগত দুঃখের সাথে নারী বা পুরুষ বা অন্য কোনো জেন্ডারের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু না, আমি একটু ভেঙ্গে পড়লেই তারা চাপিয়ে দিবে যে, ‘আসলেই মেয়েরা নরম হয়। আসলেই মেয়েরা প্রেশার নিতে পারে না। এইযে দেখো না, ফেমিনিস্ট হয়েও কিভাবে সামান্য কারণে কাঁদতেসে।’ আমি এই ক্রাইসিস সামাল দিতে পারি না। মনে হয় আমি একটু নরম হলে সেই দায়ভার সমগ্র নারীজাতির উপর ফেলবে কেউ। আবার নিজের “তেজী” একটা ইমেজ যে সকলের সামনে, সেটা নষ্ট হবারও ভয় থাকে। আয়হায়! লোকে কী বলবে! লোকে যদি ভাবে যে আমি কঠিন থাকার ভান করি, আসলে সব ভুয়া, তখন? নিজেকে নিয়েই বারবার কমপ্লেক্সে ভুগেছি এজন্য।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই এমন? যেই ঘটনায় আমি বিষণ্ণতায় ভুগছি, সেই একই ঘটনায় একটা ছেলেরও তো সমপরিমাণ দুঃখ হতে পারে৷ আবার একই ঘটনায় অন্য একটা মেয়ের হয়তো এরথেকে কম দুঃখ হতে পারে৷ কিন্তু নাহ, আমরা তো কাউকে তার অনূভুতি ঠিকমতো প্রকাশের সুযোগই দিবোনা। তাই একান্ত দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারটাকেও আমরা জেন্ডার দিয়ে আটকে দিলাম। স্টেরিওটাইপ সেট করে দিলাম। আমার ভাইটা ছিলো নরম টাইপের। একদম শান্তশিষ্ট। কথা কম বলতো। চুপচাপ। ওকে সারা ছোটবেলা শুনতে হয়েছে, “আয় হায়! এই ছেলে এমন মেয়েদের মতো শান্তশিষ্ট কেন!”
আমি জানি না কতদিন আমাকে এই সংশয় নিয়ে বাঁচতে হবে যে আমি ডিপ্রেসড হলে সেটাকে অনেকেই ধরে নেবে স্টেরিওটিপিক্যাল ফেমিনিন ব্যাপার৷ কী যে এক সংশয়! মানুষ যখন আঙ্গুল তুলে এই কারণে, মনে হয় এতো বছরের সব চেষ্টা সব প্রতিবাদ সব ব্যর্থ। জীবনের দীর্ঘ একটা সময় আমি চেষ্টা করেছি নিজেকে সকল কোমল অনুভূতি থেকে দূরে রাখার। ভেবেছিলাম এসব আমার সীমারের মতোন কঠিন হৃদয়কে গলিয়ে ফেলবে৷ কিন্তু আসলে মনে হয়, সব মানুষের হৃদয়ই একটা না একটা পয়েন্টে এসে গলেই যায়। আমিও গলি৷ অনেক সেন্সিটিভ ব্যাপার আছে আমার, এবং আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো হয়তো অন্য কারো চোখে তেমন গুরুতর কিছু মনে নাও হতে পারে। আবার আমার এই দুঃখবোধের সাথে ফেমিনিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন সম্পর্ক নেই ছেলেদের দুঃখের সাথে তাদের জেন্ডারের কিংবা পৌরুষত্বের। ছেলেরাও বিষণ্ণ বোধ করে। তাদেরও কষ্ট লাগে, দুঃখ পায়। সেই দুঃখ লুকিয়ে রাখতে আমরা কেনো বারবার তাদের বাধ্য করি? আমরা একটু মানুষকে তাদের অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে দেই? সব জায়গায় এসব স্টেরিওটাইপ না ঢুকাই? সবাইকে জেনারেলাইজ করে জাজ করাটা একটু বন্ধ করি?