অনুতাপ

ফাহমিদা খানম:

মৃত্যু যে এমন হুট করে এসে গোছানো জীবনটাকে এলোমেলো করে দিবে আমি কল্পনাও করিনি। নীলু আমার ৩০ বছরের সঙ্গী, হুট করেই চলে গেলো – বাপ-ছেলে খবর পেয়ে হাসপাতালে যখন পৌঁছেছিলাম একবার মাত্র চোখ খুলে তাকিয়ে ঠোঁট নড়েছিলো – নীলু কি কিছু বলতে চেয়েছিলো? বৃষ্টির পর রংধনু দেখতে ছাদে উঠেছিল, পা পিছলে পড়ে যাবার পর অন্যরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, ব্রেন হেমারেজ হয়েছিলো।
খবর পেয়ে ওর ভাইবোন আর বৃদ্ধা মা সিরাজগঞ্জ থেকে চলে এলো, আমি বুঝতে পারছিলাম না সন্তানহারা মাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় অথবা মা হারা সন্তানকে!

“ওর আশায় আমি থাকতাম – ছোট মেয়েটা বিয়ের পর বছরে একবার যেতো, আমি এখন কার অপেক্ষায় বেঁচে থাকবো?”

নীলুর উপরে সংসার ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম এখন প্রচণ্ড অসহায় লাগছে –এতোটি বছর নীলু একাই সব কীভাবে সামলেছে! সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পরে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলো – ভয়ংকর নিস্তব্ধতা বাড়িটা জুড়ে, অথচ মাত্র একজন মানুষের অভাব। ছেলে নিজের রুম থেকে খুব একটা বের হয় না, বুয়াটাও কাজের পর চলে যায় – এই প্রথম আমি অনুভব করলাম একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা কতোটা ভারী, অথচ নীলু সবসময়ই এই অভিযোগ করতো আমাকে।

লেখক: ফাহমিদা খানম

“তুমি তোমার জগতে, ছেলেও ওর জগতে, আমি যে কতোটা একা থাকি?”
“টিভিতে সিরিয়াল দেখলেই পারো, আমার বোনেরা সবসময়ই দেখি টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকে”
“ওসবে আমার আগ্রহ নেই”
আমরা কি খুব সুখী দম্পতি ছিলাম নাকি দুজনেই ভান করে গেছি জীবনমঞ্চে? নীলু যাবার পর এখন আমার একদমই বের হতে ইচ্ছে করে না।
“এই রান্নাগুলো আর কখনো করবেন না খালা, আর বারান্দার গাছে মাঝে-মধ্যে পানি দিয়েন, মারা যাচ্ছে তো”
“আপনি এসব পছন্দ করতেন বলে আপা সবসময়ই এসব রান্না করতো, গাছে পানি তো দেই, কিন্তু আপা সবসময়ই কইতো গাছেরও নাকি যত্ন নিতে হয়, না হলে মরে যায়”

কথাটায় কী ছিলো? দুজনেই চমকে গেলাম –
“মা মারা যাবার পর আমার পছন্দ বদলে গেছে খালা, এসব আমি এখন আর পছন্দ করি না”
ছেলে না খেয়েই উঠে গেলো –এই মুহূর্তে নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে – সত্যি বলতে কি ছেলের পছন্দগুলো আমারো ঠিক সেভাবে জানা নেই, আসলে আমি কি জানতে চেয়েছি কখনও? সবকিছু স্ত্রীর উপরে ছেড়ে দিয়ে কী নিশ্চিন্ত ছিলাম না!
রাতে ঝুম বৃষ্টি নামলো – জানালা বন্ধ করতে গিয়ে অনেক বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো, নীলুর বৃষ্টি নিয়ে মাতামাতি ছিলো খুব, আমার সেসব একদম পছন্দই হতো না –

“এই চলো না বৃষ্টি দেখি?”
“বৃষ্টি কি দেখার জিনিস? আমি এখন খবর দেখছি, এসব আদিখ্যেতা একদম ভালো লাগে না নীলু”
নীলু কি আমার কথায় কষ্ট পেতো না আহত হতো! আমি কখনও বোঝার চেষ্টা না করলেও নীলু আমাকে ঠিকই বুঝতো – বড়ো অভিমানিনী ছিলো, কিছু বললেই সামনে থেকে সরে যেতো, হয়তো আড়ালে গিয়ে কান্নাই করতো।

“আমার সাথে একটু ছাদে চলো না?”
“রাতে ছাদে কী কাজ?”
“কী সুন্দর পুর্ণিমা, ঢাকা শহরে খোলা মাঠ নেই এক ছাদই ভরসা”

আমার বিরক্তিভরা চেহারা দেখে বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো, বিয়ের পরেও দেখেছি অসম্ভব প্রাণচঞ্চল আর হাসিখুশী ছিল। কবে কখন বদলে গেছিলো? এতো নরম মনের ছিলো – খুব অল্পতেই মানুষকে বিশ্বাস করতো, বাবার বাড়িতেও খুব একটা যাওয়া হতো না ওর – একা বেরুতে সাহস পেতো না, আর আমিও ছুটি পেলে কিংবা ঈদে বাড়িতেই যেতাম।

“আচ্ছা একটা ঈদ তোমাদের বাড়ি আর একটা ঈদ আমাদের বাড়িতে করলে কী হয়? মা কতো আশা করেন!”
“তোমার কি মাথা খারাপ হইছে? আমি কেন শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করতে যাবো? আর আমাদের সব ভাইয়ের বউরা শ্বশুরবাড়িতেই ঈদ করে”

একান্নবর্তী পরিবারে ঈদের দিন নীলুর সাথে দেখা হতো রাতে —
“এ কেমন ঈদ? আমি আর ভাবিরা সারাদিন রান্না করছি, মেহমানদারি করছি দিনের লম্বা সময় রান্নাঘরেই কেটে যাচ্ছে!”
“এটাই ঈদের আনন্দ, আমাদের মায়েরা, নানীরা এতেই আনন্দ পেতেন”
“বিয়ের আগের ঈদ আর পরের ঈদ সম্পুর্ণ অন্যরকম। আচ্ছা তুমি একা ঘুরে বেড়াও কেনো? আমার বুঝি বেড়াতে ইচ্ছে করে না?”
“কী যে সব বলো না! আমি এখানে বড়ো হইছি না, ঈদের সময় সবার সাথে দেখা হয়, আড্ডা দেই, বউ নিয়ে ঘুরলে এসব মিস করবো”
“আমারও ঘুরতে ইচ্ছে করে, আমারও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বিয়ের পরে বুঝলাম বিয়ে হলে কতো কী ছাড় দিতে হয়!”
“আমরা কি কম ছাড় দেই, সেসব তোমাদের চোখে পড়ে কই?”
“ওসব কেতাবি ভাষা– আমি তো দেখি না কাউকেই ছাড় দিতে!”

নীলু এভাবেই কথা বলতো বলে মাঝে-মধ্যে ভীষণ বিরক্ত হতাম আমি। অথচ আমি নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম ওকে। বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে এতো ভালো লেগেছিলো, অসম্ভব হাশিখুশি আর প্রাণচঞ্চল মেয়েটাকে না পেলে জীবন বৃথা মনে হয়েছিলো!
জটিলতা নীলুর মধ্যে একদমই ছিলো না, যা মনে আসতো অকপটে বলে ফেলতে গিয়ে সবাইকে বিব্রতে ফেলতো, একবার বাড়িতে গিয়ে মাকে বলেই ফেললো—
“আচ্ছা মা মেয়ের জামাইরা জামাই আদর পায়, মেয়েরাও বিয়ের পর বাপের বাড়ি বেড়াতে এলে মূল্যবান হয়ে যায়, শুধু বউরা কম দামি কেনো?”

ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলো মা আর বোনেরা, মায়ের কান্নায় আমি সবার সামনেই ওকে চড় মেরে নিজের পৌরুষত্ব প্রকাশ করে সবার বাহবা নিলেও সেদিনের সেই অবাক করা দৃষ্টি আজও ভুলতেই পারি না – আমি তো অন্তত জানতাম আমার স্ত্রী ভুল বলেনি, তবুও কেনো তার পাশে দাঁড়ানোর সাহস করতে পারিনি! ভয়ংকর অপমানে নীলুর মুখ কালো হয়েছিল – নিজেকে আয়নায় দেখতে ভয় লাগে আমার – মাফ চাইবার কথাও মনে আসেনি নাকি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছিলাম! এই হাসিখুশী নীলুকে খাঁচায় পুরে ওর সব আনন্দ আমিই কেড়েছিলাম।

“চলো না কোথাও ঘুরতে যাই? বাবু বড়ো হলে আর ঘুরতে পারবো না”
“গত বছর না তোমাদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এলাম? আর এতো ঘোরাঘুরির কী আছে?”
“কতো কি দেখতে ইচ্ছে করে আমার জানো? দেখবে একদিন সব হবে, কিন্তু আর ঘোরা হবে না”
“ছেলে বড়ো হলে তোমাকে বিশ্ব ঘুরে দেখাবে”
“স্বামীই যদি স্ত্রীর শখ না বুঝে, সন্তানের কাছে আমি আশা করি না”

অন্য কোনো শখ নীলুর ছিলো না, না শাড়ি না গহনা – সামান্য ফুল পেলেই ও খুশি হতো, বেচারি বিয়ের পর লম্বা ঘুরার জন্যে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলো, আমার জ্বর শুনেই চলে এসেছিল, বাবুকে নিয়ে আরেকবার গেলো বেড়াতে –পেট খারাপ শুনে আমিই নিয়ে এসেছিলাম। আর সেভাবে বাপের বাড়িতেও যেতে পারতো না, আমিই সময় পেলে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম বলে। বিয়ের পর অভিমান করতো, কান্নাও করতো, তারপর আস্তে ধীরে কখন যে বদলে গেলো! আজকাল জীবিত নীলুর চাইতে মৃত নীলু বেশি জ্বালাচ্ছে – প্রায় রাতেই আমি পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমি ওর প্রতি সুবিচার করিনি – শুধু নিজের ইচ্ছেগুলোকে ওর উপরে চাপিয়েই গেছি মাত্র!

“জিয়ান, তুমি বড়ো হয়ে কী হবে?”
“আমি মাকে নিয়ে ঘুরবো বিদেশে”
“কীরে ব্যাটা, মাকে নিয়েই ঘুরবি আর আমাকে নিবি না?”
“তোমার কি সময় হবে বাবা? তুমি তো ঘুরার কথা বললেই বিরক্ত হয়ে যাও বাবা, তাই তুমি বাদ”

তিনজনেই হেসে ফেলেছিলাম সেদিন মনে আছে, কিন্তু এসব কথা কবেকার! জিয়ানের এসএসসির পরের না আগের! আজকাল এতো অফুরন্ত সময়, তবুও সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নীলুর চোখ চকচক করতো এসব শুনে, আমি এখনও চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাই।
চল্লিশার দিন কাছে আসতেই জিয়ানের কাছে গেলাম, ছেলেটা অনেক শুকিয়ে গেছে – ওর জগত ছিলো মাকে নিয়েই, নীলুও ছেলেকে কলেজ পর্যন্ত ছাড়েনি, সবসময়ই ছেলের সাথে থাকতো। তখন ছেলে মাঝে-মধ্যে বিরক্ত হয়ে বিচার দিতো। পড়া শেষ করে একটা জব করছে, বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্যে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

“জিয়ান, তোমার মায়ের চল্লিশাটা আমি গ্রামে বড়ো করে করতে চাই”
“জীবিত মাকে বাদ দিয়ে মৃত মাকে নিয়ে এসবের কি দরকার আছে বাবা?”
“এসব কী বলছো তুমি? আমি আমার ৩০ বছরের সাথীকে হারিয়েছি”
“আমার কাছে তা মনে হয় না বাবা, তুমি তোমার জগত নিয়ে ছিলে, আমি আমার জগতে, আমার মা নিঃসঙ্গ একাকি ছিলো”
জিয়ানের বুকফাটা আর্তনাদে কে যেনো আমার শিরার স্নায়ু ধরে মোচড় দিলো – বুকের ভেতরে ভয়ানক যন্ত্রণা শুরু হলো — এতো বড় সত্যটা জিয়ান বুঝতে পেরেছিলো!

নীলু সবসময়ই দোয়া করতো সে যেনো কখনও বিছানায় না পড়ে – কে দেখবে তাকে? কারও করুণায় যেনো তাকে বাঁচতে না হয় – আল্লাহপাক নীলুর কথা রেখেছেন।

“বাবা আমার কাগজপত্র সব চলে এসেছে, আমি আগামী মাসেই ফ্লাই করবো”
“আমি কী নিয়ে থাকবো জিয়ান?”
“আমি একটু থিতু হয়েই তোমাকে নিয়ে যাবো”
জিয়ানের কান্নার সামনে আবারও অসহায় লাগছে আমার, মা – ছেলের কতো পরিকল্পনা ছিলো! এই কথাটা মাকেই সবসময় বলতো ছেলে, আজকে প্রথম বললো আমাকে।

জীবনের লম্বা সময় আমি সংসার, স্ত্রী, সন্তানকে সময় না দিয়ে শুধু নিজের ব্যবসাটা বড়ো করার কথাই চিন্তা করে গেছি, কী হবে এসব দিয়ে? কে ভোগ করবে এসব? ছেলের গলার সুরে বুঝে গেছি তার আর পিছুটান নেই। আমি টাকা দিয়ে সংসারের দায়িত্ব সেরে আত্মতৃপ্তিতে ছিলাম – ওদের কাছের একজন হবার চেষ্টা করিনি, তাই নীলু যাবার পরেও ছেলে বাবাকে একা রেখে যাচ্ছে, ছেলের সেই টানের সুতো আর নেই।

শ্মশানে চিতা জ্বললে সেটা দেখা যায়, কিছু মানুষের বুকের ভেতরেও আগুন জ্বলে – নীলু নেই, সেই শোকের হাহাকার ছাপিয়ে আমার একাকি জীবন কীভাবে কাটবে সেটাই ভাবছি। অনুতাপের হাহাকার আমাকে আমৃত্যু আছড়ে-পিছড়ে মারবে – আমি কাউকেই সে কথাগুলো বলতে পারবো না।

“ফিরে চলে যায়, যে সময় হায় একবার
তার যাওয়া আছে, আসা নেই”।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.