সৈয়দা সাজিয়া আফরীন:
কেস-১
ছেলেটি মোটের উপর ফর্সা ও ঠিক আছে টাইপের মুখাবয়ব। আবার এই ২০২০ এ তেল দিয়ে চুল ব্যাকব্রাশ করা পাবলিক। শার্টের রংগুলো কুতকুতে, চোখে কেমন কেমন ঠেকে টাইপের কথাবার্তা তার। ইত্যাদি মিলালে স্বাভাবিকভাবে এ সময়ের সুন্দরী কোনো মেয়ে তার প্রেমে পড়বার কথা নয়! আবার খুব যেটা না বললেই নয় বিয়ের বাজারে ছেলেটা হটকেক। কারণ মেধা তালিকায় থাকা বিসিএস ক্যাডার সে। তার নাম নাই বলি সুমন বা ফয়সাল কিছু একটা ধরে নেন।
অন্যদিকে সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েটি পোশাকে ফ্যাশনে ভীষণ ট্রেন্ডি। রক্ষণশীলতার ধার ধারে না। নিউজ প্রেজেন্টার অথবা এয়ার হোস্টেস হতে চেয়েছিল সে। চেয়েছিল না বলি, কারণ অনেক ঝড় ঝাপটায় এখনও সে দারুণ স্বপ্ন দেখে। কোনো এক অশুভ সময়ে (কুক্ষণে) মেয়েটির সাথে ছেলেটির দেখা হয়ে যায়- কথা হয়ে যায় – প্রেম হয়ে যায়- খুব দ্রুত গোপনভাবে বিয়েও হয়ে যায় তাদের।
গল্প এখানে শুরু- বর হয়ে যাওয়া ওই বিসিএস ক্যডার একমাসেই একজন কদর্য নির্যাতকে পরিণত হয়। দাম্পত্যে এমন একটি দিন নেই যেদিন মেয়েটিকে সে নোংরা ভাষায় গালি দেয়নি। মারধর মনে করেন বেশি না সপ্তাহে দুয়েকবার। পরে ভালো হয়ে যায়, ধর্মের বাণী শোনায়। মেয়েটিও লক্ষী পাখি স্বামীর সব কথা শোনে। সে ভেবেও ফেলে- থাক জীবন না হয় এ স্বামী-সংসারে দিই। স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে চেষ্টা করে যায় মেয়েটি।
কদর্য ওই ক্যাডারের তিন-চারটে পরকীয়া প্রেম আছে। বিয়ের কথা গোপন রেখে এ মেয়ে সে মেয়েদের বিয়ের আশ্বাস দেয় সে। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে নোংরা কথা ছড়ায়, আর মেসেজ করেও গালিগালাজ দেয়। সে মেয়েটিকে ঠিক ছেড়েও দিচ্ছে না! আবার দাম্পত্যও রাখছে না।
মেয়েটি বারবার জানতে চায়- তার এখন প্রতিকার কী? ডিভোর্স হলে প্রতারিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ কী? একবছর ধরে মার খেয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, এখন সে প্রতিকার চাইতে পারে কী না?
কেস-২
গল্পটি এক প্রভাবশালী নেতার–
একুশ পেরুনো মেয়েটির সাথে পঞ্চাশোর্ধ লোকটির কোন প্রেম ছিল না। দূর থেকে দূরের আত্মীয় ছিল তারা। মধ্যবয়সী ওই লোকের স্ত্রী সন্তান আছে। কিন্তু খুব অন্যভাবে ব্ল্যাকমেইল করে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তার সাথেই সম্পর্ক আছে এমন কথা ছড়িয়ে দেয় লোকটা। মেয়েটি যেখানেই যায় সেখানেই শোনে এই লোকের সাথে না কী তার সম্পর্ক! একুশ পেরুনো মেয়েটি ভয় ও লোকলজ্জায় পঞ্চাশ পার হওয়া লোকের প্রস্তাবে সায় দিয়ে তার বউ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বউ।
প্রথম বউ উপর্যুপরি মামলা করে বশে আনে স্বামীকে। এদিকে কয়েক মাসে অন্ত:সত্ত্বা হয় দ্বিতীয় স্ত্রী। একুশ পেরুনো মেয়েটির সমাজে কোথাও জায়গা নেই দ্বিতীয় বলে। বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেই। আবার স্বামীও তার খরচপাতি দেয় না। সম্প্রতি মধ্যবয়সী স্বামী ফোনে জানায় বিয়েটা নাকি এমনিই করেছে, সিরিয়াস কিছু না।
মেয়েটি প্রতিকার চেয়ে মামলা করেছে। সেটি ঝুলছে আজ তিন বছর। এদিকে বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন খেয়ে-পরে বাঁচার যুদ্ধ করছে মেয়েটি। মেয়েটিও জানতে চায়, তার প্রতিকার কী? কোথায় গেলে মিলবে সেটা! একটু সিমপ্যাথি পেতেও কেন তার এতো কষ্ট হচ্ছে?
কেস-৩
উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ বেতনে জব করা রুবার ডিভোর্স হয়েছে প্রায় চার বছর হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের কাছে থাকে। রুবার সন্তান হচ্ছিল না, রুবা বাসার কাজ করে না, রুবা চাকরি কেন করে–এসব দোষে বারংবার বিবাদ, মারধরের পর একসময় স্বামীই উপযাজক হয়ে ডিভোর্স দেয় তাকে। স্বামী ডিভোর্সের তিন মাসেই বিয়ে করেছে অল্প শিক্ষিত এক মেয়েকে। এদিকে বাবার ঘরে ফিরে এসে রুবা একরকম খুশি ও ঝাড়া গা ফিল করে। কারণ এখন সে বাবা মার কাছে থাকতে পারছে। বাবা মার একমাত্র সন্তান রুবা।
প্রাক্তন স্বামী নিয়ে তার মাথাব্যথা না থাকলেও ওই লোক বারবার তার সাথে যোগাযোগ করতে চায়। সে বোঝায় কমশিক্ষিত বউ নিয়ে সে মোটেও ভালো নেই। রুবাকে সে মিস করে।
ভাষাটা এমন– ‘রুবা, এমন একটি দিন নেই যেদিন তোমাকে আমি মিস করি না। আমি নাসরীনকে তালাক দিয়ে আবার তোমার সাথে থাকতে চাই।’ রুবা রাজি না হলেই গালি। ফোনে ব্লক করলে মেসেজে গালি। এরপরও বাগে আনতে না পেরে তার অশ্লীল ছবি বানিয়ে অনলাইনে ছাড়ে। নির্যাতনের শিকার রুবাও বার বার জানতে চায়- তার প্রতিকার কী? কীভাবে এ লোককে তার পিছু ছাড়াবে?
এ তিনটি গল্প সত্য ঘটনার রূপক বর্ণনা। ওরা সবাই মামলা করতে থানায় গিয়েছিল। ওদের তিনজনের কাছেই অভিযোগ প্রমাণে পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে।একজনের মামলা থানা এখনও নেয়নি। তবু প্রতিদিন মেয়েটি চেষ্টা করে। অন্য দুজনের মামলা বিচারাধীন বছর বছর ধরে। ওহ, হ্যাঁ, সমস্যাগুলোও আগের মতোই আছে। তাই ওরা প্রায় জিজ্ঞেস করে- প্রতিকার কী? প্রতিকার কী?
আমরা বলি জানি না। জানি না। সমাজ বলে সহ্য কর, সহ্য কর। আইন বলে ধৈর্য রাখো, ধৈর্য রাখো। ওদের মানসিক বল খুব দৃঢ়। তবুও এদের মধ্যে কেউ যদি বিষণ্ণতায় ডুবে যায় বা আত্মহত্যা করে, আমি অবাক হবো না।