ডা. সাবরিনার পোশাক নয়, তার অপরাধের বিচার চাই

সুপ্রীতি ধর:

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়াসহ প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: সাহেদ, করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী এবং জেকেজির চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, এদের সবার বিরুদ্ধে শুধুই বিচার দাবি না, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা উচিত। বৈশ্বিক এই মহামারীকালে যখন সারাবিশ্ব একযোগে এই সংকট উত্তরণে কাজ করে যাচ্ছে, তখন এরা কেবলমাত্র লোভের বশবর্তী হয়ে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, এবং শুধু তাই না, এদের ভুয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে শয়ে শয়ে প্রবাসী ইতালি থেকে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছে। এরকম নজির মনে হয় না অন্য কোনো দেশে হয়েছে। অন্তত আমার জানা নেই। একমাত্র বাংলাদেশের মতোন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করা উচিত।

খবরে পড়লাম, ডা. সাবরিনা আরিফকে সাময়িক বরখাস্ত এবং গ্রেপ্তার করে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সরকারি চাকরি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা এবং অর্থ আত্মসাতের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে জেকেজি’র প্রধান নির্বাহীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূলত এগুলো হচ্ছে চোখ ভুলানো খবর। এইদেশে এই আরিফ, সাবরিনাদের গ্রেপ্তার করে কী করা হয়, তারপর তারা কী কী করে, কীভাবে বেরিয়ে যায়, এসবই তো আমাদের জানা। সবাই তো আর সাংবাদিক শহীদুল আলম বা কাজলদের মতোন না যে তাদের শক্তপোক্তভাবে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এদিকে রিজেন্টের সাহেদ বা সাহেদ করিমকে নাকি পুলিশ খুঁজেও পাচ্ছে না। এতোবড় ‘মানের’ একজন কী করে হাওয়া হয়ে গেল, তা বুঝতে কি রকেট সায়েন্স পড়তে হবে? আমরা নারী নির্যাতনকারী সাংবাদিক রেজাউল করিম প্লাবনকেও তো মামলা দেয়ার পরও গ্রেপ্তার করাতে পারছি না। পুলিশ খালি ‘মিস’ করে ফেলছে প্লাবনকে। ধরতে পারছে না। অথচ আমরা জানি নারী নির্যাতন দমন আইন কতোটা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল! ওপর মহলে খুঁটির জোর না থাকলে এদেশে পথে-ঘাটে-মাঠে মানুষের লাশ পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যত দেখি না আপাতত।

বরং এই ফাঁকে আমরা কিছু স্বনামধন্য পত্রিকার খবরে চোখ বুলাতে পারি। একটি অনলাইন পত্রিকা বিশদ বিবরণ দিয়েছে থানা হাজতে ডা. সাবরিনার রাত কেমন কেটেছে, কী খেয়েছে, হেঁটেছে, নাকি বসেছে, মুখ খুলেছে নাকি চোখ বন্ধ করেছে। আমার প্রশ্ন, এসব কি সাংবাদিকতা? ডা. সাবরিনা অপরাধ করে গ্রেপ্তার হয়েছে, সে হাসলো না কাঁদলো, সেই খবর আমাদের কেন জানাতে হবে? যে কারণে ফেসবুকের নিউজফিড জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাবরিনার পোশাকের খবর, ছবি এবং নোংরা, অশ্লীল সব মন্তব্য, ঠিক একই কারণে এই সাংবাদিকতাও দুষ্ট।

এর আগে সপ্তাহখানেক ফেসবুক জুড়ে দেখেছিলাম রিজেন্টের সাহেদের নানান অপকীর্তির চেয়েও ঘুরে বেড়াচ্ছে কার কার সাথে তার সেলফি আছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সব ক্ষমতাশালীদের সাথেই যে তার উঠাবসা, এসব সেলফি থেকে তাই প্রতীয়মান হয়। সেখানে সাংবাদিকরাও বাদ যায়নি। আর আমরা যারা সাংবাদিকতা পেশার সাথে কমবেশি সম্পৃক্ত আছি, তারা তো জানিই, আমাদের এইসব ‘সাংবাদিক বন্ধুরা’ বা ‘নেতারা’ কতোটা ‘সুনীতিপরায়ণ’। হেন কাজ নেই যা তারা করতে পারে না নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কাজেই সাহেদকে তারা কিছুটা হলেও আড়াল করতে চাইবেন, দেশের ওপর মহল থেকেই যা চাওয়া হচ্ছে, তাতে তো দোষের কিছু নেই। তাই না?

ডা. সাবরিনা ইস্যু এসে সাহেদকে আড়াল করে দিয়েছে, নাকি দেয়া হয়েছে সুচতুরভাবে, কেউ কি ভেবে দেখেছেন? বাংলাদেশে ইস্যু থেকে মুখ ফেরাতে অন্য ইস্যুর আমদানি তো আর নতুন কিছু না।

তবে সে আর তার স্বামী আরিফ যে অপরাধ করেছে, বর্তমানে সেটাতেই জোর দেয়া উচিত, এবং এরা যা করেছে তা মানুষ খুনের শামিল, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার শামিল। চিন্তা করা যায় কত হাজার মানুষ ওদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে? মারা গেছে নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর যথাযোগ্য ব্যবস্থা না নেয়ায়? ধারণা করা যায়? একজন ব্যক্তি মেধাবী না হলে চিকিৎসক হতে পারে না, আর সেই শিক্ষা পেতে গেলে তাকে পেশাগত নৈতিকতাও শিক্ষা দেয়া হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে ডা. সাবরিনার পেশাগত নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে। এতোটা অপরাধপ্রবণ মেধা নিয়ে এতোটা দূর কী করে এলো সে? অতীতেও তার পেশাগত ক্ষেত্রে এমন কোনো নজির আছে কিনা, সাংবাদিকরা তা খুঁজে বের করুক। সেটাই হবে সঠিক সাংবাদিকতা।

আমরা কতিপয় ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করলে যদি দেশের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন হয়, এখন তাহলে ক্ষুন্ন হচ্ছে না? এই যে দলবেঁধে প্রবাসীরা ফেরত এলো দেশে, ওদের জন্য ইউরোপের প্রতিটি শহরে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে বাধ্য হচ্ছে, এতেও ক্ষুন্ন হয় না কিছু? সরকার এতো নির্বাক কেন এময়টাতে?

ফিরে আসি সাবরিনা প্রসঙ্গে। নারী বলেই আমাদেরকেই কেন কথা বলতে হবে তার অপরাধ ছাপিয়ে পোশাক নিয়ে রঙচঙা আলোচনায়? এই যে যারা তাকে তার অপরাধ আড়াল করতে বেশ্যা, পর্নস্টার বানিয়ে দিচ্ছেন, আপনাদের কাছে কেউ কি তার চারিত্রিক সনদ চেয়েছে? সে যদি তা হয়ও, তাতেই বা আপনাদের কী আসে যায়? আপনাদের ঘটে বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? ভালোমন্দ বিচার আপনারা করতে পারেন না? কেন নারীবাদী আন্দোলনকারীদেরই এ নিয়ে কথা বলতে হবে? অপরাধী অপরাধীই, সে নারী বা পুরুষ যেই হোক, কথা হবে তার কৃত অপরাধ নিয়ে। ব্যক্তিজীবনে কে কী পোশাক পরলো বা কী করলো, সেটা নিয়ে যারা আলোচনা করছে তাদেরকে বরং আমরা চিনে রাখতে পারি, প্রয়োজনে লাথি মেরে বেরও করে দিতে পারি তালিকা থেকে। এটা আমার চয়েজ।

এই যে একটা বখে যাওয়া জাতি নিয়ে কতদূর অগ্রসর হওয়া যাবে তা নিয়ে আমি রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অবদমিত যৌনাকাঙ্খা নিয়ে নারী শরীর দেখলেই যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আর রসালাপ করে নিজেদের অর্গাজম ঘটায়, তাদের নিয়ে আর যাই হোক, উন্নতি লাভ হয় না।

সবাই কথা বলুন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কৃত অপরাধের বিরুদ্ধে, দোষীদের বিচারের দাবিতে।

শেয়ার করুন: