সুপ্রীতি ধর:
আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল তার গায়ের রংটা আমাদের জন্য কিছুটা উজ্জ্বলই ছিল। বিশেষ করে রাশিয়ায় জন্ম বলেই কীনা জানি না, চুলগুলো ছিল লালচে, আর গায়ের রং অনেকটাই ফর্সা, একদম পুতুলের মতোন লাগতো ওকে। মনে আছে একদিন কী এক কথার সূত্র ধরে বেশ জোরের সাথেই বলেছিলাম যে ‘ভাগ্য ভালো, মেয়েটা আমার মতোন কালো হয়নি’, এবং আমি নিশ্চিত যে কথাটা আমি সেদিন উপস্থিত কাউকে শোনানোর জন্যই বলেছিলাম, যদিও আজ এতো বছর পর মনে করতে পারছি না।
আমার সেই কথাটা অনেকটা বর্ণবাদী শোনালেও এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে, ক্ষোভ আছে, অভিমান আছে, একরাশ কষ্ট আছে।
একটু বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই সবার মুখ থেকে শুনে এসেছি আমি ‘কালো’, ‘অসুন্দর’, ‘কোন কাজের না’, ‘আমাকে দিয়ে কী হবে’, ‘আমি উঁচ কপালি, চিরল দাঁতি, পিঙ্গল মাথার কেশ’, এই জাতীয় কথা। সেই ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত এসব নেতিবাচক কথার কারণে নিজেকে প্রায় গুটিয়ে রাখতাম। সবার সামনে আসতাম না, হাসতাম না, কথা তো বলতামই না, কারণ আমাদের পরিবারে ছোট বলে আমার কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনতোও না। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকায় কনফিডেন্স লেভেল একেবারে জিরোতে নেমে আসে আমার। যা আমি সারা জীবন বয়ে চলেছি। প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগি এখনও। আজ বায়ান্নতে দাঁড়িয়েও ‘আস্থাহীনতা’ আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। ‘করিতে পারি না কাজ, সদা ভয় সদা লাজ’ – লাজ হয়তো আর ততোটা নেই এখন আর, কিন্তু ভয় আছে। আমরণ থাকবে আশা করি। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এর থেকে আর বেরুতে পারলাম না। কোনকিছু করার সংকল্প করেও বার বার মনে হয় ‘পারবো তো?’ কিন্তু এতো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এও জানি যে ‘না পারার’ কিছু নেই আমার পক্ষে। শুধু চাইতে হবে। আমাদের সমাজব্যবস্থা, পরিবার, আত্মীয়-স্বজনরা যে কতোটা নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে, আমি মনে হয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
কিন্তু এতোসব নেতিবাচক মনোভাব আর সমালোচনার কারণেই কীনা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলাম সেই তখন থেকেই। তখন প্রকাশ পেতো প্রচণ্ড মেজাজ আর জেদ দেখানোর মধ্য দিয়ে, আরেকটা কাজ করতাম, তাহলো, পড়াশোনা। সারাক্ষণ পড়ার বই, নয়তো বাইরের বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম। গল্পের বই, কবিতার বই গোগ্রাসে গিলতাম। মূলত এগুলোই আমাকে মুক্তি এনে দিয়েছিল, নিজের একটা ভিন্ন জগত গড়ে নিয়েছিলাম। ফলে অন্যদের ওইসব নেতিবাচকতাকে আমি কিছুটা হলেও এড়িয়ে যেতে পেরেছিলাম বলেই আজ এমন দৃঢ়ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি, এবং গত ৩০টা বছর ধরেই চলছি। একে আপনারা আমার ‘সাফল্য’ বলেও ভেবে নিতে পারেন।
হ্যাঁ, একদিক দিয়ে আমি তো সফলই। কত শত নারী আমাকে অনুসরণ করে, অনুকরণ করে, আমার কাছ থেকে সাহস পায়, ভালবাসে আমাকে, একেও যদি সফল না বলি তো সফলতা কীসে আসে? যদি অন্যের জন্যই জীবনটাকে কাজে না লাগাতে পারি তো এই মনুষ্য জীবন কেন? এসেছি পৃথিবীতে, রেখে যাবো পদচিহ্ন, এই আমার মোটো।
ছোটবেলা থেকে নানান সমালোচনা যেকোনো শিশুমনকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমারও করেছিল। একে তো একাত্তরে ছোটবেলাতেই বাবাকে হারানোর মানসিক ট্রমা, পরবর্তিতে পরিবারে যে দুর্দশা নেমে আসে অভিভাবকের অভাবে, সবার ছোট হিসেবে তার প্রভাবও আমার ওপর পড়েছে। সারাক্ষণ কী যেন ‘হারাই হারাই’ একটা হাহাকার আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সবসময়, এখনও বেড়ায়। সব থাকার পরও আমি এই হাহাকার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি। অনেকেই একে বলে ‘বিলাসিতা’, আমি নাকি ‘দু:খবিলাসী’। জানি না, কেউ যেচে দু:খকে বিলাস করে কীনা! আমার ছোটবেলাটাই তো সারাজীবনের আয়না, সেদিকে তাকালে ‘ইতিবাচক’ কোনকিছুই চোখে পড়ে না।
সেই ছোটবেলাতেই বাড়িতে আশ্রিতদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া থেকে শুরু করে বড় হওয়ার প্রতিটি পদে পদে প্রতারিত হওয়া, বঞ্চনার শিকার হওয়া, বৈষম্যের শিকার হওয়া, সমালোচনা তো সেই শিশুকাল থেকে এখনও আমার সাথে ভালবেসেই মিশে আছে, আর এসবই আমাকে আজকের আমিতে পরিণত করেছে। সেখানে নতুন বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হয়েছিল আমার বাহ্যিক সৌন্দর্য, আমার গায়ের রং। আমি ‘কালো’, আমি ‘অসুন্দর’, আমার দাঁতে ফাঁক, দাঁত উঁচু। আহা, এতো খুঁত আমার! এই কালো রংটা বেশি করে সবার নজরে এসেছিল বাসায় নতুন বৌ আসার পর। তার এবং তার ছোট বোনের গায়ের রং ছিল বাঙালীর ভাষায় ‘ফর্সা’। তা তাদের চোখ কোটরাগতই হোক, আর তারা ‘নির্গুণ’ই হোক!
সুতরাং সেই থেকেই শুরু আমার জীবনের আরেক অধ্যায়ের। শত স্নানেও তো এই কালো ধোয়া যাবে না, তাই জীবনভর নিজেকে অন্য সবকিছুতে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে নিয়ে গেছি অন্য উচ্চতায়, যেখানে আমার ‘কালো’ রং, আমার ‘অসৌন্দর্য’ কিছুতেই প্রভাব ফেলেনি। একটু মিথ্যা বললাম। প্রভাব অবশ্যই ফেলেছে, তা মানসিকভাবে।
আমি যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যাই তখনই নিজেকে আবিষ্কার করি নতুন ভাবে। সবাই বলাবলি করতো আমি নাকি ‘আকর্ষণীয়া’। নিজেকে মেলে দেখতাম আয়নায়। সত্যিই বলতো ওরা সেদিন। আমার আয়ত চোখ, গালে টোল, সুন্দর ফিগার, গলার স্বর, স্মার্টনেস, সবই তো ছিল অন্যকে আকৃষ্ট করার মতোন!
মনে আছে, আমার ছোট দাদার জন্য যখন হন্যে হয়ে ‘পাত্রী দেখা’ চলছে, তখন সবাই গায়ের রংয়ের ওপর জোর দিচ্ছিল। নিজেকে তখন আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখতাম, আর মনে মনে বলতাম, ‘আমার কী হবে!’ আমিও যদি ‘পাত্রী’ হই, তবে তো প্রথম দর্শনেই নাকচ! কালো বলেই আমি ছিলাম সবার চোখে অসুন্দর, তাই আমি কখনও চিরাচরিত ‘পাত্রী’ হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারিনি। আমার পড়ালেখা, সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট, খেলাধুলা, নাচ, কোনকিছুই আমাকে ‘ভালো পাত্রী’ বানাতে পারেনি পরিবারের লোকজনের কাছে। সেজন্য তাদের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। কারণ সেদিন যদি ‘পাত্রী’ হতাম, তবে আজকের ‘আমি’ হতাম না, আর এই লেখা লেখারও যোগ্যতা আমার থাকতো না।
কাজেই এই বাঙালীরাই যখন বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদের উত্থানে সমালোচনায় মুখর হয়, আমি তখন হাসি। মজা পাই ভীষণ। কী ভীষণ দ্বিমুখী মানুষ! নিজের ঘরে ফর্সা বউ খুঁজবে গুণী মেয়েদের দূরে ঠেলে, ‘ভালো মেয়ে’ খুঁজবে যারা সাত চড়েও রা কাড়বে না, যারা ভালো-মন্দ গুণবিচারেও অপারগ, অক্ষম, অযোগ্য হবে, সেইসব ‘অনন্য পুরুষ’রা যখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন আমার ভিতরে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়।
এক বন্ধু একবার এক প্রকল্পের কাজের প্রকাশনা উৎসবে গিয়ে আমার কানে কানে বলেছিল, ‘আজ যেসব গুণীজনদের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তাদের ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয়া উচিত কতোটা গুণী সে নিজের ঘরে, নিজের মানুষজনের কাছে’। সবসময় আমার মনে পড়ে ওই বন্ধুর সেই দীর্ঘশ্বাসের কথাগুলো। ছোটবেলায় যখন ভাবসম্প্রসারণ করতাম, ‘সাদা আর কালো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারি সমান রাঙা’, তখন মনের মাধুরি মিশিয়ে কতোকিছুই না লিখতাম ভাবের সম্প্রসারণ হিসেবে। আজ তাই প্রশ্ন জাগে, ভিতরে কি আসলেই সবার সমান রাঙা? আমি বলি, না, সমান না। ভিতরে ভিতরেই কেউ কালো, কেউ রাঙা। বাইরে আকর্ণবিস্তৃত হাসিমুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরটা তাদের কতোটা কুৎসিত!
আমি সেই ‘কালো মেয়েটা’ আজ নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি নিজের সক্ষমতা দিয়েই। এখানেই আমি জয়ী।
পুনশ্চ: লেখাটা এর আগে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বাঙালী’তে ছাপা হয়েছে। ঈষৎ পরিবর্তন এনে এখানে দেয়া হলো।