সুপ্রীতি ধর (২০ আগস্ট ২০১৩): মাত্র দুদিন আগেই একজন সাংবাদিক বন্ধু, সহকর্মী জাহিদ নেওয়াজ খান তার লেখায় লিখেছেন, ‘ইট-কাঠ-কংক্রিটের শহরে আমাদের মনও রড-সিমেন্ট দিয়ে গড়ে উঠছে, যেখানে মাঠ না থাকার মতো সবুজও অনুপস্থিত। আমরা কি আমাদের হৃদয় হারাতেই থাকবো, নাকি ঐশীদের রক্ষায় নতুন বিনির্মাণের কথাও ভাববো, সেকথা ভাবার সময় এসেছে। ঐশীর ঘটনা কি ওয়েক আপ কল হবে’?
সেই থেকে মাথায় একটি কথাই ঘুরছে আমার, ঐশীর ঘটনা কি ওয়েক আপ কল হবে? হোক বা না হোক, ডোরবেল কিন্তু বেজে গেছে আমাদের প্রতিটি পরিবারে। এখন আমরা কি উঠে গিয়ে দরজা খুলবো, নাকি দরজা আরও আঁটসাট করে বন্ধ করে ঘুমাবো, তা একান্তই আমাদের বিষয়।
গত পাঁচদিন ধরে এমন একটি মানুষও নেই, যে কিনা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার মতোই সাড়া ফেলেছে ঐশীর বাবা-মায়ের মৃত্যু। শোকের চেয়েও ছাপিয়ে গেছে খোদ ঐশী ইস্যু। ও বেঁচে থেকেই আজ সমাজ সংস্কারের এক জ্বলন্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে এখন দু:শ্চিন্তা, কান্না, আহাজারি শুনতে পাই। প্রায় প্রতিদিন হিসাব করে ফোন কল পাই বন্ধু-বড় বোন এমনকি ভাইদের কাছ থেকেও। সবাই নিজের নিজের ঘর নিয়ে চিন্তিত। কি করা যায়? কিভাবে বাঁচানো যায় এই প্রজন্মকে? বাঁচানো কি আদৌ সম্ভব?
এর উত্তর আসলে আমাদের কারোরই জানা নেই। সবাই একবাক্যে দোষারোপ করছে এদেশের নষ্ট রাজনীতিকে। বলছেন, গত ৪২ বছরে যে নষ্ট রাজনীতির চাষ হয়েছে দেশে, তাতে সব পচে-গলে শেষ হয়ে গেছে। কংকালটাও আজ আর নেই।
আজ একজন বলছিলেন, যদিও ঐশীর মা-বাবা খুনের ঘটনা খুবই নৃশংস, কিন্তু এটা সময়োচিত একটি ঘটনা। মাত্র একটি ঘটনাই আজ পুরো দেশের মানুষের চোখের সামনে টেনে রাখা পর্দা উন্মোচন করে দিয়েছে। অনেকেই আজ দেখতে পাচ্ছেন তারা কিসের চাষ করে চলেছেন দিনের পর দিন! কিসের নেশায় ছুটছেন তারা!
এক ঐশীর আলোচনা করতে গিয়ে নষ্ট রাজনীতির পাশাপাশি চলে আসছে আরও অনেকগুলো ইস্যু। এদেশের হঠাৎ ধর্মচর্চার বাড়াবাড়ি, হিজাব-বোরকার মহামারী, দুর্নীতি-দু:শাসন সব যেন একই সুতায় বাঁধা। এক বড় ভাই বলছিলেন, তার পরিচিত একজন জীবনে হজ্ব করেছেন অনেকবার, আর ওমরাহ হজ্বের কথা উনি মনেই করতে পারেন না। এতো টাকা খরচ করে এতোবার হজ্ব করার পিছনে আর যাই হোক, কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া টাকার বৈধতা দিতেই এই তোড়জোর, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই টাকা দেশের দারিদ্র্য দূর করার কাজে লাগালেও হজ্বের চেয়ে বেশি পূণ্য অর্জন হতো।
টাকার প্রসঙ্গে আরও কথা হলো। এতো কালো টাকার ছড়াছড়ির পিছনে আরও একটি কারণ হলো গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অঢেল টাকা এসেছে মসজিদ বা ধর্মীয় কাজে ব্যয়ের জন্য। কাজেই কিছু না কিছু জায়েজ তো করতেই হয়। আর এসব কাজ করতে গিয়ে কোথায় কবে নৈতিকতা, আদর্শকে বলি দেয়া হয়ে গেছে, সেই খোঁজও পাননি অনেকে।
বেশ কয়েকজনের সাথে আলোচনার ফলাফল অনেকটা এরকম।
টাকার সাথে সাথে এসেছে নিজের স্ট্যাটাস রক্ষার লড়াই। একশ্রেণীর মানুষ নব্যঅর্জিত টাকা দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছেন সামাজিক পদমর্যাদা, বংশ পরিচয়। কিন্তু এতে করে যে পারিবারিক শিক্ষার পরিবর্তন ঘটে না, তা তারা স্বীকার করতেই নারাজ। তিন পুরুষ-চার পুরুষের শিক্ষার যে তেজ, যে মহিমা, তা এক পুরুষে কি অর্জন হয়? টাকা, ধর্ম এবং নব্য স্ট্যাটাস সবমিলিয়ে একটা লেজে-গোবরে অবস্থা। এই পুরুষের কেউ এ বি সি ডি না জানলেও স্ট্যাটাস রক্ষার্থে চাই ইংরেজি বুলি। আর সেই বুলি আওড়াতে আছে টাকা, তাই ঢালো টাকা। লেখা এবং পড়া আদৌ হলো কি হলো না, তা কে দেখবে, ছেলে আমার-মেয়ে আমার ফুটফাট ইংরেজি বলে, ইংরেজি মুভি দেখে, কম্পিউটারে গেইম খেলে, অদ্ভুত সব পোশাক পরে, তা দেখে বাবা-মায়ের চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা, আমার ধন, বংশের রতন, সেই করবে রক্ষা, নতুন বংশ মর্যাদা।
কিন্তু এর ভিতরে ভিতরে কী অসম পরিমাণ অন্ধকার যে বাসা বেঁধে আছে, সেই দেখার চোখ কোথায় আমাদের? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, বিদেশি বুলির সাথে কখন যে পাশ্চাত্যের উচ্ছন্নে যাওয়া সংস্কৃতি ভর করে ফেলেছে, সেই খেয়ালও করিনি। তারই পরিণাম আমরা দেখলাম ঐশীর ঘটনায়।
এখন এ থেকে আমাদের মুক্তির পথ কী? গত চার দশকের ভুলের চারাগাছ আজ বিরাট মহীরুহ আকার নিয়েছে, কত বছরে সেই গাছ আমরা উপড়াবো, আদৌ উপড়াতে পারবো কিনা, কে জানে! মায়েরা ফোন করছেন, বলছেন, ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কেন জানি মনে হচ্ছে, দেশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, যে জাগরণ দেখে আমরা মধ্যবিত্তরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিলাম এই ভেবে যে, না, একেবারে উচ্ছন্নে যায়নি এই প্রজন্ম। সেই আমরাই আজ সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। ভাবছি, শাহবাগের সেই প্রজন্ম আর ঐশীদের প্রজন্মের মধ্যে সংখ্যাগত পার্থক্য কতখানি!
আমরা জানি যে, গণজাগরণ প্রতিহত করতে সুড় সুড় করে বেরিয়ে এসেছে হেফাজতে ইসলাম, সেই জাগরণেরই শাপেবর হয়েছে ঐশীর এই ঘটনা। না, এটা মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা নববর্ষ, পহেলা ফাল্গুনে বাঙালীর যে জাগরণ দেখি, তার চেয়েও অধিকসংখ্যায় বাড়ছে বিপরীত জাগরণ।
তবে আশার কথা, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। নিজের ভালমন্দ বিচার তারা করতে শিখেছে, আত্মোপলব্ধি ঘটেছে। আজ আমরা একটা খুনের মধ্য দিয়ে পুরো ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার সবকিছুকে এককাতারে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারছি। বলতে পারছি আমাদের গলদটা আসলে কোথায়!