সুমু হক:
৭১ সালে আমার জন্ম হয়নি।
কিন্তু স্বাধীনতার ন’বছর পর জন্মালেও আমাদের পারিবারিক ইতিহাস, বিশেষ করে নানুর গল্পে তাঁদের যুদ্ধকালীন অনিশ্চিত জীবন, প্রথমে পাকবাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে ঘরছাড়া হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ এবং তারপর রিফ্যুজি জীবনের সংগ্রাম, মামা এবং চাচাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প থেকে উৎসারিত হয়ে ৭১ একরকম আমাদের পরিবারের সব গল্পেরই একজন অদৃশ্য চরিত্র হয়ে রয়ে গিয়েছিল, কিংবা বলা যেতে পারে, বাইরের ইতিহাসের আনুষ্ঠানিকতা ছাপিয়ে ৭১ ছিল আমাদের পারিবারিক মিথের আন্তরিক পটভূমিকা।
তাকে জানবার জন্যে, বোঝবার জন্যে তাই আলাদা করে কোন আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয়নি আমাদের।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার প্রথম দশটি বছর স্বৈরাচারী সরকারের আমলে হলেও তখনও ষাট এবং সত্তরের দশকের সেক্যুলার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক চিন্তাধারাগুলোকে সমাজ থেকে পুরোপুরিভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেই শাসককুলের পক্ষে।
আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষা জীবনের প্রথমাংশের অনেকটাই তাই সেই আপাত সেক্যুলার পরিমণ্ডলেই ঘটে। অবশ্য এতে আমাদের পরিবারের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থান এবং ক্যাথলিক স্কুলের শিক্ষার প্রভাবও যথেষ্ট পরিমাণেই দায়ী।
সংবিধান পাল্টে দেশটিকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার বীজটিকে স্বৈরাচারি সরকার বপন করলেও, এই বীজটিকে মহীরুহে পরিণত করার সূত্রপাত ঘটে যে রাজনৈতিক যূথবদ্ধতায়, সেই জোটটির সূত্রপাত ঘটে এই সময়ে স্বৈরাচারি সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে, যখন কিনা তথাকথিত “প্রগতিশীল” স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দ্বিধাহীনভাবে জোট বাঁধে স্বাধীনতার চিহ্নিত বিরোধীপক্ষীয় শক্তি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাথে!
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মুক্তচিন্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যের মৃত্যুদণ্ডের সমনটি সেই মুহূর্তেই লেখা হয়ে যায়।
যদিও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের জোশে আমরা বিষয়টিকে দেখেও দেখি না।
এমনকি ১৯৭১ এ, যুদ্ধের শুরু থেকে তো বটেই, যুদ্ধে যখন পাকবাহিনীর হার সুনিশ্চিত হয়ে যায়, সেই শেষ মুহূর্তটিতেও তারা মরণ কামড় বসিয়ে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান সন্তানদের বেছে বেছে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পিছপা হয়নি, যাতে করে জাতির বুদ্ধিবৃত্তির জায়গাটায় শূন্য হয়ে যায়!
আর যে কাজটুকু এই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদরেরা ১৯৭১ এ সম্পূর্ণ করতে পারেনি, সেই কাজটিই তারা সুকৌশলে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকে এবং প্রথমে সহানুভূতিশীল বিএনপি এবং তারপর বিশেষ সহযোগী এবং দেশকে মদিনা সনদ অনুযায়ী চালাবার ঘোষণা দিয়ে শরিয়া আইনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অত্যন্ত সুকৌশলে এই শক্তিগুলো ১৯৭১ এ তাদের অসমাপ্ত থেকে যাওয়া কাজগুলো সম্পন্ন করে চলেছে।
কেড়ে নিচ্ছে আমাদের সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ।
শুরুতে দেখা গেল গ্রামে গ্রামে দেশজুড়ে হঠাৎ যেন কওমি মাদ্রাসা তৈরির সংখ্যা খুব বেড়ে গেলো।
এতে আর এমন কি ক্ষতির বিষয়, তাই ভাবছেন তো?
বেশ, ভাবতে থাকুন।
তারপর আমরা দেখতে পেলাম, এই মাদ্রাসাগুলোর প্রতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণটাও যেন হঠাৎ বেড়ে গেলো।
তারপর এলো বাইরের টাকা, সৌদি আরবের তেল বিক্রির কড়কড়ে টাকা, শর্ত একটাই, প্রতিটা ইউনিয়নে কওমি মাদ্রাসা, মসজিদ এগুলো তৈরি যেন হয়।
তারপর আমরা হঠাৎ দেখলাম, পাড়ার মোড়ে মোড়ে, গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মেহফিলটা যেন একটু বেড়েই গেলো হঠাৎ।
হঠাৎ দেখলাম, বিকেলে যে সময়টায় বাবা রবীন্দ্র সংগীত কি লালন গীতি শুনতেন, সেই সময়টায় এখন চলছে পিস টিভি।
শুরু হলো, পুজোর সময় পাড়ায় পাড়ায় মূর্তি ভাঙ্গা।
এত যদি ওদের এইসব বেদাতি কাজ করার ইচ্ছা হয়, তো ইন্ডিয়ায় চলে গেলেই পারে!
ওরা যদিও “ইন্ডিয়া” শব্দটা বলে না।
যে শব্দটা বলে, সেটা উচ্চারণ করতে আমার বারো বছরের মিশনারি শিক্ষার রুচিতে বাঁধে!
আমরা বোকা বোকা মুখে শুনে বললাম, যাহ! তাও আবার সম্ভব নাকি!
আল কায়েদা! বাংলাদেশে! অসম্ভব!
ক’বছর পর পর দেশে গিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খাই !
বন্ধুদের আড্ডায় কী পারিবারিক দাওয়াতে অর্ধেকের বেশি নারীদের চিনতেই পারি না!
এমনকি যে মেয়েটা রংবেরঙের ম্যাচিং সালোয়ার কামিজ পরে চুলে রঙিন ফিতে বেঁধে হাসিমুখে বাসায় বাসায় ঘুরে ঘুরে কাপড় ধোয়া কিংবা অন্য কোন বাড়তি কাজ থাকলে করে দিয়ে যেতো, সেই মেয়েটাকেও দেখি, প্রচণ্ড গরমে কালো একটা বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে হাঁসফাঁস করছে।
তাতে করে যে দেশের ধর্ষণের হার কমেছে তা কিন্তু নয়!
হিজাব পরা তনু, বোরখা পরা নুসরাত কাউকেই ধর্ষকেরা ছেড়ে কথা বলেনি!
ইদানিং শুনছি কমাস বয়সের শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অহরহ।
তাহলে কি এবার ইনফ্যান্ট সাইজ বোরখাও বের হবে বাজারে?
মোটেই না!
কবছর আগে বাংলাদেশের শিক্ষা এবং পাঠ্যপুস্তকবোর্ডগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় সমস্ত বইয়ের ছবির ছেলেমেয়েদের শরিয়া সম্মত পোশাক পরিচ্ছদ পড়াতে হবে.
সে সময় রং দিয়ে মেয়েদের জামার হাত লম্বা করে, ওদের মাথায় স্কার্ফ এঁকে দেয়া হয়েছিল।
ছেলেদের মাথায় এঁকে দেয়া হয়েছিল টুপি।
এটা হয়েছিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই।
বলা বাহুল্য, এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর চেতনার একজন সেনানী তেড়ে এসেছি যেন আমার দিকে।
আসলে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” মুখস্থ মন্ত্র পড়তে পড়তে চেতনার সিলেবাসটি কবে হাওয়া হয়ে গেছে, বেচারা ধরতে পারেননি।
সব পাল্টাবে।
কিন্তু কিছুই পাল্টালো না।
শাহবাগ আন্দোলন হলো.
কিছু মানুষ মার্ খেলো, কিছু মানুষ রক্ত দিলো, কেউ কেউ দেশ ছাড়লো, কেউ কেউ অনেকটা সময় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে তারপর হতাশায় ডুবে গেলো।
তারপর যথারীতি সুযোগ বুঝে সরকার আন্দোলনটাকে কিনে নিলো।
আর কিছু ধান্দাবাজ লোক সেটাকে বেঁচে দিয়ে দিব্যি আখের গোছালো!
২০১৩ থেকে ২০২০।
সাত সাতটা বছর!
কী করলাম আমরা!
কোথায় ভাবলাম, এই ধাক্কায় দেশটা সামনের দিকে যাবে, তা না হয়ে বরং উল্টো পেছনের দিকে গেলো।
অনন্ত বিজয়, নিলয়, দীপন!
তারপর ২০১৬ তে হলি আর্টিজান!
তবুও আমরা কিছুই করলাম না!
এমনকি যার দুবেলা পেটে ভাত জোটেনা, তারাও আর কিছু না পারুক, নারীর পর্দার জায়গায় একদম পাক্কা।
বাসে, রাস্তাঘাটে চলাফেরায় নারী এবং শিশুদের ওপর পুরুষের যৌন আগ্রাসী আচরণ বাড়তে থাকলো।
নারী ও শিশু ধর্ষণের হার আকাশচুম্বী হলো।
এতো বড় স্পর্ধা যে তুমি ইসলামী রাষ্ট্রে বসে এইসব নিয়ে কথা বলো!
আইন সংশোধনের নামে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটা তুলে নেয়া হলো, অথচ দেশের নারী অধিকার সংস্থাগুলো কিছুই করলো না।
তাঁরা যদি সত্যিই চাইতেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই বাল্যবিবাহ আইনের পরিবর্তনটিকে আটকানো যেতো না?
সেই ১৯২৯ সালে যেই আইনটিকে প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেই আইনটিকে সংস্কারের নাম, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে বিশেষ ক্ষেত্রে তার আগেই তাদের বিয়ের বিধান তৈরী করে সরকার যে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ধর্ষক এবং পেডোফাইলদের জন্যে বিশেষ সুবিধে তৈরি করে দিলেন, কেন তার কোন প্রতিকার কেউ চাইলো না?
কেন সবই মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন?
কেন? না, তারা সরকার বাহাদূরকে খুব বেশি চটাবেন না, আর সরকার বাহাদূর আবার হাঁড়িটা বেঁধে রেখেছেন সেই শফি হুজুর এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে!দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভেতর যারা এখনও জীবিত, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের পকেটে , সুতরাং প্রতিবাদ করবে কারা!আর এর ভেতর যারা একটু সাহস করে সামনের দিকে এগোবে তাদের টুঁটি চেপে ধরছে ৫৭ দফা; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ! যে আইনে নারী এবং শিশুরা হ্যারাসমেন্টের শিকার হলে বিচার পাওয়া যায় না, কিন্তু আপনি একটি গান কিংবা কবিতার ছত্র পোস্ট করেও সরকারের রোষানলে পড়তে পারেন!
সুস্থ, স্বাভাবিক, মুক্তচিন্তার মানুষ তবে কোথায় যাবে?
আমরা তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানের কথা বলি, আইসিস অধিকৃত সিরিয়া কিংবা ইরাকের কথা বলি!
আদতে কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ওই দেশগুলোর বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
আমরা টের পাইনি, এই যা।
শুধু মাননীয় সরকার মহাদয়ের সালাফি প্রভুদের দয়ায় এখানে একটুখানি মুক্তবাজার এবং ধনতন্ত্রের কিছু বিশেষ ছাড় আছে মাত্র, অনেকটা ওই হালাল নাইটক্লাব আর হালাল পতিতালয়ের মতো!