রাফিয়া মাহমুদ প্রাত:
আমাদের সমাজে সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালিগুলোর মধ্যে পতিতাবৃত্তি নিয়ে গালি অন্যতম।
হ্যাঁ, পতিতাবৃত্তি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়, ঘৃণার যোগ্য একটি কাজ। কিন্তু সমাজই তো এই পেশাকে তৈরি করেছে এবং জিইয়েও রাখছে। আরও বলা ভালো যে পুরুষের প্রয়োজনেই এই পেশার উৎপত্তি। কিন্তু পতিতাবৃত্তির সাথে নারী-পুরুষ উভয়ই জড়িত থাকলেও কেবলমাত্র নারীকেই তাদের পরিচয়কে ধরে উঠতে বসতে কত গালি দিতে শুনি চারপাশে!
কিন্তু আমরা কি কখনো বাইরে থেকে বিচার না করে, ভেতরে ঢুকে জানার চেষ্টা করেছি এই দেহব্যবসায়ীরা কতোটা অসহায় বলে এমন কাজ করতে বাধ্য হয়? আমরা হয়তো তাদের নিয়ে যাচ্ছেতাই বাজে কথা বলছি, কিন্তু তাদের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে কয়জন ভেবে দেখেছি যে কী প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা, টাকার কষ্টে, অভাবের বলি হয়ে তারা এই পথে রোজগার করতে বাধ্য হচ্ছে? কয়টা মেয়ে স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসে?
না, তা কখনও আমরা ভেবে দেখিনি। এমনকি ভাববার, জানবার ইচ্ছে বা চেষ্টা কোনটিই আমাদের নেই। কেননা তাদের নাম শোনাও তো পাপ! তাদের কথা ভাবলেই নাক সিঁটকে তাদের দূরে ঠেলে দিই আমরা।
আমি জানি আমার এই লেখাটির সঙ্গে অধিকাংশ মানুষই একমত হতে পারবে না, বিশেষ করে পুরুষেরা। উল্টো আমাকেই তারা ঐ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে। আর আমার লেখাগুলো তাদের উদ্দেশ্যেই।
কারণ তারা হয়তো জানে না বা বোঝে না যে এইসকল নারী কর্মীদের জীবন-বাস্তবতা আসলে কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে!
হ্যাঁ আমি তাদের যৌনকর্মী বা দেহ ব্যবসায়ী বলেই সম্বোধন করবো। কারণ যেই মানুষগুলো পেটের দায়ে, বাধ্য হয়ে, অভাবে পড়ে নিজেদের এভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে, শুধু তাই না, কী পরিমাণ মানসিক শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে, তাদের আমি ঐ সকল শব্দ দিয়ে ছোটো করতে চাই না। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার চোখে তারা সম্মানেরই।
আর এই সাহসটা পাই যখন দেখি এদের নির্মম জীবনের গল্পগুলো। এদের মধ্যে অধিকাংশই থাকে যাদের খুব ছোটবেলায় এখানে এনে জোর করে বিক্রি করে দেয়া হয়। তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি ধরে তাদের বাধ্য করা হয় এই কাজে। একবার এক সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয় রাজবাড়ীতে অবস্থিত, সেখানে একদম ১০ বছর থেকে শুরু করে ৫০ বছর পর্যন্ত কর্মীরা থাকে। এই যে ১০ বছর বয়সী একটি শিশু, সে তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই পরিবেশের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলছে। এরপর যখন তারা বড় হয়ে এই জীবন থেকে মুক্তির আশায় অন্য কোনো ভালো কাজে রোজগার করতে চায়, তখন আবার এই আমরাই তাদের বাধা দিই। আমরাই তখন তাদের সুস্থ স্বাভাবিক সুন্দর জীবন কাটানোর পথে কাঁটা হয়ে যাই। যেন তারা কোনো ভাইরাসের মতো, অস্পৃশ্য, ধ্বংসাত্মক; আমাদের সাথে কাজ করলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।
তাহলে বলুন এই মানুষগুলো পতিতালয় ছাড়া আর যাবে কোথায়? আমরাই তো তাদের আমাদের সমাজে ঢুকতে দিচ্ছি না। কোণঠাসা করে রেখেছি তাদের। আবার এই আমরাই তাদের নামে নাক সিঁটকাচ্ছি, গালি দিচ্ছি, বাজে মন্তব্য করে যাচ্ছি। অথচ এই পতিতালয়গুলো যাদের নিয়ন্ত্রণে চলে, এর পেছনের মূল হোতাদের উচিত আমাদের ঘৃণা করা। বাজে কথা শোনানো উচিত তাদের। কিন্তু আমরা উল্টো তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যাচ্ছি। অসহায় নারীদের কব্জা করে যারা সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে তাদের কিছুই হচ্ছে না। উল্টো কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তারা তাদের এই জঘন্য অমানবিক ব্যবসা দিনের পর দিন জমজমাটভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
এইবার বলি আরেক শ্রেণির মানুষের কথা, যাদের কথা ভাবতে গেলে হাসি ছাড়া আর কিছু আসে না। এরা হলেন সেই সকল পুরুষ যারা লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে, পরিবারকে ধোঁকা দিয়ে পতিতালয়ে যায়, কিন্তু বাইরে এসে আবার এরাই সব থেকে বাজে মন্তব্যটি করে। অথচ এরাই কিন্তু এসব পতিতালয়ের আয়ের উৎস। কিন্তু আমরা তাদেরও এতোটা খারাপ চোখে দেখি না যতোটা একজন দেহব্যবসায়ী নারীকে আমরা দেখি।
আল জাজিরার এক রিপোর্টে দেখেছিলাম, এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির জন্য অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সমাজের এই
অপমান, গ্লানি, নৃশংসতা, শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতা তাদের আত্মহত্যাকেই শেষ ঠিকানা করে দিয়ে গেছে।
বিবিসির এক রিপোর্টে দেখেছিলাম, পতিতালয়ে সদ্য জন্ম নেয়া এবং জন্মের পরপরই মৃত এক ছোট শিশুর জানাজা, দাফনের জন্য কোনো মানুষ পাওয়া যায়নি। এই নিষ্পাপ শিশুটির কী দোষ ছিলো? তার দোষ একটাই ছিলো তা হলো তার মা, নানি একজন যৌনকর্মী এবং তার জন্ম পতিতালয়ে।
আরেকটি ঘটনা পড়েছিলাম, এক যৌনকর্মী তার সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে কিছু ক্ষতিকর ওষুধ সেবন করছে। ঐ ওষুধ সেবনের ফলে মৃত্যু ঝুঁকি আছে তা জেনেও সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এই ঝুঁকিও তারা নিচ্ছে।
আমরা এদেরই অসম্মান করি। অথচ আমাদের মাঝে এমনও কিছু মানুষ থাকে যারা শখে, আনন্দে এই পথে হাঁটে। তাদের না আছে কোনো অভাব, না কষ্ট। ভোগ বিলাসিতায় এসবে মেতে থাকে। আমরা তাদের ঘৃণা না করে এই অসহায় মানুষগুলোর গায়ে থুতু ফেলি।
আর এই কাজগুলোতে মেয়েদের, নারীজাতিকেই সবসময় দায়ী করা হয়। যেন নারীরাই এই সব নিন্দা পাওয়ার যোগ্য। এমনকি বাংলা শব্দভাণ্ডারে পুরুষ যৌনর্মীদের আলাদা কোনো নামও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! কিন্তু নারী পুরুষের সমান অবদান না থাকলে তো এসকল কাজ সম্ভব হতো না। তাই শুধু নারীকেই অন্ধভাবে দোষ না দিয়ে পুরুষকেও সমানভাবে দোষী ভাবি, এবং সত্যিকার অর্থেই কারা এসব জঘন্য কাজ করছে তাদের চিনি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ