কোনদিন কাঁদতে দেখিনি বাবাকে

সহদেব ভানু দাস:

বাবাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। কতবার হাত কেটেছে ধান কাটতে গিয়ে। জ্বর, অসহ্য পেটের ব্যথায় কাতরাতে দেখেছি বহুবার , বাবার চোখে জল দেখিনি। কিন্তু অদ্ভুত ! দেখলাম একবার …… বাবা মা দুজনে আনমনে কথা বলছিল। আমিও ব্যস্ত ছিলাম কিছু একটা নিয়ে। হঠাৎ দেখি খেলতে গিয়ে বোনের পা সাইকেলের চেইনে আটকে গেছে। আমরা কেউই পা বের করতে পারছিলাম না। রক্তে পা ভেসে যাচ্ছিল। বাবা শেষে চেইন কেটে বের করলো বোনের পা টাকে । আমি নিশ্চিত বোনের থেকে বাবা বেশি কষ্ট পেয়েছিল। সেদিন দেখেছিলাম বাবার চোখে জল। আমি আর মা, বাবার চোখের জল দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম।

বেশ মনে আছে দিনগুলো। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। একবোন সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আর একজন মায়ের কোলে। বাড়িতে বেশ অভাব। বাবা মা, আমি আর দুইবোন এই পাঁচের সংসার। বাবা জনমজুর খাটতো বাবুদের বাড়িতে। সময় বিশেষে অন্যের কাজও করে দিত কিছু টাকা ও অনেকসময় ভালবাসার খাতিরে। তবে সবটা কিন্তু ভালবাসা নয়, শোষণ বলেও একটা শব্দ আছে বাংলা অভিধানে।

আমি ছোট থেকে মা ঘেঁষা, তাই মায়ের ছেলে বলা চলে। বাড়িতে অল্পবিস্তর ঝামেলা হলে মায়ের হয়েই কথা বলতাম বেশি। বাবা আমার চোখে অনেকটা এরকম- বাবার কষ্ট হয় না , বাবার খারাপ লাগে না, বেশি হাসে না। শুধু রেগে গিয়ে বকাবকি করে।…… সবসময় গম্ভীর ও কর্মঠ ছাপ থাকতো মুখে। বাবার লেখাপড়া বেশিদূর নয়। তার কারণ অভাবের সাথে বাবা নাকি অঙ্কেও বেশ কাঁচা ছিল, ঠাকুমা থেকে জেনেছিলাম উনি বেঁচে থাকতে। কিন্তু খুব সুন্দর একটা অঙ্কের মেলবন্ধন ছিল বাবা ও মায়ের মধ্যে। মা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল তাই অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি মাকে সিদ্ধান্ত নিতে সংসারের। আর সেটা বাবা খুব খুশি মনেই মেনে নিত। যেটা এখনকার উচ্চশিক্ষিত নারীরাও কতটা পারেন সন্দেহ আছে। যদিও বা কোন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা কতগুলো স্বামী খুশি মনে মানে ?

সহদেব ভানু দাস

আমার জ্বর হলে সন্ধ্যেতে বাবা পাউরুটি আর মিষ্টি আনতো। আমি আর দুই বোন মিলে ভাগ করে খেতাম। ইচ্ছেজ্বর এবার নিয়ম করে হতে শুরু করলো। তখন ভাবতাম বাবা বোকা। মিথ্যে বললেও বুঝতে পারে না। ছয় মাস যেতে গোপনে বাবা’মার কথোপকথন শুনে জানতে পারলাম দোকানটায় বেশ ধার পড়ে গেছে। আর বুঝেছিলাম বাবা মিথ্যে বলছি জেনেও রুটি-মিষ্টি আনতো আমার জন্য। কেন জানি না সেদিন কষ্ট হয়েছিল খুব। তারপর আর কোনদিন ইচ্ছে জ্বর আসেনি।

একটু বাজে খরচা করলেই বাবা রেগে যেত। যদিও সেগুলো কোন অর্থেই বাজে খরচা নয়। কারণ বাজে খরচাটা নির্ভর করে তাঁর সামর্থ ও চাহিদার উপর। বাজে খরচের লিস্টে প্রথম সারিতে জুতো থাকতো। হ্যাঁ, মানে আমাদের কিনলে অতটা সমস্যা হতো না। একবার মা পাড়াতে জুতো বেচতে এলে বাবার জন্য কেনে। বাবা সেই জুতো শেষ পর্যন্ত ফেরত দিয়ে দুই বোনের জন্য জুতো আনিয়েছিল। মা রেগে দিব্যি কেটে বলেছিল, তোমার জন্য যদি কোনদিন কিছু কিনি! শেষ অবধি মা কথা রাখেনি নিজের কাছে। কারণ বাড়ির অল্প আধটুকু কেনাকাটা মাকেই করতে হতো।

…বাবার গেঞ্জি লুঙ্গি একসাথে কিনতে দেখিনি কোনদিন। একটা কিনলে বলে অন্যটা আছে। এমনই করে কাটিয়ে দিত সারাটা বছর, একটা পুরনোর সাথে নতুন নিয়ে।

সেদিনের জুতো না কেনা, অনিচ্ছাকৃত রেগে যাওয়া, নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ানো, ইচ্ছেকৃত বোকা সাজা, সবটাই আমাদের জন্য। তখন অনুভব করিনি, এখন করি। আমাদের বড়ো হওয়া, তাদের দুজনের সমান ত্যাগের জন্য। যেকোনো কারণেই হোক বাবাদের ত্যাগ, কষ্ট , অভিমান আমাদের চোখে কম পড়ে। তাই এই উপস্থাপনা পৃথিবীর সকল ত্যাগী বাবাদের জন্য উৎসর্গ করলাম।

লেখক: কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.টেক। এখন রুপকলা কেন্দ্রে (কলকাতা) সাউন্ড ডিজাইন (স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ) নিয়ে পাঠরত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.