‘তুশি’ কি মিডিয়ার বিক্রয় পণ্য?

রাফিয়া মাহমুদ প্রাত:

আমাদের সবার নিশ্চয়ই স্মৃতির পাতায় ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে নিজ বাসায় বাবা মাকে হত্যাকারী সেই ঐশী রহমানের নামটি এখনো মনে আছে। নিজ বাবা মাকে হত্যাকারী এই ঐশী নাম কখনোই ভুলবার নয়। মানুষ তাকে সারাজীবন মনে রাখবে একজন নৃশংস হত্যাকারী হিসেবে। যে নেশার জন্য নিজের বাবা মাকে কুপিয়ে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। এটি সেই হত্যাকাণ্ড যা পুরো দেশকে এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। আজ এতো বছর পরও যদি আমরা এই ঘটনা মনে করি আমাদের শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। আর এই ঐশী চরিত্রকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে আগস্ট ১৪ ওয়েব সিরিজটি।

ওয়েব সিরিজটি নিয়ে বিতর্ক এখনও থামছে না। কেউ বলছে অশ্লীলতায় ভরপুর; আবার কেউ বলছে এতোটুকু না থাকলে তুশি চরিত্রেরই যথাযথ রুপায়ন কী করে সম্ভব হতো? কিন্তু এ দুটোর থেকে একটু ভিন্ন পথে কি আমরা হেঁটে দেখেছি?
বেশিরভাগ গণমাধ্যমকর্মী বা শিল্প সাহিত্যিকদের চোখে সিরিজটি ব্যাপক বাহবা কুড়ালেও লেখক তামান্না সেতু একটু অন্যদিকেই হেঁটেছেন সিরিজটির ব্যপারে। যা আমার কাছেও যুক্তিযুক্তই মনে হয়েছে।

প্রথমেই আসা যাক এই প্রশ্নে যে ঐশী রহমানকে আমরা এতোদিন কী হিসেবে চিনে এসেছি? মাদকাসক্ত, ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ুয়া, বখে যাওয়া এক কিশোরী। নেশার ভয়ানক ছোবল যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করতে বাধ্য করেছে।

এমনিতেই সমাজ কোনো সমস্যার গভীরে না গিয়ে কেবল ওপর থেকে দেখে সিদ্ধান্তে চলে আসতে পছন্দ করে। তার ওপর এই সিরিজটি দেখার পর ঐশী চরিত্রের প্রতি আরো ঘৃণা যেন বেড়ে যায়। বাস্তবে আমরা তাকে একজন নেশাখোর, বাবা-মার হত্যাকারী হিসেবে জেনে থাকলেও এই আগস্ট ১৪ দেখার পর আরেকটি নতুন তকমা তার নামের সাথে যুক্ত হয়।আর তা হলো পণ্যস্ত্রী। এখন তাকে শুধু মাদকের নেশায় হিতাহিত বুদ্ধি লোপ পাওয়া এক হত্যাকারীই বলা হবে না। সাথে যৌন আসক্তে মত্ত এক কিশোরীও বলা হবে।

সিরিজটি যাদের প্রচণ্ড ভালো লেগেছে তাদের অধিকাংশের ভাষ্যমতে ঐসকল সাহসিকতার দৃশ্য না দেখালে তুশি চরিত্রটি পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো না।

কিন্তু তুশির সবার আগে পরিচয় হলো সে একজন কিশোরী, এবং মাদকাসক্ত এবং তার এই আসক্তির তীব্রতা তাকে বাবা মাকে হত্যা করতে পর্যন্ত নিয়ে গেছে। একজন মাদকাসক্ত, নেশাখোর ব্যক্তির যে দিকটি সব থেকে বেশি ফুটিয়ে তোলা উচিত ছিলো তা হলো তার মানসিক অস্থিরতা, নেশাদ্রব্য সেবনের জন্য ব্যাকুলতা, মানসিক ও শারীরিক অস্থিরতা এবং তার মানসিক যন্ত্রণাগুলো। সে যে একজন বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল মাদকের ক্রমাগত ব্যবগারে, উচিত ছিল তা তুলে ধরা। কিন্তু তার চেয়েও যেন বেশি জোরালোভাবে দেখানো হয়েছে তার একাধিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি। পুরো সিরিজে এটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর আমাদের সমাজ এখন এই ঐশীকে মাদকাসক্ত এক তরুণীর চেয়েও একজন নোংরা,পণ্যস্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।

ওয়েব সিরিজের অশ্লীলতা নিয়ে বর্তমানে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সংবাদপত্র,অনলাইন পোর্টাল থেকে বিবিসি বাংলা পর্যন্ত অনেক সমালোচনা হচ্ছে। ঘটনার প্রয়োজনে যদি এমন কোনো দৃশ্য দেখানোর দরকার হয় তবে তা অবশ্যই ঠিক আছে। এটি অশ্লীল কিনা সেই প্রশ্নে না গিয়ে আমি বলছি, আসলেই কতোটুকু প্রয়োজনীয়তা ছিলো! কারণ কাহিনী নির্মাণে আরও অনেক জায়গায় জোর দেয়া যেতো । এই বিষয়গুলোর প্রতি এতো জোর না দিয়ে যদি কীভাবে তুশি জড়িয়ে পড়লো তা দেখাতো, কীভাবে এসব আমাদের তরুণ-তরুণীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে তা দেখাতো, পুলিশের তদন্তের জায়গাগুলোতে কোনো অস্পষ্টতা না রেখে যদি কী করে বন্ধু জিমিকে ধরলো, রিমান্ডের বিষয়গুলোটে ধোঁয়াশা না রেখে পরিস্কার করে দেখাতো। গোয়েন্দা টিম কীভাবে কাজ করছে সেদিকে পরিস্কারভাবে নজর দিতো তাহলে হয়তো দর্শকরাও সচেতন হতে পারতেন। কিংবা বাবা- মাকে হত্যার পর তুশির ভেঙ্গে পড়া, আত্ম অনুশোচনায় নিজেকে কুঁকড়ে ফেলা, নিজের কৃতকর্মের জন্য যেই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা তাকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে সেই জিনিসগুলো যদি ফুটিয়ে তুলতে পারলে আমাদের তরুণ-তরুণীরা উপলব্ধি করতে পারতো, সাবধান হতে পারতো। যারা জড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে তারা নিজেদের শুধরে নেয়ার একটা সুযোগ পেতে পারতো। কিন্তু এই সিরিজটি হয়তো উল্টোটাই করছে। অন্তত আর কিছু করুক বা না করুক বাস্তব ঐশী চরিত্রটিকে নোংরামোর শেষ সীমায় নিয়ে গেছে।

তার চেয়েও বড় বিষয় ঐশী রহমান হয়তো কখনোই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতো না। ফিরে পাওয়া সম্ভবও না আমাদের সমাজে। কিন্তু তাও যদি ৫% সম্ভাবনাও থাকতো ভালো থাকার, সেটাও বোধ হয় নষ্ট করে দিলো এই সিরিজ। ঐশীর কথা বাদই দিলাম। সে তার বাবা মায়ের খুনি। কিন্তু তার ছোটভাই এর কথা কি একবারও ভাবা উচিত ছিলো না? এই সিরিজের কাহিনী ভাইটির জন্য কতোটা অপমানের, অস্বস্তির এবং লজ্জার হতে পারে! নাকি তুশি চরিত্রটিকে অর্থের বিনিময়ে পণ্য করে দেয়া হচ্ছে ?

তুশি যদি কোনো মেয়ের চরিত্র না হয়ে কোনো ছেলে হতো, ঐশী চরিত্রটি একজন মেয়ের চরিত্র না হয়ে ছেলে চরিত্র হতো, তখনও কি তার প্রতিকৃতি নির্মাণে এভাবে শারীরিক সম্পর্কের প্রতি জোর দেয়া হতো? নাকি তখন কীভাবে মাদকদ্রব্যগুলো চালান হয়, কীভাবে তরুণ-তরুণীর মাঝে পৌঁছায়, সেই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে দেখানো হতো???
সন্দেহ রয়েই যায়। কারণ আমাদের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে তো মেয়েদের পণ্যায়ন এবং রসালোভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা নতুন কিছু না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.