ফারহানা আফরোজ জাহান:
মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা মেয়ের জামাই হিসেবে এমন ছেলে নির্বাচন করেন যে শিক্ষা-দীক্ষা বা চাকরি ক্ষেত্রে মেয়ের চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে থাকে। মেয়ে ছেলের চাইতে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হবে এটা যেমন মেয়ের বাবা-মা মানতে পারেন না, তেমনি সামাজিকভাবেও এর নেতিবাচক দিক কম নয়। কোনো বিএ পাশ মেয়ের বর যদি এসএসসি পাশ হয়, কিংবা কোনো ইঞ্জিনিয়ার মেয়ের জামাই যদি সাধারণ চাকুরে হয় তাহলে সেটা নিয়ে অনেক কটু কথা তৈরি হয়, তৈরি হয় নানা রকমের গল্প। এ কথাও বলতে শোনা যায়, নিশ্চয় মেয়ের কোনো সমস্যা আছে, নাহলে এইরকম বিয়ে হবে কেন?
এতো গেলো মেয়ের বাড়ির সমস্যা। এখানেই শেষ না। বিয়ে হয়ে যে শ্বশুর বাড়িতে গেলো সেখানেও মেয়ে শিক্ষা-দীক্ষা বা চাকরিক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে এটা মানতে যেন সবারই কষ্ট। মুখে মুখে হয়তো গর্ব করে বলবে আমার ছেলের বৌ অমুক, অনেক লেখাপড়া জানা, কিন্তু উঠতে বসতে যে তাকে খোঁচাগুলো দেয়া হবে সেটা অপ্রকাশ্য রয়ে যাবে বাইরের লোকের কাছে। এই যেমন, লেখাপড়া বেশি করেছে বলে দেমাগ, মানুষকে পাত্তাই দেয় না ইত্যাদি।
এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রের ঘটনা, ব্যতিক্রম থাকতে পারে। সেটাকে সাধুবাদ জানাতে হয়! কিন্তু এই বেশিরভাগ ঘটনাগুলো দেখে মনে হয় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিষয়টা পুরুষশাসিত সমাজে হয়তো মেনে নেয়া হয়, মন থেকে সেটাকে মানা হয় না।
সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত সুমাইয়া বেগমের মৃত্যুর ঘটনাটি যেন ঘুরে ফিরে বার বার নারীর ছোট হয়ে থাকাটাকেই নির্দেশ করে। সুমাইয়ার বাবার নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন ছিল মেয়েকে নিয়ে আর তাই বিয়ের পরেও নিজ খরচে পড়িয়েছেন মেয়েকে। তাহলে প্রশ্ন হলো, যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন তার স্বপ্ন পূরণের পথটা কেন বাধাগ্রস্ত করেছিলেন বিয়ের নামে কিছু অমানুষের হাতে তুলে দিয়ে। বাবা হয়ে যে পথটা মসৃণ করতে পারেনি, অন্যরা কি মূল্য বুঝবে তার? আর সে যদি তার স্বপ্নটা পূরণ করেই ফেলতো, তাহলে কি তার স্বামীসহ পরিবারের অন্যরা হীনমন্যতায় ভুগতো? হয়তো ভুগতো, কারণ, বৌ উচ্চপদে আসীন হয়ে চাকরি করবে এটা মানতে নিশ্চয় তাদের বাঁধতো।
এতো গেল সুমাইয়ার কথা! হাজার হাজার সুমাইয়া এরকম প্রতিদিন তাদের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বেঁচে আছেন। আমি এ যাবৎকালে যত বিয়ে দেখেছি সব জায়গাতেই বলতে শুনেছি, ‘ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বৌ না, ঘরে মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি’। আহারে! এই মেয়েদের প্রতি পরবর্তীকালের আচরণ যদি পর্যবেক্ষণে রাখা যেতো! সুমাইয়ার বাবাকেও নিশ্চয় কোনো আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে বিয়ের পরও ও পড়াশুনা করতে পারবে যতদূর খুশি! মনে যদি অন্য কিছুই থাকবে, তাহলে তার পড়াশুনার বিষয়টি মেনে নেয়ার দরকারই বা কী ছিল?
কেন এই প্রহসন নারীদের সাথে?
মেয়ে হয়ে জন্মটাই এক বিরাট গোলকধাঁধা। .. লেখাপড়া/চাকরিতে স্বামীর চেয়ে কম হলে তো স্বামী শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাত্তাই দেবে না, Superiority complex এ ভুগবে। আর কোনো কারণে লেখাপড়া/চাকরিতে স্বামীর চেয়ে বেশি হলে ভুগবে Inferiority Complex এ। কই যাবেন? আর এই কমপ্লেক্সগুলো থেকে তারা যা করবে, তা একটা মেয়ের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার জন্য যথেষ্ট, এমনকি তার পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়। সুমাইয়া তার জ্বলন্ত উদাহরণ!
প্রিয় বাবা – মা, কী করবেন আপনারা? আদরের মেয়ে, যাকে তিল তিল করে বুকের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে মানুষ করছেন, এক লহমায় তার জীবনের ইতি টানছে সেই মানুষটা যার হাতে সমর্পন করছেন মেয়েকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রুমানা মনজুর এর বিষয়টি থেকে শুরু করে আজকের সুমাইয়া … কোন অপরাধের শাস্তি তারা পেয়েছেন? একজন রুমানা মনজুর বা একজন সুমাইয়া আমাদের কাছে এক একটি সংখ্যা মাত্র, একটি percentage এর অংশ মাত্র। কিন্তু এই একটি মানুষ তার পরিবারের জন্য শতভাগ। যে হারায় তার কিন্তু কোনো পার্সেন্টজ এ ক্ষতি হয় না, তার ক্ষতি তার পরিবারের ক্ষতি ১০০%।
অনেক সময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনেক বিষয় মেনে নিতে হয়, আমরা মন থেকে মানতে না পারলেও। সবাই মিলে বাইরে খেতে যেতে চাইলে অনেক সময় নিজের যেতে ইচ্ছে না করলেও আমরা মেনে নিয়ে যাই। কিন্তু সবক্ষেত্রে এরকম করা যায় না। কারও মেনে নেয়া আর মনে নেয়ার মূল্য যদি জীবন দিয়ে দিতে হয়, তাহলে সেই মেনে নেয়ার কোনো মানে হয় না। এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট আচরণই কাম্য।
লেখক: গবেষণাকর্মী