নাম, পরিচয় হারানো কতটা আরামের?

বনানী রায়:

একজন মানুষ যখন ছোট থাকে তখন তার পরিচয় সে কারো নাতি বা নাতনি, ছেলে বা মেয়ে, ভাই বা বোন। এই পরিচয়কে ছাড়িয়ে তার নিজস্ব পরিচয় বানাতে তাকে কিছু হতে হয় বা করতে হয়। মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বলেই হয়তো নিজেই নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেই চলেছে।

ছেলেরা বড় হয়ে যখন নিজের পরিচয় তৈরি করে ফেলে, তাকে প্রায় শেষ জীবন পর্যন্ত সেই পরিচয়েই সবাই চেনে না জানে। এই পরিচয়ে বার বার ব্যাঘাত ঘটে শুধুই মেয়েদের। আমি দশ বছর বয়স থেকে গান করি এবং আরও ছোটবেলা থেকে গান শিখি। আমাদের গ্রামটা ঠিক অজপাড়া গাঁ ছিল না। আমরা শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সবাই মিলেমিশে বড় হয়েছি। আমি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগ পর্যন্ত প্রত্যেক বছর গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। আমাকে সেই ছোটবেলা থেকে সবাই ‘বনানী রায়’ নামে চিনতো। এভাবে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত চললো গান শেখা এবং গান করা। আমি লেখাপড়াতেও সবসময় ভালো ছিলাম। কোনোদিন খারাপ ফলাফল করিনি। এসএসসি পাশ করার পর ভাগ্যের ফেরে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। দাদার বাসায় থেকে বাকি পড়াশোনা চলতে থাকলো, গানটা একরকম বন্ধই রইলো। কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে কিছু অনুষ্ঠানে গান করার সুবাদে বনানী রায় পরিচয়টা পুরোপুরি হারিয়ে গেল না। কিন্তু গান শেখাটা বন্ধ রইলো।

লেখাপড়া শেষে ঢাকায় একটা ব্যাংকে চাকরি পেলাম। গানটা তখনও জড়িয়ে ছিল। তবু ব্যাংকার পরিচয়টাই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হলো। তারপর বিয়ে হলো, অমুকের পুত্রবধূ, তমুকের বউ হলাম। দু বছর পর মেয়ে হলো। মেয়ের নাম রাখলাম রঙ। মেয়েকে শাশুড়ি মায়ের কাছে রেখে অফিসে যেতাম, একদিন বাসায় মোবাইল ফোনে কয়েকবার চেষ্টার পরও কারো সাড়া পেলাম না। পাশের বাসায় ফোন দিলাম, নিজের নাম বললাম, চিনলো না। বোঝানোর জন্য ‘পাশের বাসার বৌদি’ বলার পর বললো, ও আচ্ছা, রঙের মা? আমি নিজেই বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কে? উনি আবার বললো, রঙের মা বৌদি? এবার আমার মাথায় ঢুকলো, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলে হেসে ফেললাম। এর আগে আর কেউ বলেনি তো, তাই প্রথমটায় বুঝিনি।

আমার স্বামী আমাকে বনা বলে ডাকে। আমার মেয়ে হওয়ার পর বাবা (শ্বশুরমশাই) আমার স্বামীকে বললেন, তুমি বৌমাকে নাম ধরে ডাকবে না, ‘রঙের মা’ বলে ডাকবে। আসলে আগের দিনে সেভাবেই বোধহয় সম্মান দেয়া হতো স্ত্রীকে। আমি অসহায় দৃষ্টিতে আমার স্বামীর দিকে তাকালাম। পরে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সত্যিই আমাকে ‘রঙের মা’ বলে ডাকবে? কেমন বুড়ি বুড়ি লাগছে। আমার স্বামী হা হা করে হেসে দিল। সে অবশ্য বনা বলেই ডাকে এখনও।

মেয়ের যখন এক বছর বয়স সংসারের প্রয়োজনে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম। তারপর একসময় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করলাম। মেয়ের স্কুলের নাম প্রকৃতি। এবার আমি প্রকৃতির মা হয়ে গেলাম। কোথায় হারিয়ে গেল গায়িকা বনানী রায়, ব্যাংকার বনানী রায়! তারপর ছেলে হলো, একসময় তাকেও স্কুলে দিলাম। তার স্কুলে আমার নাম ঋতুরাজ এর মা। আমি ছেলেমেয়ের মা, এটা আমার গর্ব। আমি একজন ভালো মানুষের স্ত্রী, সেটাও আমার গর্ব। কিন্তু সেটাতে একজন মানুষের পরিপূর্ণতা আসে না। পরিপূর্ণতা, আত্মবিশ্বাস, স্বনির্ভরতা, মানসিক স্বস্তির জন্য নিজের পরিচয় খুব, খুব দরকার। প্রত্যেকটি মানুষ বাঁচতে চায় তার নিজের পরিচয়ে, তার নিজস্ব নামে।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে একদিন কথা প্রসংগে বলেছিলাম, হারিয়ে গেছি আমি সবার মাঝে, নিজেকে আলাদা করে খুঁজে পাই না। এখন আমি কারো স্ত্রী, কারো মা। আমার বন্ধু আমাকে বললো, “এই পরিচয়গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ, শুধু কিছু টাকা উপার্জন করলেই সব পাওয়া যায় না।” আমার সেই চিরচেনা বন্ধু আমার অভিমানের জায়গাটা বুঝলো না, কারণ বোধহয় সেও একজন পুরুষ। তবে সব পুরুষই তার মতো ভাবে সেটা নয়, আমার স্বামী আমাকে চাকরি ছাড়তে নিষেধ করেছিল। সে ঠিক বুঝেছিল, আমি ঘর সংসারের কাজ নিয়ে ভালো থাকতে পারবো না। এখনও সে আমার লেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, যাতে আমি নতুন করে পরিচয় গড়তে পারি।

জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যখন সবদিক বিচার করে নিজেকেই নিজের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সবার মঙ্গলের জন্য। কিন্তু আফসোস হয় তখন, যখন সেই আত্মত্যাগের মূল্য না দিয়ে কেউ কেউ বলে আমরা চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে আরাম করি। এটা একজন পুরুষই বলতে পারে। যদি আমি বলি, আপনি সব ছেড়ে আপনার সন্তানের পরিচয়ে আর স্ত্রীর পরিচয়ে বাঁচুন। হারিয়ে যাক আপনার নিজের নাম, পরিচয়। যদি আপনি মেনে নিতে পারেন, তাতে আরাম খুঁজে পান তবে আমিও মেনে নেব আমার পরিচয় হারানোর কষ্ট। খুঁজবো না নিজের নাম, নিজের পরিচয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.