সুপ্রীতি ধর:
প্রচণ্ড ক্ষোভ হচ্ছে, ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। কেন একজন নারী নির্যাতককে এখনও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, কেন? কীসের শক্তিতে?এদের ক্ষমতার উৎসটা কোথায় জানতে ইচ্ছে করছে। পারুল আজ একাই দাঁড়িয়ে গেছে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে, এটা মোটেও অনুকম্পা নয়। ও কারও কাছ থেকে সহানুভূতি বা অন্যায় আবদার করছে না, যা ন্যায্য, তাই দাবি করছে। যার কাছে দাবিটুকু রেখে লেখা প্লেকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছে পারুল, আশা করবো উনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন।
আর পারুলকে বলছি, যে পথে তুমি হাঁটতে শুরু করেছো, সেই পথ বড়বেশি বন্ধুর, এখানে সহজে তুমি কাউকে পাশে পাবে না যারা ইচ্ছা করলেই কিছু করার ক্ষমতা রাখে। তুমি পাবে আমাদের মতোন হাত-পা বিশিষ্ট কিছু অক্ষম মানুষদের, যারা কেবলমাত্র তোমাকে ছুঁয়ে থাকতে পারবো।
সাংবাদিক সাজিদা ইসলাম পারুল আজ কতদিন ধরে বিচারের জন্য লড়াই করছে, কিন্তু এই সমাজ, এই রাষ্ট্র একজন নারী নির্যাতককে গ্রেপ্তার তো করছেই না, বরং তাদের সদম্ভে চলাফেরার এক্তিয়ারও দিয়ে রেখেছে। কতোই না ‘নারীবান্ধব’ প্রশাসন আমাদের! ক্ষমতা যখন কথা বলে তখন রেজাউল করিম প্লাবনের মতোন নির্যাতক সাংবাদিক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসন ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলে!
আজ যখন পারুল একাই প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে যায় তখন আমাদের মুখ লুকানোর আর কোনো জায়গাই থাকে না। কেন তাকে আজ দাঁড়াতে হলো? কেনই বা একা দাঁড়াতে হলো? পারুল লিখেছে,
“এক মাস পনের দিন হয়েছে রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছি। কত ধর্না দিচ্ছি, অথচ প্লাবন ঢাকা শহরেই ঘুরে বেড়ায় এবং পুলিশ নাকি তাকে খুঁজে পায় না। এমনকী এও শুনলাম, সামনের মাসে বাসা বদল করবে। প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে বিভিন্নভাবে আপসের প্রস্তাব পাঠানোর নামে রসিকতা করে চলেছে প্লাবন। আসলে প্রশাসনকেও যে কতিপয় সাংবাদিক নেতা ‘সমঝোতা’ করে দেওয়ার কথা বলে ভুল বোঝাচ্ছেন, সেটা আমি বারবার বলেছি।
আমার বড় ভাইতুল্য ওই সাংবাদিক নেতাদের করজোড়ে বলছি, আপনারা পুলিশকে বিভ্রান্ত করবেন না। আমি আপনাদের ছোটবোনের মতো, আমার জায়গায় নিজের বোনটিকে ভাবুন, কন্যাটিকে ভাবুন, যদি আপনার বোন বা মেয়ে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হতো, তার গর্ভের অনাগত সন্তানটিকে হত্যা করা হতো কী করতেন আপনি?
কতিপয় সাংবাদিক নেতার প্রশ্রয় এবং পুলিশ প্রশাসনের অবহেলা কাজে লাগাচ্ছে প্লাবন। প্রতিনিয়ত সমঝোতার চাপ, হুমকি, ফেসবুক আইডি হ্যাক করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একদিন দেখবেন, পুরো আমাকেই গায়েব করে দেবে সে।
তাই উপায়ান্তর না দেখে ন্যায় বিচারের দাবিতে আজ একাই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ালাম। আশা করছি পুলিশের টনক নড়বে। না হয় এরপর প্লাবনকে গ্রেফতারের দাবিতে দাঁড়াবো হাতিরঝিল থানার সামনে। দাঁড়াবো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ির সামনে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে। তাতেও কাজ না হলে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করবো। বিচারহীনতার এই সমাজে বেঁচে থাকার চেয়ে প্রতিবাদ করে মরে যাওয়া ভালো।”
পারুলের এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক বীথি সপ্তর্ষি লিখেছে, “যে রাষ্ট্র ঘর থেকে অবুঝ নিরীহ শিশুকে মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে, যে রাষ্ট্র চালচুরির রিপোর্ট করায় প্রতিবেদককে ৫৩ দিন গুম করে রেখে হাজতে পাঠায় সে রাষ্ট্রই একজন নির্যাতিত গণমাধ্যমকর্মীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়নকারীকে আইনের আওতায় আনতে পারে না! এরপরেও কি বুঝতে বাকি থাকে এ রাষ্ট্র, এই আইন কাদের পৃষ্ঠপোষক? পারুলের এই কান্না রাষ্ট্র দেখে না কেন? কেন অপরাধীকে ধরতে এত গড়িমসি? প্লাবনকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি”।
আবুল হোসেন রিপন লিখেছেন, “এ দৃশ্যটা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।রাস্তায় দাড়িয়ে একজন নারীর ন্যায় বিচারের জন্য চোখের জল বিসর্জনের দৃশ্যটা আমার কলিজায় আঘাত করেছে। সমকালের সাংবাদিক আমাদের সহকর্মী সাজিদা ইসলাম পারুল তার উপর ঘটে যাওয়া অমানবিক নির্যাতনের বিচার চেয়ে বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে নিজেই দাড়িয়েছে।
সাজিদা ইসলাম পারুল যৌতুক দাবি, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও ভ্রুণ হত্যার বিচার চেয়ে তার স্বামী রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। কিন্তু দেড়মাস অতিক্রান্ত হলেও প্লাবনসহ কোনো আসামীকেই গ্রেফতার করেনি পুলিশ। উল্টো মুক্ত প্লাবন নানা রকম হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় প্লাবন বেপরোয়া আচরণ করছে।
একজন নারী কতটা অসহায় হলে করোনাকালে বিচারের দাবিতে একাই রাস্তায় দাড়াতে পারে তাহা যদি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন না বুঝে তবে বলবো মনুষ্যত্ব পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। পারুল কোন সাধারন মেয়ে না, সে একজন সাংবাদিক ।নারী নির্যাতন ও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছে, নিউজ করেছে অথচ তাকেই অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচারের দাবিতে রাস্তায় দাড়াতে হয়েছে।
আমরা ন্যায়বিচার চাই-আমাদের সহকর্মী পারুলের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে এটাই প্রত্যাশা। এক্ষুণি প্লাবনের গ্রেফতার চাই”।
ইরানি বিলকিস খান লিখেছেন, “যে সাংবাদিকরা নারী নির্যাতনের বিপক্ষে সোচ্চার, পাশে দাঁড়ান নির্যাতিতার, সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ, যাদের দেখে সমাজ পরিবর্তিত হয়, যাদের কলমীতে বিশ্বের বাঘা বাঘা অপরাধীরা কাঁপে! যাদের দেখে তরুণ সমাজ জাগ্রত হয়, যাদের কারণে অসহায়, নির্যাতিত মানুষ কথা বলতে পারে, ভরসা পায়, স্বপ্ন দেখে, সেই তারাই যদি ওই অপরাধীর পক্ষে গিয়ে অপরাধীকে শেল্টার দেন, তা কি মানায়? একজন অপরাধী যে একজন নারীর সাথে অপরাধ করতে পারে, সে একজন পুরুষের সাথেও যে কোন অপরাধ করতে পারে, অপরাধী মানে অপরাধী-ই।
নারী নির্যাতন কখনোই নারী ইস্যু না, তাহলে আপনি আপনার মায়ের পক্ষে কথা বলতেন না তিনি নির্যাতিত হলে, আপনার আদরের কন্যা নির্যাতিত হলে তার পক্ষে থাকতেন না। নারী নির্যাতন একটি সামাজিক অপরাধ। নারী পুরুষ সবাইকে এই অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
আর যারা মনে করেন মা আর বোনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, কিন্তু নিজের স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন, তাদেরও মনে রাখা প্রয়োজন, তার স্ত্রী তার সন্তানের মা। প্রকৃতিরও একটা প্রতিশোধ থাকে মনে থাকা দরকার। অপরাধীর পক্ষে যাবার আগে একটু ভাববেন, এমন পরিস্থিতিতে আপনিও পড়তে পারেন, তখন হয়তো তখন আপনার পাশে আমরা আর থাকবো না…। গত দেড় মাসেও গ্রেফতার হয়নি প্লাবন, অপরাধীরা শেল্টার প্রাপ্ত হয় অপরাধীর মাধ্যমেই। সাংবাদিকতা তার শেল্টার কেন হচ্ছে? সাংবাদিকতা তো অপরাধ নয়”?
সবার মন্তব্যগুলো পড়লাম। সবাই ক্ষুব্ধ, এবং যতদূর জানি গত দেড় মাস ধরে সবাই যেমন পারুলের হাতটা ধরে আছে, সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে, তেমনি প্লাবনের গ্রেপ্তারের দাবিতে সোচ্চারও আছে। কিন্তু বিধিবাম, এই ‘সবাই’ হলো আমজনতা, সাংবাদিক হলেও তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই, যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা সবাই প্লাবনের পক্ষে নানাভাবে, নানা অছিলায় আছে, সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। আমরা পারুলের আগে অন্যান্য ইস্যুতেও দেখেছি এইসব ক্ষমতাধর সাংবাদিকরা প্রচণ্ডভাবে অন্যায়ের পক্ষেই অবস্থান নেয়। কেন নেয়, সেটা আজও বোধগম্য নয় আমার। কারণ যে মানুষ ‘ভালো’ হয়, সে সব পেশাতেই ভালো করে। একজন নামী সাংবাদিক মানেই ‘ভালো’ মানুষ হয় না, এটা বার বার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে তারা। বিশেষ করে সাংবাদিক নেতাদেরই তো হরেক কীর্তিকলাপের কথা আমরা জানি, কে জানে হয়তো এই প্লাবনও সেইসব ‘নেতাদের’ অনেক কীর্তিকলাপের জলজ্যান্ত সাক্ষী, যে কারণেই তারা তাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। সময়োচিত পদক্ষেপটা নিতে পারছে না।
প্রচণ্ড ঘূণেধরা, পচা-গলা এক সিস্টেমের সহযাত্রী হয়েছি আমরা সবাই। এখানে ন্যায়বিচার, আশা, ভালবাসা এসব শব্দ নেহায়েতই বালসুলভ। একজন নারীকে শুধুমাত্র একটি শব্দ বলার অপরাধে আমরা দেখেছি সবাই কেমন একজোট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই ‘জোট’কে কখনই আমরা অন্য কোনো ইস্যুতে, বা অন্য কোনো নারীর পক্ষে আর দাঁড়াতে দেখিনি। তার মানে নারীর ইস্যু হতে হবে কেবলই রাজনৈতিক? ওপরে ইরানি যেমন প্রশ্ন তুলেছে, আমিও তার সাথে গলা মিলিয়ে বলতে চাই, নারী নির্যাতন কেবলই নারীর ইস্যু নয়, এটা সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনীতি দিয়েই একে মোকাবিলা করতে হবে। নারী নির্যাতনকে নারী অধিকার কর্মীদের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না, একে যতদিন না রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গুরুত্ব’ দেয়া হবে ততদিন এই নির্যাতন চলতেই থাকবে। আজকে যারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে ‘পারুলের ইস্যু’ ভেবে, তাদের ঘরেও যখন এটি হানা দেবে বিভিন্ন ফর্মে, তখন এই আমাদের কাছেই আসতে হবে কিন্তু।
কাজেই সময় থাকতেই সাধু সাবধান না হলে এর দায় কেউ এড়াতে পারবে না।
সবশেষে আমি বিশেষভাবে পারুলের হাতটা ধরে আবারও বলতে চাই, তুমি একা দাঁড়িয়েছো বিচারের দাবি জানিয়ে, এটা ঠিক আছে, কিন্তু জেনে রেখো, দূরে থেকেও তোমার পাশে আছি আমরা অনেকেই। এক প্লাবনের গ্রেপ্তার দিয়ে সমাজের পরিবর্তন হবে না, এটাও জানি, কিন্তু অপরাধকে কেন সমাজ বা রাষ্ট্র প্রশ্রয় দেবে? গ্রামের ওই রহিম-করিম অন্যায় করলেও অন্যায়, প্লাবন বা অন্য যে কেউ করলেও তাই হওয়া উচিত। তাই হতে হবে।
বার বার বলছি, এক্ষুণি গ্রেপ্তার চাই প্লাবনের। পারুলকে আর কাঁদতে দেখতে চাই না। এই কান্না অসহায় নারী হিসেবে পারুলের কান্না না, তাকে আত্মসম্মানবোধহীন নারী বলে কেউ অপমান করতে আসবেন না প্লিজ। এই পারুল একজন অপরাধীর বিচার চায়, সে আজ সমস্ত নির্যাতিত নারীর প্রতিভূ। তাকে সম্মান করা উচিত সবার।