জীবন মানেই থামতে মানা

কৃষ্ণা দাশ:

মেয়েটির মাত্র বারো ক্লাস পাশের পরই বিয়ে হয়ে যায়, যেখানে অন্য সবাই নতুন কলেজে ভর্তির দৌড়ঝাঁপ নিয়ে ব্যস্ত, মেয়েটি তখন নতুন পরিবেশে খাপ-খাওয়াতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছিল। এক মধ্যবয়সী লোকের হাতে কী জানি কী বুঝে তুলে দিয়েছেন বাবা-মা, এখনও মাঝরাত্রিরে তার হিসেব মেলাতে বসে মেয়েটি। লোকটি যখন সংসারের হিসেব কষায় ব্যস্ত, মেয়েটি তখন ঘাস ফড়িং এর ডানায় স্বপ্ন বুনে৷ বিয়ে মানে কী বুঝেছিল, ওই ছোট্ট প্রাণ কী জানি! তবু প্রচণ্ড স্বপ্নবাজ মেয়েটি সব ছেড়েও স্বপ্ন ছাড়েনি।

বিয়ে মানেই থেমে থাকা না, জীবন মানেই থামতে মানা, এটা মেয়েটি বুঝতো। তাইতো মেয়েটির প্রথম সন্তান যখন ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষা দিচ্ছে, মেয়েটিও মাস্টার্স পরীক্ষার হলে বসেছিল। থামতে মানা, এই শ্লোক মনে গেঁথে নিয়েছিল, এরপর একে একে আরো নানাবিধ কোর্স করে নিজেকে যোগ্য করার পণে নেমে পড়েছিল। একসময় দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়, তারপরও ছুট ছিলো, ওই যে থামতে মানা। একে একে বিভিন্ন চাকরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রতে নেমেছিল।
থেমে যেতে পারতো মেয়েটি, থেমে যেতে পারতো স্বপ্ন। গল্পটা পড়তে যতোটা ছোট, বয়ে নেয়ার পথটুকু অতটা ছোট আর মসৃণ ছিল না মোটেও। কোথায় যেন জিদ ছিলো, থামা যাবে না।

চাইলেই অন্য যেকোনো নারীর মতই হেঁসেল ঠেলে, বাচ্চা সামলিয়ে দিব্যি সংসার ধর্ম পালন করতে পারতো৷ করছে তো অনেকেই, এরপর অদৃষ্টের দোষও দিয়ে নিজে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব কি ওই অদৃষ্ট/নিয়তির দোষ? ইচ্ছা শক্তিরও কি অভাব না? জীবন চলার পথ কি এতো সোজা?

মেয়ে/নারীদের জীবন আরো কঠিন। তাই বলে কি থামলে চলবে? কিছু করার ইচ্ছা শক্তিটা নিজের মধ্যে জাগ্রত হতে হবে, তবেই হয়তো মুক্তি সম্ভব। মুক্তিটা কেবল নারীর না, মুক্তিটা চেতনা বোধের, জাগরণের। যুগে যুগে সমস্ত ভালো কাজের ক্ষেত্রেই হাজার হাজার বাঁধা এসেছে, আসবেও, তাই বলে থামলে চলবে কেন?

এরকম ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন তো কিছু না৷ বাবা-মায়ের এরকম অবিবেচনাও নতুন কিছু না। মেয়ে মানেই বোঝা, বোঝা যত তাড়াতাড়ি অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায় ততই মঙ্গল। সেটা যেমন আগেও ছিল, এখনও আছে। এখনো আমাদের সমাজে অনেক মেয়েদেরই ১২/১৩ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। যতই বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা হোক না কেন, যতদিন আমাদের সমাজ তা না মানবে, যতদিন সমাজের বোধগম্য হবে যে, বাল্য বিবাহ আসলেই একটা কুপ্রথা ততদিন তা আটকানো সম্ভব না। সদরে না হোক, গোপনে ঠিক তা চালু থাকবে।

কয়েকমাস আগে আশাপূর্ণা দেবীর ‘সত্যবতীর ট্রিলজি’ উপন্যাসটি পড়ছিলাম, তিনটি উপন্যাস, একেকটা পড়ছি আর অবাক হচ্ছি। ওই সময়ে কি করে নারী মুক্তির সম্পর্কে এতোটা পরিষ্কার ধারণা সম্ভব? উপন্যাসটির প্রথম প্রকাশ বাংলা সন ১৩৭১, সময়কালটা অবাক করছে। তার মানে আগেও নারীর পদমর্যাদা যেমনটি ছিল, এখনও তাই আছে৷ একই জিনিস, শুধু চাকচিক্যময় প্যাকেটজাত। তখন নারীদের শোষণ করা হতো, এখনও হচ্ছে৷ এখন হয়তো নারীশিক্ষার পথ অনেকটাই খোলা, লাভ কী তাতে? সেই তো ডিগ্রিগুলো বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকছে। বিশেষ একটা অংশ হয়তো ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে জীবিকার তাগিদে, তারপরও যে বিষয়টা আজও প্রশ্নবিদ্ধ, এই বিশেষ অংশ কি আদৌ পরাধীনতার রুদ্ধদ্বার ভেঙে বেরুতে পেরেছে? আদৌ কি তাদের মনে চেতনাবোধ জাগ্রত হয়েছে?

কেন বলছি? কারণ বেশিরভাগই দেখি আইন প্রয়োগের বেলায় নিজের জন্য এক আইন আর অন্যদের বেলায় ভিন্ন আইন। এরা এদের পছন্দ মতো আইনের যথেচ্ছা অপপ্রয়োগ করে। নারী মুক্তি মানে সমাজের সকল স্তরের নারীর জন্যই এক আইন। নারী মুক্তি মানেই সুবিধা মতো আইনকে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে নিজের মতো ব্যবহার করা না। নারী মুক্তি মানেই সংসারবিমুখ হওয়া না। কিংবা নারী মুক্তি মানে পুরুষ বিরোধিতা নয় মোটেও, সৃষ্টিকে থামিয়ে দেয়া মোটেও নারী মুক্তির লক্ষ্য না, হতে দেয়াও ঠিক না।

নারী মুক্তি মানে নিজেকে এবং সমাজের সকল স্তরের লোকেদের সমান ভাবা। এখানে পুরুষ যেমন সুপ্রিম না, তেমনি সমাজের নিচুস্তরের কাজ করা মেথরানীও ছোট না। সমাজের উঁচু স্তরে থাকা যে কারোর মতই মেথরানীরও নিজের ন্যায্য দাবি, অধিকার, বাকস্বাধীনতা, অবস্থা আর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করবার অধিকার আছে। ইচ্ছে করেই আমি বারবার নারীমুক্তি শব্দটা ব্যবহার করছি, নারীবাদ শব্দটা এড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ আমাদের কিছুসংখ্যক স্ব-ঘোষিত নারীবাদীরা নারীবাদ শব্দটাকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছেন। এরা আসলে নারীবাদীর চাইতেও অধিক পরিমাণ সুবিধাবাদী। ভয় হয়, এদের আইন আর অধিকারের ব্যাখ্যা শুনলে। তাই নারীবাদ শব্দটা এড়ায়, আসলে তা ওইসব মুখোশধারী নারীবাদীদের এড়ানো।

উপন্যাসটি পড়ার পর থেকেই যে প্রশ্নগুলো বারবার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল তা হচ্ছে, কী করে নারীদের অধিকার নিয়ে লেখকের এতো পরিষ্কার ধারণা ছিলো? তথাকথিত কোন জেন্ডার-ইকুয়ালিটি কোর্স কি লেখকের ছিলেন? পরে যে জায়গায় এসে উপন্যাসটির মর্ম উপলব্ধি করেছিলাম তা হচ্ছে, বাংলার সমাজ ও পরিবারের অন্তঃপুরে আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তা লেখক তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, কারণ যে ব্যক্তির নিজের মানমর্যাদা নিয়ে সচেষ্ট, নিজের আত্মসম্মান বোধ নিয়ে টনটন, তার মধ্যে পরাধীনতা মেনে নেয়া কিছুতেই সম্ভব না। তার মনে প্রশ্ন জাগবেই, এবং সে উত্তরগুলো খুঁজে ফিরবেই। মানুষ, নারী পুরুষ মাত্রই। তবু সামাজিক মর্যাদা, অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন, আইন ও অধিকারের ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য। আর তা যেকোনো বিবেকবান মানুষেরই দৃষ্টি এড়াতে পারবে না কিছুতেই।

থাপ্পড় মুভিটা নিয়ে অনেক রিভিউ ইতিমধ্যে চোখে পড়েছে। এক কথায় বললে বলা যায়, সবার আগে নিজেকে নিজের সম্মান করা। পথটা কঠিন, কিন্তু দুর্গম নয়। মুভির ক্ষেত্রে খুব রিসেন্ট একটা মুভি খুব ভালো লেগেছে তা হচ্ছে, বিদ্যা বালানের ‘শকুন্তলা দেবী’। আর পাঁচজনের মতই শকুন্তলা দেবীর মেয়েও সারাজীবন শকুন্তলার মধ্যে মাকে খুঁজেছে। সাধারণ একজন মা খুঁজেছে। যখন মেয়েটি নিজে মা হলো, তখন গিয়ে বুঝলো তার মা শকুন্তলা দেবী মায়ের সাথে সাথে, একা ধারে এক নারীও বটে। তাঁরও ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে, তাঁরও নিজের মতো বাঁচার অধিকার আছে। তিনি কেবল মা-ই ছিলেন না, ছিলেন জিনিয়াস মা।

ভাললাগা আর মুগ্ধতা কাজ করে এমন উপন্যাস পড়ে, দৃষ্টি আরও পরিষ্কার হয়। পাশাপাশি এ ধরনের মুভিগুলো চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায়। মেয়েরা/নারীরা স্বপ্নবাজ হোক, কল্পনার পাখা মেলুক, চোখের সাথে মন দিয়েও দেখুক চারিপাশটাকে, প্রচুর আশাবাদী হোক, আলো আসবেই।

শেয়ার করুন: