যে স্বপ্ন বাড়ি যেতে পারে না!

রোকসানা বিন্তী:

প্রতিবার ঈদ এলেই টিভিতে গ্রামীণফোনের একটা বিজ্ঞাপন দেখায়, যেখানে অনেকে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে কিংবা অনেক কষ্ট করে প্রিয়জনদের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য বাড়ি যাচ্ছে! সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী বিজ্ঞাপন, তাতে কোন সন্দেহ নেই! সেইসাথে চমৎকার জিঙ্গেল প্রত্যেকেরই মন ছুঁয়ে যায়!

কিন্তু আমাদের সংসারে এমন একধরনের মানুষ আছে যারা কখনোই ঈদে নিজের বাড়ি, নিজের প্রিয়জনদের কাছে যেতে পারে না! আসলে তাদের যেতে দেওয়া হয় না, এমনকি তারা নিজের মা বাবার সাথে ঈদ করবে এই প্রস্তাব উত্থাপনও করতে পারে না! সংসারে এই ধরনের মানুষদের প্রচলিত নাম “বাড়ির বউ”! এই শ্রেণীর মানুষ যেন কোনোদিন কারো মেয়ে ছিলো না, কোনো দিন কারো বোন ছিল না, কোনোদিন কারো ভাগ্নি, ভাতিজি বা নাতনি ছিলো না! এদের যেন জন্মই হয় “বাড়ির বউ” হিসেবে! বিয়ে করার সময় এরা কবুল বলার আগে অতীতটাকে কবর দিয়ে দেয়! তাই অতীত জীবনের কারো সাথে উৎসব উদযাপনের কোনো সুযোগ তাদের নেই!

একটা মেয়ে কি এতো সহজে বিয়ের পরে নিজের পরিবারকে ভুলে যায়? অবশ্যই না! স্বামী সংসার নিয়ে যতোই ব্যস্ত থাকুক আর স্বামীর প্রতি যতোই ভালোবাসা থাকুক ঈদের দিন কি তার মা বাবার জন্য মন খারাপ হবে না?
ইচ্ছে করবে না বাবাকে একটু আতর লাগিয়ে দিতে বা ভাইয়ের পাঞ্জাবিটা গুছিয়ে দিতে? কিংবা বোনের সাথে হই হই করে মেহেদীতে হাত রাঙাতে? মায়ের সাথে আলোচনা করে রান্নার মেনু ঠিক করতে? কিন্তু এই মন খারাপের খবর রাখার মতো মানুষ শ্বশুর বাড়িতে বিরল! তাই মনের ইচ্ছা দীর্ঘশ্বাস হয়ে গোপনই থেকে যায়! সারাদিন ব্যস্ত থেকে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টায় ঈদের দিনটা শেষ হয়ে যায়!

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেয়ে বিয়ের পরে আর কোনো ঈদ বাবার বাড়িতে করতে পারে না! অসুস্থ বা অন্তঃস্বত্ত্বা হলে হয়তো একটু ছাড় দেয়া হয়, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় কোন প্রশ্নই আসে না! “বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই আসল বাড়ি” এই সূত্র ধরে মেয়েদের ঈদ শ্বশুরবাড়িতেই থাকতে হয়! এমনও অনেকে আছে যারা কোনোদিনই ঈদে বাবার বাড়ি আসতে পারেনি! যাদের কাছে ঈদ একটা সাধারণ দিনের মতোই! বিশেষ কিছু আর না! তাদের স্বপ্ন মনের অন্তস্থলেই রয়ে যায়, বাড়ি আর যেতে পারে না!

ঈদের দিন বাড়ির মেয়ে বা পরিবারের প্রবাসী সদস্যটির জন্য সারাদিন হাপিত্যেশ করলেও বাড়ির বউকে তার “বাপের বাড়ি” যেতে দেওয়ার মতো উদারতা (!) দেখাতে পারেন না! তাকে কখনো জিজ্ঞেসও করা হয় না যে সে কোথায় ঈদ করতে চায়! বাড়ির বউ তো বাড়ির বউই! অনেকটা ফার্নিচারের মতো! সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হবে যেন সবাই দেখে বলে, “বাহ! কী সুন্দর!” এর আবার কীসের মন! কীসের আবেগ! হাসিমুখে সবার সেবা করাই হলো বাড়ির বউয়ের প্রধান ও প্রথম কাজ! এদের নির্বোধ এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ভাবাটাই সবচেয়ে নিরাপদ!

“শ্বশুর বাড়িই আসল বাড়ি” – এই থিওরির কাছে হার মেনে আছে বহু মেয়ের আনন্দ!
মুখের হাসি!
যাদের স্বপ্ন কখনোই আর বাড়ি যেতে পারে না!
যাদের স্বপ্নকে যেতে হয় অন্য কোথাও!

লেখক:
উপ পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

শেয়ার করুন: