আমাদের চড়ুই পাখি, কুকুর ছানা, গাছ আর ঘরের গল্প

neela haque
লীনা হক

লীনা হক (২০ আগস্ট ২০১৩): প্রতিদিন ভোরে ব্যালকনিতে কিচিরমিচির করতে থাকা আমার চড়ুইগুলোকে মুড়ি খেতে দিয়ে আমি বসে বসে চায়ে চুমুক দেই । এত ভালো লাগে মেধা, আমার মেয়ে, যাকে আমি ডাকি ‘ছোট পাখী’ বলে, সেই পাখী অনেক রাগ করে, চড়ুইদের কিচকিচানিতে ওর নাকি ঘুমের অসুবিধা হয়। কিন্তু আমার তো ভোর বেলা ব্যালকনিতে বসে চড়ুইদের সাথে কিছু সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগে । ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে ছড়িয়ে দেয়া মুড়ি বা চালের দানা খেতে খেতে আবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা । একটা মাটির পাত্রে পানি দেই ওদেরকে। একটু আগ্রহী আর দুষ্টু ছানারা আমাকে পাশ কাটিয়ে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গিয়ে কিচিরমিচির শুরু করলেই মেধার মেজাজ খারাপ হয় আর আমাকে বলতে থাকবে তোমার পাখিদের সামলাও, ওরা আমাকে ডিস্টার্ব করছে ইত্যাদি । পাখির ছানার যেন বয়েই গেছে আমার কথা শুনতে !

নিজের ছানাই শুনে না! তবু ভাবলাম যদি খাবার না দেই তাহলে হয়ত ওরা আসবে না , সিপারের ভাষায় চড়ুই ছানাদের খাওয়ানো ওদের মা-বাবার দায়িত্ব, আমার নয় ! আবার ঠাট্টা করে বলে মুড়ির সাথে একটু চানাচুরও দিয়ে দিতে পারো ! কিন্তু অবাক কাণ্ড, দু এক দিন আগে ভোরে মুড়ি না পেয়ে ওদের কিচিরমিচির যেন বেড়ে গেলো আর এই কিচিরমিচিরের ভাষাটাও যেন একটু অভিমানী ! কেউ কেউতো আমার গায়ের কাছে এসে কিচমিচ করতে লাগলো যেন বলছে আমাদের খাবার কই ? কেমন করে আমি ওদেরকে খাবার না দিয়ে পারবো ! মেধা যতই রাগ করুক আর সিপার যতই খেপাক, আমি শুনি না ……….আর মজা হলো চড়ুই গুলো অন্য ফ্ল্যাটে যায় না , ওরাও মনে হয় বুঝে গেছে আমার দুর্বলতা ………চড়ুই ছানা পোষার (একটুখানি খাবার দেয়াটাকে যদি পোষা বলা যায় আদৌ !)

পজিটিভ দিকটা হলো নিজের সময় বা এনার্জি ব্যয় করতে হয় না কিন্তু আনন্দ পাওয়া যায় ! আর কেউ ওদেরকে চুরি করে নিয়ে যাবার ভয় নাই । একটু বড় হলে ওরা আর আসে না বোধহয় আমার কাছে মুড়ি খেতে ! কে জানে , চড়ুইদের চেহারা আলাদা করে বুঝতে পারি না তো । বসুন্ধরার এইদিকটাতে এখনো খোলা সবুজ মাঠ কিছু অবশিষ্ট আছে , তবে যে হারে বাড়ী তৈরী হচ্ছে , কতদিন থাকবে কে জানে ! আমার চারতলা থেকে নীচে তাকালে দেখা যায় কড়ই গাছের সারি, জলে ভেজা সবুজ পাতা আর ফিকে গোলাপী রঙের ফুল হাওয়ায় দুলছে । আমার ব্যলকনিতে টবে রাখা গাছ গুলোও বর্ষার জলে হাওয়ায় চকচকে সবুজে চমত্কার দেখতে হয়েছে । আমাদের বাড়ীর গেটের সামনের এক চিলতে জায়গায় টগর গাছটা সাদা ফুলে ছেয়ে গেছিল কয়দিন আগেও , এখন ফুল একটু কমে এসেছে । বেলী ফুলও অনেক ফুটেছিলো, তুষার আপার উপহার দোলনচাঁপা ফুটতে শুরু করেছে বর্ষার শুরুতেই। হাসনুহেনা গাছটাতে ফুলের জন্য পাতা দেখা যায় না, রাতের দিকে তীব্র সুবাস চারতলা পর্যন্ত পাওয়া যায় । তবে বাগানবিলাস লতাটা আর কামিনী অনেক শখ করে লাগিয়েছিলাম, তিন বর্ষা চলে গেছে কিন্তু এখনো ফুল আসে নাই , কি জানি কেন ! প্রতিবেশী রেবেকা আর জেসমিন দুজনেই জানালো – এইগুলো পুরুষ গাছ – ফুল ফুটবে না, ভূল গাছ কিনে ঠকেছি ! মানুষই ঠিক ঠাক মত চিনতে পারি না আর গাছ ! শিউলি লাগিয়েছি এইবার বর্ষায়! ময়মনসিংহ থেকে দেশী পেয়ারা গাছ এনে লাগিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে তার গোড়ায় ময়মনসিংহের মাটি আছে , এইবার ফল ধরেছে, প্রতিদিন সকালে পেয়ারা গাছটি পাতা দুলিয়ে যেনো জানতে চায় ‘ মায়া ( মা) বালা আছুইন ?। বাড়ীর পিছন দিকে একজন মানুষ হাঁটতে পারে এইরকম সরু জায়গায় নিম, আম আর কৃষ্ণচূড়া বেড়ে উঠছে । কলা গাছে কলা ধরেছিল – ছোট ছোট , একটু টক , কিন্তু নিজের গাছের কলা বলে কথা,সেই টক কলাই গাড়ীর তেল পুড়িয়ে প্রিয়জনদের দিয়ে এলাম !

আমার প্রতিবেশীরা ( যাঁরা আমার মতন এই বাড়ীর সমান অংশীদার) প্রায়ই অনুযোগ করেন বড় প্রজাতির গাছ লাগালে বিল্ডিং এর ক্ষতি হবে ইত্যাদি , আমি শুনি কিন্তু ইচ্ছেমত গাছ লাগিয়ে যাই । আমার ভালো লাগে যে। আমাদের বাড়ীর সামনের বড় রাস্তার ধারে গোটা চারেক কৃষ্ণচূড়া লাগিয়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে, দুটো গাছ বেঁচে ,বড় হয়েছে , ফুল আসে । অনেক ভালো লাগে গাছ দুটোর দিকে তাকালে । বড় রাস্তাতে একটা কাঁঠাল গাছও লাগিয়েছি । একটা সোনালু আর জারুল গাছ লাগিয়েছিলাম বাড়ীর ঠিক সামনে, কিন্তু কেন যেন বাঁচলো না ! একটা সোনালু না পাই হলুদ রাধাচূড়া লাগাতে চেয়েছিলাম এই বর্ষায় । তুষার আপা শ্বেত চন্দনের গাছের চারা দেবেন বলেছেন । মেধার ধারণা তার মায়ের মাথা ছিটগ্রস্থ ! নিজের জমি নাই বলে পাবলিক জমিতে গাছ লাগিয়ে শখ পূরণ করে , অনেকটা গনি মিয়া একজন কৃষক , নিজের জমি নাই , অন্যের জমি চাষ করে টাইপ আরকি ! গনি মিয়ার গল্পটা তার মামারা তাকে বলেছে ! আমাদের বসুন্ধরার বাড়ীর ঠিক সামনেই এখনো বেশ কয়েকটা প্লট খালি আছে , ঘর বাড়ী তৈরী শুরু হয় নাই, প্রতিদিন বিকালে ছোট ছেলেরা ক্রিকেট আর ফুটবল খেলে , শীতের সময় ব্যাডমিন্টন খেলে ইলেকট্রিক লাইন টেনে বাতি জ্বালিয়ে । একটু ছোটরা কেউ কেউ সাইকেল চালায় । ছুটির দিনগুলোতে আর কোনদিন যদি ভাগ্যক্রমে সন্ধ্যার আগেই বাড়ী ফিরতে পারি তবে ব্যলকনিতে বসে ছেলেদের খেলা দেখি , হৈচৈ তে কান পাতা দায় ! ওদের খেলা , চেঁচামেচি আমাকে অল্প সময়ের জন্য আমার শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার রাস্তা গুলো বেশ চওড়া, গাছপালার ছায়াঢাকা আর এখনো যথেষ্ট নিরিবিলি। হাঁটার জন্য খুব চমত্কার । আমাদের কুকুরছানা মাইক হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মেধা মাইককে নিয়ে হাঁটতে বের হত সকাল সন্ধ্যা । মাইক এক বিকালে হারিয়ে যায় । মাইককে আমরা পেয়েছিলাম বছর চারেক আগে, আমাদের ড্রাইভার নির্ভুল চিরান ক্রিসমাসের ছুটিতে গ্রামের বাড়ী গারো পাহাড়ের নীচের হালুয়াঘাট থেকে দুইমাস বয়সী মাইককে নিয়ে এসেছিল ছালার বস্তায় ভরে, মেধার জন্য উপহার হিসেবে ! মাইক ছিল হাউন্ড প্রজাতির – আমার ধারণা তার বাবা মায়ের মধ্যে কেউ হয়ত হালুয়াঘাট মিশনের কারো পালিত বিদেশী কুকুর ছিলো । মাইকের নাম রাখা হলো মেধার প্রিয় টিভি সিরিয়ালের চৌকস গোয়েন্দার নামে ! শুরুর দিকে মাইক আমাদের ঘরে ঘুমাতো, অবশ্য জানুয়ারী মাসের কনকনে ঠান্ডায় ওকে বাইরে রাখাও যাচ্ছিল না । কুকুর ছানাটিকে পরিষ্কার করা , তার ভ্যাকসিন , তার ঘর বিছানাপাতির ব্যবস্থা করা , দুধ ছাড়া কিছু খেত না , তাকে আস্তে আস্তে শক্ত খাবারে অভ্যস্থ করে তোলা সবই আমার দায়িত্ব , শুধু সকাল সন্ধায় মাইকের গলার চেইন ধরে তাকে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়ার মালিকানার আনন্দটুকু মেধার ছিলো ! এবং পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময়ও বলতে হত , এ হচ্ছে মেধার মাইক, মেধার ভাষায় ‘ হি ইজ মাই ব্রাদার ‘! আমার বোন মুন্নীর মেয়েরা – অহনা আর অমৃতা এই বাড়িতে এলে আর যেতে চাইতো না মাইককে ছেড়ে । চাচাতো ভাই বাবুর ছেলে আদির তাদের বাসা থেকে কুকুরছানা টিকে নিয়ে আসতে দিবে না ! সেকি কান্না ছেলের ! মাইক আমাদের সাথে গাড়ীর সামনের সীটে বসে সীটবেল্ট বেঁধে বেড়াতে যেতো ! মাইককে ঢুকতে দেবে না জন্য মেধা নানদোস রেস্তোরাতে খাওয়ার বায়না ধরা বন্ধ করেছিলো । মেধার সাথে স্কুল, কোচিং সব জায়গায় সে যেতো ! অফিসের কাজে দেশের বাইরে গেলে মেধার দেয়া শপিং লিস্ট লম্বা হতো মাইকের সাবান, শ্যাম্পু, খাবার আর খেলনার বায়নায় ! ডিসেম্বর জানুয়ারীর শৈত্য প্রবাহের সময় আমার রুম হিটার দিয়ে মাইকের ঘর গরম করা হতো ! শীতের দিনে স্নানের পর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে গায়ের লোম শুকানো হতো ! তার স্নান পর্ব ছিল রীতিমত দর্শনীয় ! বাড়ীর দারোয়ান , ড্রাইভাররা , বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাচ্চারা সবাই সেই মহাস্নান যজ্ঞে সামিল ! আমার নেক্সট ডোর প্রতিবেশী জুলফিকার আলী সাহেবের কুকুর ভীতি থাকাতে উনি কেবল জানতে চাইতেন মেধার এই শখ কতদিন থাকবে, মেধা তো বেড়াল বা খরগোশ পুষতে পারে, কুকুরই পুষতে হবে কেন, আর মেধা খুব রেগে গিয়ে আমাকে বলতো যেন আমি ওদের সাথে না মিশি ! পরম সুহৃদ বন্ধু ভ্রমনকাহিনী রচয়িতা মইনুস সুলতান মাইকের জন্য মেক্সিকো থেকে খেলনা নিয়ে এসেছিলেন , তুষার আপা বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন বিশেষ করে খাবারের ব্যাপারে , মাইককে একই ভেটের কাছে নিয়ে যেতাম যাঁর কাছে তুষার আপার কুকুর সুখীকে নেয়া হতো ! ফোন করা মাত্রই ভেট ভদ্রলোক হেসে জিজ্ঞেস করতেন, কি আপা, আপনার ছেলের আবার কি সমস্যা হলো ? কত যে মজার মজার স্মৃতি ! একটু বড় হওয়ার পরে মাইক বেশ শিকারী বৈশিষ্ট দেখাতে শুরু করেছিলো,অপরিচিত কেউ বাসার গেটের সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে মাইকের সতর্ক ঘেউ ঘেউ শুরু হয়ে যেত । ২০১২ এর মার্চ মাসের এক বিকেলে মাইক হারিয়ে গেলো। প্রিয় কুকুরছানাটি হারিয়ে যাওয়ায় মেধা অনেক কাঁদলো। হেন জায়গা নাই আমরা তাকে খুঁজিনি ! দারোয়ান আর ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে মেধা রাস্তায় রাস্তায় মাইকের নাম ধরে ডাকতে লাগলো কয়েকদিন। কিন্তু মাইক আর ফিরে এলো না । আমার মা, যিনি কিনা ঘরের ভিতর কুকুর ঢোকা নিয়ে অনেক চেঁচামেচি করতেন, তিনিও কিভাবে যেন মাইককে মেনে নিয়েছিলেন । মাইক হারিয়ে যাওয়ার পরে মা ই বুদ্ধি দিলেন থানায় জিডি করার জন্য, পুলিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার মামাতো ভাইয়ের কাছে যখন এই ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম , সে নির্বিকার ভাবে বললো, ” আপা , তোমার মাথাটা গেছে , বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া লোকের কেস নিয়ে পুলিসের জেরবার অবস্থা , ফোর্সের অভাবে মানুষ খুনের তদন্ত ঠিক সময়ে শেষ করতে পারি না আর তুমি চাও কুকুর খোঁজার জন্য পুলিসের সাহায্য । তাও আবার দেশী নেড়ি কুকুর ! মেয়েকে দুই স্কুপ আইসক্রিম খাইয়ে দাও , সব ভুলে যাবে ” । মামার এই অতি নির্মম মন্তব্যে মেধা কেঁদে আকুল হলো। ছোট্ট মেধার মনমরা ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগেছিলো । ছেলেমানুষ , আস্তে আস্তে ভুলে গেছে । এখনো মাইকের ঘর বিছানা আর কিছু খেলনা পাতি রয়ে গেছে ! মাইকের সাথে তোলা ছবি মেধার ল্যাপটপ এর স্ক্রীন সেভার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে । পরবর্তীতে তুষার আপা তাঁর জার্মান শেফার্ড এর বাচ্চা হওয়ার পরে মেধাকে একটা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমিই আর আনিনি ! জীবন থেকে প্রিয় কিছু হারিয়ে যাওয়া বেদনার ! আমাদের কুকুর পালন পর্ব এখানেই ইতি । আমদের বাড়ীটি – বাড়ী কি বলা যাবে আদৌ ! আমাদের ফ্ল্যাটটি – ছোট কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দিয়ে তৈরী। আমার আর আমার সন্তানদের মিলিত আকাংখা …আমাদের নিজের ঘর , আমাদের নিজের ঠিকানা । আমার সমস্ত সঞ্চয়, অফিস থেকে এডভান্স, ব্যাংক থেকে ঋন – সব মিলিয়ে এই স্বপ্নটি সত্যি হয়েছে । কি যে সেই অনূভুতি …কোনদিন কোনভাবেই কাউকে বোঝাতে পারবো না । এই ঠিকানা আমরা ব্যবহার করবো আমাদের পরিচয়পত্রে – বদলাতে হবে না। বাড়ি ভাড়া করতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না ! ‘কি যাতনা বিষে , বুঝিবে সে কিসে , কভু আশীবিষে দংশেনি যারে …’! নিজের বাড়ী ….আহ …মুক্তি … ২০০৯ সালে এই ঘরে আসি আমরা, তখনো বিল্ডিং এর কাজ শেষ তো দূরের কথা , মাত্র স্ট্রাকচার দাঁড়িয়েছে ,আহসান, রেবেকা আর আমি আমাদের নিজের নিজের ফ্ল্যাটটা ঠিক ঠাক করে থাকতে শুরু করেছিলাম । পূব দখিন খোলা হওয়াতে বেশ হাওয়া আর প্রচুর আলো এই বাড়িটিতে । লটারী করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ হওয়ার দিন কি সেই উত্তেজনা ! সবাই চায় উপরের দিকে পুবদিকের ফ্ল্যাট, আমার ভাগ্যে যখন ৪ তলার পূব দিকের ফ্ল্যাটটি উঠলো সবাই হইহই করে উঠলো । ৪ তলা পাওয়ার সৌভাগ্যের কারণে খাওয়াতে হলো সবাইকে । গোটা চারেক সুটকেস নিজের , ছোট বোন মুন্নি আর বন্ধু কচির থেকে ধার করা আরো গোটা চারেক । আর কিছু কাগজের কার্টুন । মেধার কিছু খেলনাপাতি। সম্পদের বই পত্র আর কম্পিউটার। গত পাঁচ বছরে খাট, চেয়ার টেবিল, কাউচ সবই হয়েছে । দেয়ালজুড়ে আলমারী, মেয়ের শখ বড় আয়না লাগিয়েছি । মেয়ের ঘর গোলাপী রং করা হয়েছে । বাথরুমে বাথটাব দেয়া হবে কি হবে না তাই নিয়ে ভাই বোনে যুদ্ধ ! মেধার কান্না ! এমনকি শাওয়ার কার্টেনএর রং আর প্রিন্ট নিয়েও দুই ভাই বোনের মন কষাকষি ! বন্ধু আহসানের সহযোগিতায় সম্পদ দরজা কিনে আনলো , সেই দরজার ফ্রেম বছর না ঘুরতেই ফুলে ঢোল – দরজা আর লাগে না – ভেজা কাঠ ছিলো , রাতের বেলা সোফা দিয়ে দরজা ঠেকা দিয়ে রাখা হতো এই নিয়ে কত হাসাহাসি। একবার আমি দেশের বাইরে, বাসায় শুধু আমার মা আর মেধা , জুন মাসের প্রবল বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের তোড়ে আমার শোবার ঘরের ফ্রেঞ্চ ডোর এর একটা কাঁচের পাল্লা খুলে গিয়ে ঘর জলে ভেসে একাকার , রাত তখন ১টা , মেধা গিয়ে প্রতিবেশী রেবেকাকে ডেকেছে , রেবেকা ফোন করে পাঁচতলা থেকে আহসানকে ডেকে এনে কোনোরকমে সেই দরজার পাল্লা চেয়ার দিয়ে ঠেলা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলো । পরদিন সকালে আহসান মিস্ত্রী ডেকে দরজা ঠিক করে দেয় । ২০১১ জানুয়ারীর এর তীব্র শৈত্য প্রবাহের সময় আমরা সব উত্তরের রুম ছেড়ে দক্ষিন দিকের রুমে ঘুমাতে শুরু করলাম – আমি মেধা আর আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড রুবিনা। মাইক ঘুমাতো খাটের নীচে। একটা মাত্র রুম হিটার আমাদের । ছোট্ট রান্না ঘরটি ছোট বড় তাক সহ বড় প্রিয় হয়েছে আমার , মেধা বলছিল এটাকে কিচেন না বলে কিচেনেট বলা উচিত । ডাইনিং স্পেসের দেয়ালে ডাইনিং কেবিনেট হয়েছে – আস্তে আস্তে খালি তাকগুলো ভরে উঠেছে কাপ, প্লেট , বাটি , গ্লাসে । কেনিয়া থেকে আনা ভারী পাথরের তৈরী পেয়ালার ওজনের চাপে বেলজিয়াম থেকে আনা ক্রিস্টালের গ্লাস ভাঙার শোকে মুহ্যমান হয়ে রইলাম কতদিন ! দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে কেনা সোনালী চামচের সেট খুঁজে না পেয়ে তোলপাড় কান্ড , পাওয়া গেলো তাকের পিছনে , হাঁফ ছেড়ে খুশী হয়ে উঠলাম! যেন এই চামচ না পেলে জীবনে কত বড় ক্ষতি হয়ে যেতো ! আমার খাপছাড়া মাপছাড়া তাল ছাড়া হৃদয়ের গভীর কন্দরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আছে গৃহী মন ! ছেলে আমার বুকসেলফ বানালো তার নিজের পছন্দের যা এখন মেয়ের দখলে – বুকশেলফের তাক গুলো থেকে রবীন্দ্রনাথ বিমল মিত্র , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , বাণী বসু , সুচিত্রা মিত্র , হুমায়ুন আহমেদ, সেলিনা হোসেন ,খালিদ হোসেনী , অরহান পামুক, তাহমিমা আনাম, মার্ক টোয়েন, অমর্ত্য সেন , অমিতাভ ঘোষ , স্টিফেন হকিংস উঁকি দেন । সত্যজিত রায়ের ফেলুদা আর জাফর ইকবালের রাশেদ, দীপু অনুসন্ধিত্সু চোখে তাকায় , পাশে বসে রহস্যময় হাসি হাসে হ্যারি পটার, এডোয়ার্ড আর বেলা ! তার পাশেই মইনুস সুলতানের ‘মৃত সৈনিকের জুতোর নকশা ‘ অথবা ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই ‘ মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কোথায় কোথায় ! ঘরের দেয়াল ভরে গেছে মুখোশ আর বিভিন্ন ছবি আর শো পিসে । যত জায়গায় গিয়েছি বা যাই নিয়ে আসি কিছু মিছু । নেপালী কাঠের দরজা জানালা (মিনিয়েচার ), উড়িষ্যা থেকে আনা কাপড়ের বাতিদান, কাশ্মীরি টেবিল, তিব্বতী হ্যান্ড মেড কাগজের তৈরী ল্যাম্পশেড, বিভিন্ন দেশের মূর্তি, হাতি, ঘোড়া, গন্ডার, কি যে নাই ! দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কত কিছু – দিনাজপুর জেলখানার কয়েদীদের হাতে তৈরী মোড়া, ঠাকুরগাঁও এর সাঁওতাল নারীদের হাতে গমের খোসা দিয়ে তৈরী বিপ্লবী নায়ক ‘ চেগুয়েভারা ‘ র চেহারা , থানচির পাহাড়ি বাঁশের তৈরী পেঁচা, বরগুনার পাথরঘাটা থেকে আনা বাঁশের মাছ ধরার খাঁচা ,’চাঁই’ বলে এটাকে ! এসব শো পিস দেয়ালে ঝুলানোর সময় তিনজনের কত মাপঝোক, ছোটখাট মন কষাকষি , কোথায় লাগালে ভালো লাগবে ! হুমায়ুন আহমেদ ঠিকই বলেছিলেন বাঙালী বাড়ীতে শো পিসের বহর দেখে বোঝা যায় গৃহের মালিক কত দেশ ভ্রমন করেছেন ! আমিও তো আর সাধারণ বাঙালী চরিত্রের বাইরে নই ! মা রাগারাগি করেন কোনো রুমে নামাজ পড়ার নাকি উপায় নাই, হিউম্যান ফিগার বা ঐরকম ছবি থাকলে নাকি নামাজ হবে না ! ছেলের রুমের একটা দেয়াল ফাঁকা রেখেছি যাতে মা নামাজ পড়তে পারেন ! কোপেনহেগেন থেকে উড়ে আসা লিটল মারমেইড দিনের পর দিন আমার চাইনিজ টেবিলের উপরে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় মানুষের প্রতীক্ষায় ! কত নদীর বালু যে ছোট ছোট শিশিতে – ব্রম্হপুত্র , যমুনা , তিস্তা , দুধকুমার, ধরলা, মহানন্দা, সুরমা , সারি , পিয়াইন, সোমেশ্বরী, যাদুকাটা থেকে শুরু করে ,হাডসন, পোটোমাক, বাগমতী, গঙ্গা, গোদাবরী, রাইন আরো কত নদীর বালু । শুধু ব্রম্হপুত্রের বালুই আছে- ময়মনসিংহ , জামালপুর , কুড়িগ্রাম আর আসাম থেকে। যমুনার বালু আছে – ভুয়াপুর , গাইবান্ধা আর দিল্লী থেকে ! প্রথম প্রথম বালুর আলাদা রং বোঝা যায় , তারপরে ফ্যাকাশে ছাই রং হয়ে যায় ! ছোট বড় নুড়ি পাথর – যেখানে গেছি বা যাই – নিয়ে আসি । নুড়ি পাথর কুড়োনো মেধার প্রিয় অভ্যাস । সব রাখা আছে বসার ঘরের এক কোনায় – যার উপরের দেয়ালে জড়ো করা দুহাতের উপর মুখ রেখে কবিতা নির্মানের ভাবনায় কবি শামসুর রাহমান । ২০০৯ এর অগাস্ট মাসে মার্কিন বৃত্তি নিয়ে সম্পদ নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে যাওয়ার পরে ১২০০ স্কোয়ার ফিটের এই ছোট ফ্ল্যাটটি যেন তেপান্তরের ধ্নু ধূ মাঠে পরিনত হলো । আমি রাতের অর্ধেক সময় কাটাই আমার নিজের রুমে, ভোররাতে গিয়ে শুই ছেলের রুমে। তার টেবিল, কম্পিউটার, কাপড় রাখার ক্লজেট, ক্লজেটের ভিতরে তার ব্যবহৃত বেশ কিছু কাপড়, দেয়ালে হেলান দিয়ে হাওয়াইন গিটার, সবাই আমার সাথে জেগে থাকত অনেক রাত । তারপরে একসময় আমরা সবাই অভ্যস্থ হয়ে গেছি এই বাড়ীর ছিপছিপে হাসিখুশী পড়ুয়া ছেলেটির অনুপস্থিতিতে । অনেক বড় পদার্থবিদ হবে সে । হয়তো কোনোদিন বিবিসি অথবা সিএনএন থেকে জার্নালিস্ট আসবে এই বাড়ীতেই তার মাকে ইন্টারভিউ করতে – জানাবে তারা সারা পৃথিবীকে কেমন ছিল এই দুনিয়া খ্যাত পদার্থবিদের ছেলেবেলা , কেমন ছিল তার প্রথম তারুন্যের দিনগুলো । নিজের অতি সাধারণ মায়ের ভুলে ভরা জীবনের অংশীদার হয়ে কত কষ্ট সে সহ্য করেছে , কোনোদিন বোকা মায়ের উপরে রাগ করে নাই বরং অগোছালো অজস্র ভুল করা মাকে নিয়েই তার গর্বের শেষ নাই ! ! উত্তর দক্ষিনের বেলকনি দুটো টবে ভরতি – পা রাখার জায়গা নাই । মেধা রাগারাগি করে – তুমি গাছ নিয়েই থাকো । জবা, বেলী , জুঁই, টগর, নাইন ও ক্লক, অপরাজিতা , বোগেনভিলিয়া , শাপলা সবাই আছে । আছে কত রকম পাতা বাহার । সিপারের উপহার অলকানন্দা আর অপরাজিতা ছেয়ে গেছে বেলকনির গ্রীল জুড়ে ! মইনুস সুলতান উপহার দিলেন – চমত্কার সাদাবেগুনি ফুল- নামকরণ হলো তার ‘শুভ্রসুধা ‘! প্যাশন ফুলের গাছ উপহার পেয়েছি খায়রুল ভাইয়ের কাছ থেকে, ফুলটি তার অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত করেছে সবাইকে । রাজউকের সমস্ত নিয়ম মেনে এই বাড়ীটির বেলকনি গুলো এত সরু হয়েছে – তাই নিয়ে তীর্যক বাক্য বিনিময় প্রতিবেশী জুলফিকার আলী সাহেবের সাথে। বাড়ি তৈরীর এই সমস্ত ডিজাইন ইত্যাদির ঝামেলা তো আহসান আর উনিই সামলেছেন । তারপরেও অকৃতজ্ঞ আমি খালি অভিযোগ করি – বেলকনিটা আর এক ফিট চওড়া করে দিলে কার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ত ? ছাদে ছোট্ট একটা জিম তৈরী করা হয়েছে – মূলত আমার , রেবেকার আর আহসানের উদ্যোগে । ট্রেডমিল , সাইকেল , স্টেপার সহ আরো কিছু -ব্যায়াম করার জন্য । প্রথমদিকে অতি উত্সাহে প্রতিদিন জিম ব্যবহার করতাম । আমি ট্রেডমিলের উপরে হাঁটি তো মেধা সাইকেল চালায় , আর আমি সাইকেলে তো সে ট্রেডমিল এর উপরে দাঁড়িয়ে আমার স্থুলত্ব নিয়ে ক্ষেপায় । পহেলা বৈশাখ আর ৩১ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান – সবই এই ছাদে । মেধার মতামত – অত্যন্ত শ্যেবী , আন গ্লামারাস এই সব কর্মকান্ড , আমাদের মতই বুড়ো আর বোরিং ! আবার সেসবে জয়েন করে বলবে ,’ইট ওয়াজ ফান, রাইট মামি ‘? কন্যা আমার আধা সাহেব ! এই বাড়ীটি ছেড়ে যেতে হবে আমাদেরকে । সাময়িক ভাবে হয়ত ২ বছরের জন্য । বসুন্ধরার ট্রাফিক জ্যামের কারণে মেধার স্কুল আর কোচিং করা প্রায় অসহনীয় কষ্টে পরিনত হয়েছে আর আমিতো কোনদিনই রাত ৮-৯ টার আগে বাড়ী ফিরতে পারি না । বসুন্ধরার মেইন গেটে আটকে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা ! গুলশান ১ নম্বরে আমার অফিস , আমার বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বের হিসেবে ! সকাল ৯টার অফিস ধরার জন্য বাড়ী থেকে বের হই সকাল সাড়ে ৭ টায় ! বন্ধু স্বজনরা আমার বাড়ীতে আসা ছেড়ে দিয়েছে, দু একজন বন্ধুপ্রীতির পরাকাষ্টা দেখিয়ে আসে এবং এসেই ঘোষণা দেয় ‘ এই ই শেষ ‘ ! প্রায় ৪ মাস ধরে নিকেতন , গুলশান আর বনানীতে খোঁজাখুজির পর একটা পছন্দমত বাড়ী পাওয়া গেলো । আলো হাওয়াময় নিজের বাড়ীতে থেকে অভ্যাস বদলে গেছে – বাড়ী ভাড়া করতে গিয়ে দেখি সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ! সুলতান ভাই আর সিপার যে কি যন্ত্রনা সয়েছে বাড়ী খোঁজার ব্যাপারে ! ভাইজান ও অসুস্থ শরীরে বাড়ী খুজেছেন । বাড়ী বদলানোর সিব্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পরে যেন অস্থির লাগতে শুরু করলো , কেমন যেন ছটফটানি ! সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে সম্পদ অনেকবার করে জানতে চায় , মা , যাঁদের কাছে এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিবে , তাঁদেরকে বোলো যেন যত্ন করে রাখে ঘর-দোর। ছেলে আমার বুদ্ধি দেয় যেন আমি প্রফেশনাল প্যাকার্স দিয়ে জিনিসপত্র শিফট করাই ! চলে গেছে সে দূর দেশ – দুই বছরে একবার আসে, এই বাড়ীতে আর থাকতেও আসবে না হয়তো কোনদিন তবুও মায়া জড়িয়ে থাকে এত প্রবল ভাবে । কচি সান্তনা দেয় ‘ মন খারাপ তো লাগবেই, তবে কষ্ট টাও কমবে অনেক। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থেকে তোর শরীর খারাপ হয় , মেধা ক্লান্ত হয়ে থাকে ! দেখবি নুতন জায়গায় আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে !’ অনুজপ্রতিম বন্ধু মামুন এই বাড়ী বদলানোর কারণে যে পরিমান ভর্তুকি (প্রায় তিনগুন )আমাকে গুনতে হবে সেই ভর্তুকিটা যদি কোনো কনসাল্টেন্সি করে যোগাড় করা যায় কিনা সেই চেষ্টাও আমার এই সুহৃদ করছে ! ছোটভাই সম আরিফ জানালো সে প্যাকিং এর সময় থেকে সাহায্য করবে। জুনিয়র সহকর্মী লাভলী, ছুটি চেয়ে রেখেছে যাতে আমার বাসায় এসে থেকে সে গোছানোতে সাহায্য করতে পারে ! মুন্নি আর খায়রুল ভাই কাঁচের ক্রোকারিজ কিভাবে ভেঙ্গে যাওয়া যাবে সেই বিষয়ে এক্সপার্ট ওপিনিওন দিচ্ছে । ভাই দূর বিদেশ থেকে টেলিফোনে সাহস যোগায়, কত কিছু করে ফেললে আপা আর বাড়ি বদলানো তো তোমার এক তুড়ির কাজ ! সিপার হাসে, তোমার এত সাহস আর তুমি কিনা বাড়ী বদলাতে নার্ভাস হচ্ছো ! সবার এত ভালবাসা, এত মমতা তারপরেও অস্থিরতা যায় না ! কিভাবে বোঝাবো এই অস্থিরতা বাড়ী বদলানোর ঝামেলার জন্য নয় , এই অস্থিরতা বুকের অনেক ভিতরে ! সব জেনে বুঝেই এই বাড়ি বদলানোর সিব্ধান্ত – তবু ও ব্যথা বোধ হয় । অনেক । সম্পদ, মেধা আর আমি – আমাদের তিনজনের এই ছোট্ট পরিবার । আমাদের তিনজনেরই অনেক মায়া এই বাড়ীটাতে জড়িয়ে । খায়রুল ভাই ঠাট্টা করেন বাড়ী থেকে চলে সময় আমি নাকি বন্ধু , প্রতিবেশীদের গলা জড়িয়ে কাঁদবো ! দুঃখ বিলাস ! বাড়ীর দেয়ালে কান পাতলে নাকি শোনা যাবে , বাড়ী বলছে ‘যেও না !’ হয়ত সত্যিই । যা কিছু আছে আমাদের তিনজনের স্থাবর সম্পত্তি সবই নিয়ে যাব সাথে । কাগজের কার্টুনে করে সব নিয়ে যেতে হবে, তাতে সব কিছু ঠিক মতন নিয়ে যাওয়া যাবে ! সবই কি সাথে যাবে ? রান্নাঘরের দরজা সোজাসুজি ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটি সম্পদের প্রিয় , মেধা বসতো ভাইয়ের পাশে , আমি তাদের মুখোমুখি । কতদিন সন্ধায় অফিস ফেরত আমি রান্না করতাম আর সম্পদ ডাইনিং টেবিলের এই জায়গাটাতে বসে অংক করতে করতে কত গল্প , কত পরিকল্পনা মা ছেলেতে করতাম ! মেধা এসে ঘোষণা দিতো ‘ তোমাদের কথার জন্য আমি টিভি দেখতে পারছি না’ – সে কার্টুন দেখায় ব্যস্ত ! রুমের কাঁচের দরজা আর দেয়াল মেধা নানাধরনের কার্টুন, খুদে খুদে বেড়াল, হাতি , জেলিফিশ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে , কত বকা সে খেয়েছে দেয়ালে দাগ হয়ে যাবে বলে, আমার উপরে রাগ করে সব টেনে খুলে ফেলেছে , আবার পরেরদিনই হয় আমি নয়তো সম্পদ আবার কিনে এনে দিয়েছে ! কাউচের যে দিকটি থেকে দক্ষিনের বেলকনি দেখা যায় সেই দিকটি মেধার জায়গা, প্রিয় টেডি বেয়ার জুলিকে কোলে নিয়ে বসে সে স্কুলের গল্প করে আমার সাথে, সিপারের প্রিয় বসার ঘরের বড় দেয়ালজোড়া জানালার পাশে যে ছোট কাউচটি সেখানে সে গুটি শুটি শুয়ে পড়ে , তুষার আপা দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসেন ! মা যখন থাকেন আমার রুমের বেলকনির সাথে দরজার কোনটি বড় প্রিয় তাঁর – বেতের চেয়ারে বসে ছোট মোড়ায় পা রেখে আরাম করে জি বাংলা বা স্টার চ্যানেলে সিরিয়াল দেখেন । সম্পদের প্রথমবার আমেরিকা যাওয়ার দিন , ভোররাতে যখন গাড়ীটা সম্পদকে নিয়ে বের হয়ে গেছিলো গ্যারেজের মুখে দাঁড়িয়ে আমি বুকের ভিতর শূন্য অনূভুতি, গ্রীষ্মের রাতের বেলা ইলেকট্রিসিটি যখন লম্বা সময়ের জন্য থাকত না, দক্ষিনের বেলকনির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সম্পদের গিটার বাজানো , ভাইয়ের পাশেই মেঝেতে শুয়ে থাকা মেধা মাকে হুকুম করছে তার জন্য ফ্রিজ থেকে চকলেট নিয়ে আসার জন্য ! বেলকনির কোনা দিয়ে মুখ বের করে তিনতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতিবেশীদের সাথে আমার জরুরি আলাপ সেরে নেয়া ! এর কোনো কিছুই কি কার্টুনবন্দী করে নিয়ে যাওয়া যাবে ! ভোরবেলা মুড়ি খেতে আসা চড়ুইদের কিচিরমিচির ! অফিস থেকে ফেরা মাত্রই আমাদের আদিবাসী গারো দারোয়ান বাদলের উজ্জ্বল হাসি মুখ – কি ব্যাপার – গাছে ফুল ফুটেছে কাজেই তার কিছু বখসিশ পাওনা হয়েছে কারণ বাদল জেনে গেছে যে এই আপা ‘র মাথায় গাছ-ফুলের ছিট্ আছে ! বছর দুই পরে সত্যিই কি আর ফিরে আসতে পারবো ! ফিরলেও তো একা ফিরতে হবে ! মেয়ে আমার স্বপ্ন দেখে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে পড়ার ! এইতো দুটো বছর , তারপরেই এ লেভেল শেষ , স্যাট , টোফেল তারপরে উড়ে যাবে পাখী আমার , যেমন গেছে তার ভাই ! অর্থনীতিবিদ হবে সে ! যদিও বা ফিরে আসি এই বাড়ীতে, বাড়ী তো শুন্য ! মেধার রুমের গোলাপী দেয়ালে বসে কার্টুন চরিত্র ‘পু ‘ কি আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হাসবে ! সম্পদের রুমের একদিকের দেয়ালে ঝোলানো ‘ সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড ‘ অথবা ‘ স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কি আমাকে ডাকতে থাকবে বহুবার পড়া চরণগুলো আবারো পড়ার জন্য ! যদি ও বা আসি চড়ুইরা কি আসবে আবার ! যেসব স্মৃতি সাথে করে নিয়ে যাব ফিরে এসে সেই স্মৃতিময় জিনিসগুলি কি ঠিক আগের মত হবে ! যা যায় ঠিক তা কি আর ফিরে পাওয়া যায় ! এই বাড়ীতে যখন আসি তখন জানতাম , এইই শেষ , আর কোথাও নয় ! পাঁচ বছরের মাথায় এই ঠিকানাও বদল করতে হচ্ছে । ঠিকানা কথাটাও কি অদ্ভুত মনে হয় । সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই জীবন , সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নিজে যে বেতাল হয়ে পড়ছি ক্রমাগত ! তবুও ভালো লাগে এই বেতাল সুরের তালে তালে দুলতে থাকা জীবন ….. সন্তানদের স্বপ্নের অংশীদারত্ব, তাদের হাসি আনন্দ , আমার জন্য তাদের ভালবাসা ! আমার ছেলে সকালে ফোন করলো, “মা সব ঠিক ঠাক আছে তো ! তুমি চিন্তা করো না, সব কিছু ঠিকই হবে । আমি অক্টোবরে দেশে এলে অনেক মজা হবে!” আমার মেয়ে নুতন বাড়ী দেখে খুশি (নিজেদের বাড়ীর জন্য যদিও তার মন বেশ খারাপ !) , জানালো স্কুলের বন্ধুদের কে হাউস ওয়ার্মিং পার্টি দিতে চায় ! একটু মুচকি হেসে আবার বললো , ‘তুমিও দিতে পারো পার্টি তোমার বোরিং অফিস কলিগ আর বন্ধুদের জন্য, আমি নাহয় হেল্প করবো!’ জীবনে বেতাল ছন্দে তাল মেলানোটাও অনেক আনন্দদায়ক !

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.