সুপ্রীতি ধর:
ঢাকা মেট্রো সাউথ এর এসপি, পিআইবি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ওরফে রহমান শেলী তাদেরই একজন যারা কিনা সব ঘটনার মূলে একজন নারীকে ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে খুঁজে বের করেছে এবং এ দিয়েই তারা নিজেদের ‘কৃত অপরাধ’ ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছে। একা নন তিনি, তার সাথে আছে পুরো পুলিশ বাহিনী, নিদেনপক্ষে যারা তাকে সমর্থন দিয়ে হাজারে হাজারে ভাইরাল করছে সেইসব পোস্ট। এখন পর্যন্ত ওপর মহল থেকে কোন নির্দেশ আসতে শুনিনি যে তারা যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত গর্হিত একটা কাজ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়ে যখন একজন নারীর ব্যক্তিগত ছবি পাবলিক করে দিয়ে সমাজের তথাকথিত ‘চরিত্র’ হননে লিপ্ত হয়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এই ঘটনা রাষ্ট্রের কোন কাঠামো থেকে করা হচ্ছে! কাদের মদদে হচ্ছে? কারা মূল ঘটনা থেকে নজর ফিরিয়ে নিতে বরাবরের মতোনই একজন নারীকে বেছে নিয়েছে তাদের ‘ সফট টার্গেট’ হিসেবে।
একজন নারী, যে কিনা সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে চলতে চায় না অর্থাৎ পুরুষ নির্দেশিত উপায়ে জীবনযাপন করে না তাকে ‘মাগী’ ‘বেশ্যা’ ‘খানকি’ আখ্যা দিয়ে সবার সাথে শুইয়ে দেয়াই এখন রাষ্ট্রের আসল চরিত্র। সেখানে ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীনের ফারাক নেই।
একটা রাষ্ট্র বা সরকার যারা চালায় তারা কতোটা অসৎ, অপরাধপ্রবণ, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নাজুক হতে পারে তা সেই দেশের নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধের মাত্রা দেখেই উপলব্ধি করা যায়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, বরং নিজেদের বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি, অপকর্ম লুকিয়ে, তদুপরি অসৎ পুলিশ সদস্যদের রক্ষায় যেভাবে নগ্নভাবে একের পর এক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে খোদ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, তাতে করে আমাদের মতোন সাধারণের হা-হুতাশ করা বা বড়জোর ফেসবুকে কিছু লেখালেখি এবং হ্যাশট্যাগ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না। আমাদের ভিতরে ৫৭ ধারার নামে টুঁটি চেপে ধরা, গুম করা, অপহরণের ভয় এর সংস্কৃতি আর ধর্মীয় ভাবধারা খুব সুক্ষ্মভাবে প্রবেশ করিয়ে উল্লাস করছে আজ রাষ্ট্র। এসপি মিজানুর রহমানরা সেই উল্লাস উৎসবের কুশীলব মাত্র।
যেকোনো ঘটনার সাথে নারী সংশ্লিষ্ট হওয়া মাত্রই তার ভোল পাল্টে যায়। আগেও দেখেছি, এখনও দেখছি। মূল ঘটনা থেকে সাধারণকে বিভ্রান্ত করে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে তৎপর হয় সেই আদিম প্রবৃত্তি। নারীর শরীর, নারীর তথাকথিত চরিত্রের নামে তার জীবনযাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা সাধারণকে গুলিয়ে খাইয়ে দেয়া হয়। আর যৌন অবদমিত সাধারণেরাও তখন নেশাগ্রস্তের মতোন চারদিকে কেবল নারী শরীরই দেখে, সমাজের ত্রুটিগুলো, অন্যায়গুলো, দুর্নীতিগুলো দেখে না। যেন একজন নারীর মদ, সিগারেট খাওয়া বা হাফপ্যান্ট পরা, বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরিই এই সমাজের সবচেয়ে বড় অপরাধ, সমাজ রসাতলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার! অথচ দিনের পর দিন মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের নামে, ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দেয়ার নামে যে হারে ক্রসফায়ার, বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, গুমের সংস্কৃতি চলছে একটি দেশে, সেখানে এসবের বিরুদ্ধে বিপুল জনমত তৈরিতে ধর্মান্ধ, নপুংসক জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় না। এটা যে একটা রাজনীতি তা সহজে সাধারণের মাথায় প্রবেশ করে না, তারা আপাতদৃষ্টে নারীকে ঘিরে একধরনের অর্গাজমের সুখ লাভ করে।
এই তো সেদিনই করোনাকালে ইতিহাসের ভয়াবহতম অপরাধ সংঘটন করলো রিজেন্টের সাহেদ আর জেকেজির সাবরিনা এবং তার স্বামী আরিফ। কিন্তু কী দেখলাম আমরা? নাটকের পর নাটক হলো এক সাহেদকে ঘিরে, আর সাবরিনা ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তার হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করা সত্ত্বেও আলোচনার মুখ্য বিষয় হলো তার সাজপোশাক, তার চালচলন। যেন নারী মানেই আস্ত একটা যোনিসর্বস্ব শরীর, এবং তা নিয়ে এই দেশের পুলিশ বলুন আর পুরুষ বলুন, সবাই ইচ্ছেমতোন কালিমা লেপে দিতে সদা তৎপর। মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড ঢাকতে এখন তার সহকর্মি শিপ্রা দেবনাথ এবং সিফাতকে নিয়ে নোংরামি শুরু করেছে পুলিশ সদস্যরা। কর্মকর্তারাও যে বাদ যাচ্ছে না তা ওই এসপির পোস্ট থেকেই বোধগম্য। শিপ্রা মদ, সিগারেট খায়, বয়ফ্রেন্ড আছে, এটাই নাকি তার চরিত্রহীনতার উদাহরণ। সমাজের বেঁধে দেয়া এই ভালো মেয়ের সংজ্ঞা থেকে আর কবে বের হতে পারবে মেয়েরা?
তানবীরা তালুকদার এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন,
সিগারেট-হুইস্কি শুধু ছেলেদের জন্যে বুঝি? লিভ টুগেদার করা কিংবা একা থাকা শুধুই ছেলেদের ব্যাপার? জিন্স-টি শার্ট ছেলেদেরই পোষাক? বাইরের পৃথিবী, বিশ্ব ভ্রমণ, ফটোগ্রাফি, ভিডিও, ইউটিউব সব পুরুষদের এখতিয়ারে? মেয়ে মানুষকে বুঝি মানায় না, না? প্রশাসন পরিকল্পিত ভাবে শিপ্রার ব্যক্তিগত ভিডিও, ছবি ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়েছে। ১.সিনহা খুনের মামলাকে জাস্টিফায়েড করে ২.নিজেদের আসন রক্ষা করতে ৩.পাব্লিক সেন্টিমেন্ট তাদের পক্ষে আনতে এবং ইট ওয়ার্কড। মেজর সিনহা হত্যার দাবি এখন পেছনে চলে গেছে, তৌহিদী জনতা এখন বিভক্ত, তারা ব্যস্ত “শিপ্রার কখন এবং কেন ওড়না পরা উচিত ছিলো“ এই নিয়ে। পরিকল্পনা করে মেয়েটাকে টার্গেট করা হয়েছে, সিফাত আর নূর নিয়ে কোন পোস্ট নেই। প্রশাসন এই দেশের মানুষের নাড়ি-নক্ষত্র রগেরগে জানে, তারা জানে, মুমিনকূল ওড়না নিয়ে যত ব্যস্ত, জাঙ্গিয়া, চাড্ডি কিংব হাফপ্যান্ট নিয়ে ঠিক ততটাই উদাসীন। “সাতান্ন ধারা“ কিংবা “আইসিটি এক্ট“ কি প্রশাসনের রত্নদের জন্যে প্রযোজ্য নয়? তাদের ইচ্ছে হলে প্রথমে কাউকে মেরে ফেলবে, তারপর অন্যদের পাব্লিকলি ডিফেম করবে? সবই তাদের ক্ষমতার ওপর দেখছি। মদ খাওয়া, জিন্স পরা কি অপরাধ? খুন করা যায় সেজন্যে?
আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে পাশাপাশি।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে,
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের নিহত হবার পর গত এক সপ্তাহে ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে একের পর এক ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে তাকে নিয়ে। তার সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথ এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, ‘জাস্ট গো’ মিস্টার সিনহা রাশেদ ও তাদের একটি স্বপ্নের প্রজেক্ট। কিন্তু চ্যানেল খুললেও ওই ঘটনার আগে তারা সেটিতে কোন ভিডিও আপলোড করেননি। আবার যে ইউটিউব চ্যানেলটিতে তাদের নিয়ে ভিডিও আপলোড হচ্ছে সেটি খোলা হয়েছে ২২শে জুলাই। কিন্তু ভিডিওগুলো সব আপলোড করা হয়েছে মিস্টার সিনহা রাশেদের খুনের পর বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে।
ধারণা করা যায় কী ভয়ানক ঘটনা এটি? মনে পড়ে গেল সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর সাগর সরোয়ারের একটি ব্যক্তিগত পেইজে এরকম আপডেট করা হয়েছিল বেশ কদিন ধরে।
রাষ্ট্রীয়ভাবেই এক ধরনের তথ্যসন্ত্রাসীকে পেলে-পুষে রাখা হচ্ছে। অনলাইনে নারী সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সব ব্যক্তিগত ছবি পাবলিক করে দেয়। কাজেই সেই গোষ্ঠীর সহায়তাতেই যে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
পুরো একটা পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম আজ নারীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। অথচ আমরা নারীরা এখনও ঐক্যবদ্ধ নই, এখনও বিচ্ছিন্নভাবে ‘নিজের কাজ’ করে যাচ্ছি। এটা মনে রাখতে হবে, নারীবাদ বলেন আর নারী অধিকার, নারী নির্যাতনই বলেন, সবটাই রাজনৈতিক। সুতরাং আপনার-আমার রাজনৈতিক আদর্শই বলে দেবে একাত্ম আমরা হতে পারবো কিনা নারীর বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে।