সালমা লুনা:
কিছু সিনেমার ট্রেলার দেখেই সেটা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ট্রেলারেই কিছুটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল। সেই হেতু বিষয়বস্তু নিরিখে ‘থাপ্পড়’ এর জন্য অপেক্ষাটা খুব দীর্ঘ লাগছিল।
অবশেষে দেখে ফেললাম ‘থাপ্পড়’।
লিড রোল অমৃতাকে ঘিরে তার প্রতিবেশী শিবানী, অমৃতার এডভোকেট নেত্রা, অমৃতার মা সন্ধ্যা, শাশুড়ি সুলক্ষণা এবং অমৃতার বাড়ির কাজের মেয়ে সুনীতা নারী চরিত্রগুলি আবর্তিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র কাহিনির জন্য খুব অপরিহার্য হলেও অমৃতার স্বামী বিক্রম আর বাবা সচিন ছাড়া নেত্রার স্বামী রোহিত, অমৃতার ভাই, শ্বশুর, বিক্রমের বাবা ভাই এবং উকিল আর সুনীতার স্বামী এই পুরুষ চরিত্রগুলো তাদের স্বল্প বিস্তারেও মূলত নারীদের অবস্থানই তুলে ধরেছে নানাভাবে।
অমৃতা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। দশটা সাধারণ বাবা-মায়ের যেমন স্বপ্ন থাকে মেয়েকে উঁচু ঘরে বিয়ে দেবার, সিনেমাতে দেখাও গেছে তাই।
কর্পোরেট জবের উচ্চাভিলাষী স্বামীর সাথে দারুণ এডজাস্ট করে নেয়া অমৃতা নিবেদিতপ্রাণ হাউজওয়াইফ। সময়মতো ঘুম থেকে উঠে শাশুড়ির ব্লাডসুগার মাপে। স্বামীকে খুশি করতে রান্না শিখতে মনোযোগী অমৃতার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল স্বামী বিক্রম। তার প্রিন্টারের প্লাগটাও যে নিজে লাগিয়ে নেয় না। অফিস যাওয়ার সময় কখনো অমৃতা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে পর্যন্ত দেয়। বাপের বাড়ি বেড়ানো থেকে নিত্যদিনের যৌথ জীবনযাপনের চিত্রে দেখা যায় তারা সুখী দম্পতি। স্বামী বিক্রম অমৃতার বাবামার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।
সবই খুব পারফেক্ট।
গোল বাধে বিক্রমের লন্ডন অফিসে শিফট হওয়া উপলক্ষে পার্টিতে। যেখানে বাড়িভর্তি অফিসের লোকজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, অমৃতার বাবা-মা শ্বশুর-ভাশুর এবং একমাত্র ভাইয়ের উপস্থিতিতে বিক্রম অমৃতাকে থাপ্পড় দেয়।
মূলত সেখান থেকেই ছবি শুরু।
ঠিক ওই মুহূর্তে কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও সুখী হাসিখুশি অমৃতার চেনা পৃথিবীটা বদলে যায় ওই একটা থাপ্পড়ে। চারপাশের সমস্ত অসঙ্গতি এক নিমিষেই চোখের সামনে চলে আসে। সে বুঝতে পারে ওই একটা থাপ্পড় তার স্বামী বিক্রমের প্রতি তার নিবেদিতপ্রাণ ভালোবাসাকেও নিয়ে গেছে।
এই উপমহাদেশে বিবাহ হয় দুজন মানুষের মধ্যে। এই বিয়ের ফলে তারা একজন স্ত্রী এবং আরেকজন স্বামী রূপে পরিচিত হলেও এই বিবাহে স্বামী পদাধিকারী যে সুবিধাদি পেয়ে থাকেন স্ত্রী হিসেবে আরেকজন ঠিক একই সুযোগ সুবিধা পান না।
এবং এই যে পান না, এটা কিন্তু কোন লিখিত নিয়ম নয়। এটা পুরোটাই বহুবছর ধরে চলে আসা সংস্কার যা বানাতে এবং পাকাপোক্ত করতে সমাজ এবং সব পরিবার তাদের সম্পূর্ণ এফোর্ট দিয়েছে শত শত বছর ধরে। এক্ষেত্রে বাঙালি পাঞ্জাবী মারাঠি কিংবা গুজরাটি সবাই এক।এ যে শুধু পুরুষের সৃষ্টি, তাও না। নারীরাও একে সাদরে বোঝাপড়া বা সংসার টিকিয়ে রাখার এবং সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র বলে মেনে এসেছেন। কন্যা সন্তানকে শিখিয়ে এসেছেন। এটা যে আসলে বৈষম্য তা তারা মনেই করেন না ।
এখনও এই যুগেও যখন স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সমানতালে রোজগার করে, ঘরসংসার চালায়, তখনও এই বৈষম্য ঘুচেনি, নিয়ম হয়ে যাওয়া অনিয়মগুলো এতোটুকু পাল্টায়নি।
সেই নিয়ম হয়ে যাওয়া অনিয়মগুলোকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে একটা থাপ্পড়।
ছবি দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারি থাপ্পড় আসলে অমৃতারূপী তাপসী পান্নুর গালে বিক্রমরূপী পাভেল দেয়নি, বরং এই থাপ্পড় আসলে আমাদের এই সমাজের গালে দেয়া হয়েছে।
যে সমাজে একজন মা তার মেয়ের গায়ে জামাই হাত তুললে ভাবেন, সব সংসারে এরকম একটুআধটু হয়েই থাকে। মানিয়ে নিতে হয়।
ভাই বলে, অফিসে গোলমালের কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে করে ফেলেছে এমনটা। একটু মানিয়ে নিলেই বোনের সংসারটা বেঁচে যায়।
শ্বাশুড়ির মুখ দিয়ে সো কলড ‘মেনে আর মানিয়ে নেয়া সমাজ’ বলে উঠে- মেয়েদের মেনে নিতে জানতে হয়। মেনে নিলেই সংসারে ছেলেমেয়ে মানুষ হয়। আমিও তো মেনে নিয়েছি।
এই উল্টো রথে অমৃতার একমাত্র সারথী ছিলেন অমৃতার বাবা।
সিনেমা বলেই হয়তো বাবাকে এমনটা দেখানো হয়েছে। নয়তো বেশিরভাগ বাবাই তো সন্ধ্যার পিতাজীর মতো। কন্যা বিদায়ের সময় যিনি জামাতাকে জড়িয়ে ধরে কিংবা দুহাত জোড় করে আজও বলেন, জামাই বাবাজীবন যেন তার কন্যার কোন দোষ হলে নিজ গুণে ক্ষমা করে দেন। খুব কম বাবাই মাথা সোজা করে জামাতার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট করে বলতে পারেন, আমার মেয়ের যেন কোনো অযত্ন না হয়।
খুব অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে অমৃতার বাবার মতো বাবাও হয়তো থাকেন যিনি মেয়ের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে গলা টিপে না মেরে ফেলে মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পাশে থাকেন ধীরস্থির শান্ত হয়ে।
বাবা,আমি ঠিক করছি তো? মেয়ের এই প্রশ্নের জবাবে তার আত্মসম্মানের ক্ষততে প্রলেপ দেন এই বলে যে, কখনো কখনো সঠিক কাজটিও মানুষকে সুখী করে না।
এই জায়গাটায় এসে চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে বাধ্য।
আবার পরক্ষণে এও মনে পড়ে যায়, নিজের মেয়েটিকে রাজকন্যার চোখে দেখলেও বাবাটি কেন যে স্ত্রীকে অধিকৃত করে রাখার বেলায় মনে রাখতে পারে না যে সেও কোন বাবার রাজকন্যা!
বিক্রম চরিত্রটি সমাজের সকল এভারেজ পুরুষকেই প্রতিনিধিত্ব করে। যে তার প্রতিবেশী শিবানীকে নিজের সমকক্ষ একটি জীবন যাপন করতে দেখে, বড় গাড়ি চড়ে কাজে বেরোতে দেখে স্ত্রীকে শ্লেষভরে প্রশ্ন করে, করতি ক্যায়া হ্যায় ঔ?
অমৃতার এককথায় উত্তর, পরিশ্রম!
কিন্তু দর্শকের কাছে স্পষ্ট, এ হলো নারীর প্রতি সেই চিরাচরিত কুশ্রী ইঙ্গিত।
পুরুষ যখন বড় গাড়ি চড়ে তখন সেটি পরিশ্রমের কামাই। কিন্তু সেইম গাড়ি নারী চড়লে, সেইম পদে চেয়ারে নারী বসলেই সমাজ প্রশ্ন করে উঠে, কী করে ও? কীভাবে পারছে!

এমন অনেক ছোট ছোট বিষয় উঠে এসেছে সিনেমার নারী চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে।
অমৃতার শাশুড়ি যখন বলেন, উনকা কাম হো গ্যায়া, উনকি বাচ্চোকো ঘর বসা দিয়া আব মেরা কাম খতম।
অর্থাৎ সংসারে নারী স্ত্রী হয়ে স্বামীকে তার প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে দেবে, বাচ্চা মানুষ করতে জান দিয়ে দেবে। অতঃপর তারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঘরগেরস্তি সাজিয়ে নিলে নারীর কাজ শেষ! ব্যস?!
যে পরিবারে যে ঘরে নারীর জন্ম, বেড়ে উঠা সেই ঘরটিতে তার ভাইয়ের আজীবন অধিকার থাকলেও বিবাহিত নারীর কোন অধিকার থাকেনা। তাইতো অমৃতার মাও মনে করেন, মেয়ের বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই তার আসল বাড়ি। এবং বাপের বাড়িতে আসার তার অবশ্যই কোন কারণ থাকতে হবে। কারণ তিনিও তার মায়ের কাছ থেকে এটিই শিখেছেন।
নারী ঘুরে দাঁড়ালে যে কাহিনীটা বদলে যায় থাপ্পড় সেটা দেখিয়েছে। সে অমৃতা, কিংবা নেত্রার মতো উঁচুতলার নারী হোক, কিংবা বাড়ির কাজের লোক সুনীতা হোক না কেন ঘুরে দাঁড়ানোটা জরুরি খুব জরুরি।
আরেকটা জিনিস জরুরি, মান্ধাতা আমলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা।
থাপ্পড় এ যে সমস্যাগুলো দেখানো হয়েছে তার সমাধানও পরিচালক দেখিয়েছেন। বিক্রমের মা রূপী তানভি আজমির মুখ দিয়ে অমৃতাকে বলিয়েছেন।
দোষ মায়েরই।
মেয়ের মা যেমন মেয়েকে ভালো ঘরণী হতে উৎসাহিত দেন, সব সহ্য করার কথা বলে মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে বলেন, সেটা যেমন অন্যায়। তেমনি ছেলের মা-ও নিজের সারাটা জীবন দিয়ে সত্যটা বুঝলেও নিজ পুত্রকে নারীকে সম্মান করা তাকে সমকক্ষ ভাবার শিক্ষাটা দিতে পারেন না।
অমৃতার বাবার একটি কথা দ্রষ্টব্য, নিজের আনন্দ কীসে সেটা না জানলে পরে অন্যের আনন্দ দেখে আর ভালো লাগে না। বড় সত্য।
পুরো সিনেমাটি দেখেছি বুকে একটা চাপ, একটা অদ্ভুত ব্যথাবোধ নিয়ে।
দর্শক হিসেবে সেই পুরনো ধ্যানধারণা নিয়ে চলে আসা এই আমারও এক আধবার মনে হয়েছে শুধু একটা থাপ্পড়ই তো! একটু কেমন কেমন লাগে না! মাফ চাইছে স্বামী। স্বামী ভালোবাসে। স্বামীর কোন বদভ্যেস নেই। নিজেই বাপের বাড়িতে এসেছে নিতে, সাথে উপহার এনেছে মান ভাঙাতে কিংবা মন ভালো করে দিতে।
এভাবে হয় নাকি ডিভোর্স? সংসার ভাঙা এতোই সোজা!
কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে, একটা থাপ্পড় যদি এতোই হালকা! এতোই সোজা। তাহলে হাত তুললাম আর জাস্ট বসিয়ে দিলাম স্বামীর গালে।
সম্ভব?
সমাজ সংসারে অনাসৃষ্টি হয়ে যাবে না! স্বামীর অহমিকার ভীত কেঁপে উঠবে না!
থাপ্পড় দেয়ার ওই দৃশ্যটা সরে গিয়ে কেন জানি আমার মহাভারতের সেই দ্যুতসভার দৃশ্যটা চলে এসেছিল সামনে। দ্রৌপদী স্বামীর হঠকারিতায় দাঁড়িয়ে দুর্যোধনের অপমান সইছে, সেই দৃশ্য অবলোকন করছেন পিতৃস্থানীয় সকল ব্যক্তিবর্গ, দেবর আত্মীয় পরিজন অমাত্যবর্গ। কেউ টুঁ শব্দটিও করছেন না এক নারী, একজন মানুষের এ-হেন অন্যায় অপমানের৷
যুগে যুগে এইই তো হয়ে আসছে! নারীর অপমানে নিশ্চুপ সমাজ, সংসার।
এই থাপ্পড় আসলে সেই সমাজের গালে একটা চপেটাঘাত, যা রাতারাতি সমাজকে বদলে দিতে পারুক আর নাই পারুক। কিছু হোক বা না হোক অন্তত ভাবতে বাধ্য করছে, থাপ্পড়! সে তো অনেকেই দেয়। কিন্তু কেন দেবে? আর কেনই বা সহ্য করতে হবে!