জিন্নাতুন নেছা:
প্রথম আলোর একটি ফিচার পড়ছিলাম, কর্মক্ষেত্রে নারী যত সফল ব্যক্তিগত জীবনে তত সফল না। আরো বলা হয়েছে, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এবং সুইডিশ এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নারী অনেক বড় বড় পজিশনে কাজ করছে, কিন্তু তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নারীরা সেপারেশন কিংবা একা থাকতে বেশি পছন্দ করছেন, তাই বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি ঘটছে।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে গত কয়েক বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে হয়েছে কয়েকগুণ। ঢাকা শহরে প্রতি মিনিটে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে অন্তত দুইটি পরিবারে। এমনকি এই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য বেশিরভাগই আবেদনই আসছে নারীদের কাছ থেকেই। তার মানে সিদ্ধান্তটা নারীরাই নিচ্ছে। ২০১৮ সালের মে মাসের একটি রিপোর্ট দেখা যায়, সাত মাসে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ৩৪% (তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক সফলতাকে। অনেক ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে তাই তারা পরিবার ভেঙ্গে দিতে কোন দ্বিধাবোধ করছে না। আরো বলা হয়েছে, নারী ব্যক্তিগত জীবনে সফল নয়, যতটা সফল তার ক্যারিয়ার জীবনে। অর্থাৎ নারীর ব্যক্তিগত জীবন মানেই হলো সংসার জীবন আর ক্যারিয়ার হলো নারীর পড়ালেখা, আয় উপার্জন ইত্যাদি।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বাংলাদেশে বিয়ে হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বিয়ে এমন একটি ধারণা, যার সাথে অনেক উপাদান জড়িয়ে থাকে। আর খুব অলিখিত বিধান হলো নারীর একবার বিয়ে হয়েছে তা যেমনই হউক না কেন, যত নির্যাতন আর অপমানই চলুক না কেন একমাত্র নারী এবং নারীরই দায় এই সংসারকে টিকিয়ে রাখা। খুব অল্পদিন আগেও নারী শিক্ষার হার তেমন ছিলো না, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ছিলো না, তাই নারী নিজেই এসকল মেনে নিয়ে সংসার টিকিয়ে রেখেছে, নতুবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু এখন নারী অন্তত একটা বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে দুবেলা দুমুঠো ভাতের সন্ধান নিজের জন্য করে নিতে পারবে, তাহলে আর কেন নিজেকে বলিদান কিংবা অপমান, অত্যাচার সহ্য করা! কিন্তু এই সত্যকে অস্বীকার করে যদি নারীর অর্থনৈতিক সাফল্যকেই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দায়ী করেন আমি বলবো এটা চরম বোকামি।
নারী যেন একাই সংসার করে এবং সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার দায় যেন একা নারীর উপরই নির্ভর করছে! সংসার কখনও এককভাবে করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সংসার এমন একটি ধারণা যা অনেকগুলো এককের সমাহার। একটি সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই সবগুলো এককেরই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়। কোন একটি এককের পচন ধরলে সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। তাহলে কেন বিয়ে বিচ্ছেদের এই অধিক প্রবণতার জন্য নারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকেই কেবল দায়ী করা হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। নাকি বলবো সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কি কেবল নারীর কাছেই বর্তায়? নাকি বলবো যে নারী হয়ে জন্মেছেন বলে আপনার কোন সুখ, দুঃখ, কষ্ট, অপমান, সম্মান কিছুই থাকা যাবে না। আপনার পরিবারে লোকজন, স্বামী যা বলবে তা অত্যন্ত অপমানজনক হলেও আপনাকে মেনে নিয়ে সংসার করতে হবে কেননা সংসারটা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারী আপনারই! তা আপনার স্বামী পরকীয়া করুক, কয়েকটা বিয়ে করুক, প্রতিদিন আপনাকে সেক্স করার নামে রেইপ করুক কিংবা মাদকাসক্ত হোক বা নপুংসক হোক, যা ইচ্ছে তা করুক! তারপরও সমাজ কেন নারীকেই এই সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে দেখতে চায় বা প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমি বুঝি না!
আমার মা আমাকে সবসময় বলে, “তোর এই পড়ালেখা করা আর চাকরি করাই হলো তোর জীবনের কাল।“ আমি যদিও কোনদিনও আমার মায়ের এই কথার সদুত্তর খুঁজে পাইনি। খুব নীরবে মাকে বললাম, আচ্ছা মা বলতো, কীভাবে লেখাপড়া আমার জীবনের কাল হলো? আমি তো ভালোই আছি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছি। তাও আবার নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে। এখন উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করছি, দেশবিদেশ ঘুরছি, আমি কীভাবে খারাপ থাকলাম? মা আরো তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়ে বলা শুরু করেন, সংসার কী জিনিস তা তো কোনকালেই বুঝবি না! খালি দ্যাশে দ্যাশে বেটাপোলার লগে ঘুরে বেড়ানো, এরে নাকি বলে চাকরি! আর টাকা কামাই করছিস বলেই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? সংসার দরকার হয় না? মরতে হবে রে একদিন!
আমি চুপ করে শুনি আর বলি আচ্ছা এইবার আমার বাঁচা -মরা নিয়ে কেন লাগলে বলতো?
এতোক্ষণ যা বলছিলাম তা আমার মতো কর্মজীবী কিন্তু ডিভোর্সি কিংবা স্বামী-স্ত্রী আলাদা আলাদা থাকেন তাদের জন্য খুব পরিচিত আলাপ বলেই আমার মনে হয়। কারণ আমার পাঁচ বছরের এই একাকী জীবনে আমি যতবারই বাড়িতে আসি মায়ের সাথে দেখা করতে, মা আমাকে এই কথাগুলো শুনিয়ে থাকেন। আমার মা বিশ্বাস করেন, একজন নারীর শেষ জায়গা হলো স্বামীর ঘর। তার নিজের বলতে কিছুই নাই। তা সে যতোই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী কিংবা ক্যারিয়ার জীবনে সফল হউক কেন? তার কাছে সংসারই আসল সফলতা। বোধকরি আমার মায়ের মতো অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পড়ালেখা না জানা মা থেকে শুরু করে পড়ালেখা জানা মায়েরাও এই ধারণায় বিশ্বাসী। আর তাই আমাদের মা, খালাদের মুখে প্রায়শই বলতে শুনি, ছেলের বউকে চাকরি করাবো না। তাহলে সংসার টিকবে না।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিয়ে এবং সংসারই নারীর ব্যক্তিগত জীবন, কিন্তু আমার অভিমত হলো, নারীর ব্যক্তিগত জীবন হলো একান্তই ব্যক্তিগত জীবন। যে জীবনে আপনার সম্মান থাকবে, আপনার স্বাধীনতা থাকবে অবশ্যই তা স্বেচ্ছাচারিতা নয়,যে জীবনে আপনার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকবে, আপনার মূল্যায়ন থাকবে এগুলো যদি না থাকে সেই জীবনকে আমি ব্যক্তিগত জীবন বলতে নারাজ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি বেশিরভাগ পরিবারেই তা নারী যত বড়ই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী হউক না কেন এই স্বাধীনতাগুলো নারীর থাকে না। এখন আপনারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলবেন, নারী হয়ে জন্মাইছেন, একটু ছাড় তো দিতেই হবে, একটু মেনে নিতেই হবে। হ, ভাই! আমরা নারী হয়ে জন্মাইয়া খুব দোষের কাজ করে ফেলছি। তাই নিজের অস্তিত্বও বিলীন করে দিতে হবে। নিজের নিজস্বতা বলে কিছুই থাকা যাবে না। হ্যাঁ, এইগুলো যদি আমি মেনে নেই কিংবা সমঝোতা করি তাহলে আমার নিজস্বতাই হুমকির মুখে পড়েঁ যায় বৈকি!
এই প্রসংগে একটা গল্প বলি। কয়েকদিন আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম। পাশের বাড়ির এক খালা আমার মায়ের সাথে দুঃখ করছে আর গল্প করছে, বু,মেয়েটারে এতো কষ্ট করে টাকা-পয়সা খরচ করে পড়ালেখা করাইলাম, টাকা (ঘুষ) দিয়ে চাকরিও নিয়ে দিলাম, কিন্তু বিয়ের পর মেয়ের বেতনের টাকা মেয়ে নিজে তুলতে পারে না। জামাইয়ের কাছে চেক থাকে, জামাই নিজেই টাকা তোলে আর মেয়েকে হাত খরচের জন্য টাকা দেয়। আমি জানি অনেক পুরুষ ব্যাটা বলবেন, সংসারে কি বউ টাকা দিবে না? আমিও বলবো, হ্যাঁ, দিবে না কেন? অবশ্যই দিবে। কিন্তু তা একটা পরিকল্পনা করে, শেয়ারিং এর মাধ্যমে দুজনে মিলেই সংসার এর টাকা খরচ করবেন, দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু তা না হয়ে যদি ভিন্নটা হয় তাহলে অবশ্যই তা পারিবারিক নির্যাতনের শামিল। আর এই ধরনের নির্যাতনের ফলে যদি ঐ বউ বিবাহ বিচ্ছেদ চায় কিংবা সেপারেশনে যায় তাহলে আপনি, আমি কিংবা সমাজ বলবো, বউয়ের টাকা হইছে, চোখ খুইল্যা গেছে, এখন কি আর স্বামীর দরকার আছে! আমি বলি খুব দৃঢভাবেই বলি, বউয়ের এমন স্বামীর দরকার নাই, সংসারের ও দরকার নাই!
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০১৪ সালে ২৯৭ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অন্তত যৌতুকের কারণে খুন হয়েছেন ১২৬ জন নারী, ১০৮ জন যৌতুক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আর ৯৫ জন পালিয়ে এসে মামলা দায়ের করেছেন। এই যে ৯৫ জন মামলা করেছে সেপারেশনে থাকছে, বিবাহ বিচ্ছেদ হবে, আপনি বলবেন এর জন্য নারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দায়ী?
বিবাহ বিচ্ছেদের হার এবং সেপারেশনের হার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে আপনি যদি নারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে দায়ী করেন এটা আমি মেনে নিবো না, বোধ করি সচেতন মহল কেউই তা মেনে নিবে না। অন্যদিকে সংসার না করা বা একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া মানেই আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে অসফল কিংবা ব্যর্থ ও আমি মানতে নারাজ। কারণ ব্যক্তিগত জীবন মানেই সংসার নয়। সংসার ব্যতীত আপনার জীবনে অনেক কিছুই থাকতে পারে যা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত। অন্যদিকে নারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ামক নয়। বরং আমি বলবো নারী সচেতন হয়েছে তাই পূর্বের মতো আর মুখ বুঁজে নির্যাতন সহ্য করছে না। তাই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। আমি তো বলবো এটা নারী সচেতনতার আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ারই প্রতিফলন।
লেখক:
নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক।