পুরুষদের বলছি, ‘বাবা’ হবার আগে মানুষ হোন

রাফিয়া তামান্না:

২০২০ সালে এসেও বাংলাদেশের ঠিক কতজন পুরুষ সঠিকভাবে ‘বাবা’র দায়িত্ব পালন করে থাকেন? এই সংখ্যা যে অত্যন্ত নগণ্য তা হলফ করে বলে দেয়া যায় কোনো ধরনের পরিসংখ্যান ছাড়াই।

দুজন মানুষের ইচ্ছায় পৃথিবীতে যখন একটি নতুন প্রাণ নিয়ে আসা হয়, তখন সেই শিশুর গর্ভকালীন অবস্থা থেকে শুরু করে জন্মানোর পর বাকি জীবন পর্যন্ত মোটামুটি সকল রকমের দায়িত্ব বর্তায় মায়ের ওপর, সেই মা চাকুরিজীবী হোক বা গৃহিণী। আর সেই মা গৃহিণী হলে তো কথাই নেই, পুরুষ মানুষ কাজ করে টাকা কামাচ্ছে, স্ত্রী-সন্তানের ‘ভরণপোষণ’ এর ব্যবস্থা করছে, সন্তানের লালন-পালন ও যত্নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হবে, এটিই এদেশে প্রথা হয়ে গিয়েছে। চাকুরিজীবী মায়েদের ক্ষেত্রেও, ক’জন পুরুষ তার স্ত্রীকে মাতৃত্বকালীন সময় থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদানের পর সন্তানের পরিচর্যায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন? উত্তরটি সকলেরই জানা। চোখ-কান খোলা রেখে আশেপাশের মানুষের জীবনযাত্রা দেখলেই ব্যাপারটির স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়।

একজন নারী গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদান পর্যন্ত কতটুকু শারীরিক ও মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করেন, সেটা অনুভব করা কোনো পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। নারীর সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক অবস্থাভেদে সেই কষ্টে বিভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। গর্ভকালীন অবস্থায় শারীরিক কষ্টের পাশাপাশিও বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মানসিক চাপে ভুগে থাকেন নারীরা। একারণে এসময় দরকার দৈনন্দিন কাজে তার কষ্ট লাঘব করা, মানসিকভাবে তার পাশে থেকে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করা। এবং এই কাজের দায়িত্ব সবার আগে সেই নারীর স্বামীর। এটি নারীকে সাহায্য করা বা দয়া করা নয়, যেকোনো স্বাভাবিক, মানবিক মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

গর্ভাবস্থায় শারীরিক মানসিক সমস্যা কাটিয়েও বাসার সকল কাজ করা, অতিথি এলে আপ্যায়ন করা, স্বামীর ব্যক্তিগত কাজগুলো পর্যন্ত করে দেয়া, সন্তান জন্মদানের পর গর্ভধারণের শারীরিক ধকল কাটার আগেই সদ্যজাত শিশুর সকল যত্ন একা হাতে সামলানো, সন্তান বড় হবার পরেও ঘর সংসার ও ক্যারিয়ারের কাজ সামলিয়ে বাচ্চার সকল দায়িত্ব একা হাতে সামলে যাওয়া, এসবকে আমাদের সমাজে নারীর দায়িত্ব, মহানুভবতা, বৈশিষ্ট্য বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে যুগের পর যুগ, এবং এভাবে নারীর জীবনকে শুধু দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে। এই দায়িত্বগুলো যে নারীর একার নয়, বরং বাবা-মা উভয়ের দায়িত্ব সন্তানের পরিচর্যা করা, এটিই যে স্বাভাবিক মানুষের আচরণ, এটিই বলা হয় না। তাহলে যে সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের স্বার্থপর চরিত্রটি উন্মোচন হয়ে যাবে! এরচেয়ে বরং নারীর মাতৃত্বকে শুধু মহান বলে জপে গেলে পুরুষের দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়, এবং এই সমাজে এটিই নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র।

একটি নির্দয় প্রথা যখন কোনো সমাজে যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে, জনসাধারণ বুঝে কিংবা না বুঝেই সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়, এবং এটিই হয়ে আসছে এই সমাজে।

সমাজের নারীদের অনেকেই এই কষ্টগুলো দিনের পর দিন সহ্য করেও এটিকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে বাকি জীবন পার করে দেন, কেউবা সমস্যাগুলো বুঝতে পারলেও সামাজিক ও পারিবারিক চাপে এ ধরনের নির্দয় সম্পর্কে থেকে বাকিজীবন মুখ বুঁজে কষ্টগুলো সহ্য করে যান। সবচেয়ে ভয়ংকর ও কষ্টের ব্যাপার হলো, অনেক নারীই এই প্রথা যে বৈষম্যমূলক প্রথা, এটি বুঝেই উঠতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত কিংবা চাকুরিজীবী অনেক নারীও এটিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেন।

একটি ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টের কথা বলি এখানে। পোস্টটির সারমর্ম এরকম:

একজন নারী ‘মাতৃত্ব’ শিরোনামে লিখেছেন, তার স্বামী আদরে বড় হওয়া সন্তান, সাংসারিক কাজকর্ম জানেন না। গর্ভাবস্থার পুরো সময়টুকু তিনি বাসার সকল কাজ একা হাতে সামলেছেন, হাসপাতালে যাবার আগে সামনের দিনগুলোর বাজার করে রেখেছেন, এমনকি তার হাসপাতালে যাবার আগের দিন বাসায় ‘গেস্ট’ আসায় সেদিনও ‘অতিথি আপ্যায়ন’ এর ‘দায়িত্ব’ পালন করেছেন। সেই রাতেই তার লেবার পেইন উঠে এবং তিনি তার স্বামী চিন্তা করবেন দেখেন জানাননি। সকালে উঠে আরেকবার ‘অতিথি আপ্যায়ন’ শেষ করে স্বামীকে জানান সেদিন তার হাসপাতালে যাওয়া লাগতে পারে বললে, তার স্বামী তাকে কিছু টাকা দিয়ে বলেন তুমি চলে যেও আমি পরে আসবো! লেবার পেইন নিয়ে তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন তার স্বামীর অপেক্ষায়। এবং সবকিছুর পরেও তিনি মনে করেন তার স্বামী একজন কেয়ারিং ‘ভালো’ মানুষ।

এই হলো সমাজে অধিকাংশ নারীর অবস্থা এবং চিন্তাধারা। এবং বেশিরভাগ মানুষ এই পোস্টের ঘটনার নির্দয় ব্যাপারগুলো, যেগুলো সেই নারী সহ্য করেছেন, দেখতেই পাননি। ঐ একই ‘মহান মাতৃত্বের’ বুলি কপচানো হচ্ছে। সমাজ বাস্তবতায় এটি প্রথা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় ঐ নারী নিজেও বুঝতে পারেননি।

এটি তো শুধু একটি ঘটনা মাত্র। এরকম চিত্র আমরা অহরহ আশেপাশে দেখতে পাই। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সকল শ্রেণীর এধরনের পুরুষদের এই একটি দিক দিয়ে দারুণ মিল! এই একটি জায়গায় এসে তারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে যান।

স্ত্রী সন্তানকে মাঝেমধ্যে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে, বাসায় ফিরে সন্তানকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ ‘আমার সোনা বাচ্চাটা’ বলে আদর করে দিয়েই তারা ভাবেন, এইতো হয়ে গেলো আমার দায়িত্ব পালন, তারপর তারা স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঘুমুতে যান। একজন চাকুরিজীবী নারীর স্বামী এমন হলে তার কষ্টের মাত্রা বেড়ে যায় আরও বহুগুণে।

এছাড়াও কোনো নারীর নিজের সিদ্ধান্তে যদি তিনি গৃহিণী হয়ে থাকেন (নিজের সিদ্ধান্ত ছাড়াও, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর বাধায় বা সংসার-সন্তান সামলানোর চাপে সাবলম্বী হতে না পারা নারীর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা), স্বেচ্ছায় গৃহিণী হওয়া নারীর জীবনের ও একমাত্র কাজ বাসার কাজকর্ম করা ও সন্তান লালন-পালন করা নয়। একজন মানুষের নিজস্ব বহু ব্যক্তিগত কাজ, শখ থাকে৷ এক্ষেত্রে, স্বামী আর্থিক উপার্জন করার পরেও কি যাবতীয় সব কাজ করার দায়িত্ব স্ত্রীর নয় বলে প্রশ্ন তোলা হয়? উত্তর হলো: না, সকল সাংসারিক কাজ ও সন্তান পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কোনো গৃহিণীরও নয়। সন্তান নারীর একা নয়। পুরুষ টাকা উপার্জন করে ঘরে এসে কি টাকা চিবিয়ে খান? ঐ গৃহিণী নারী কাজ করছে না? পুরুষদের মনে রাখা উচিৎ নারী একটি আলাদা সত্ত্বা, কারো অধীনস্থ নয়। মা হয়েছেন বলেই সন্তানের সকল কাজের দায়িত্ব ও তার একার নয়, তা তিনি চাকুরিজীবী হোন বা গৃহিণী।

অবশ্যই সমাজে নিজের দায়িত্বগুলো পালন করা অনেক পুরুষ রয়েছেন, কিন্তু সেই সংখ্যা খুবই নগণ্য।

এ ধরনের পুরুষেরা, যারা অর্থ উপার্জন করে ও টুকটাক ‘সাহায্য’ করেই ভাবেন স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব এতোটুকুই, তারা না কোনো মানুষের জীবনসঙ্গী হবার যোগ্য, না বাবা হবার যোগ্য।

তাই, পুরুষদের বলছি, বাবা হবার আগে মানুষ হন।

লেখক: শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.