যে কথা যায় না বলা!

কৃষ্ণা দাশ:

আমার এক বান্ধবী আমাদের জমজমাট এক আড্ডায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসে, “তোমরা বুকে হাত দিয়ে কে বলতে পারবে যে ছোটবেলায় পরিবার কিংবা মামা-কাকা, আত্মীয়, পারিবারিক বন্ধু দ্বারা কেউ কখনও যৌন হয়রানির শিকার হও নাই?” পিনপতন নিরবতা, একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে, কিন্তু কেউ এতোটুকুও স্বচ্ছন্দ্য বোধ করছিল না ওর ওই প্রশ্নে। এরপর ও বলতে শুরু করলো ওর জীবনের ঘটে যাওয়া অন্ধকার বিভীষিকাময় দিন-রাত্রির কথা।

খুব ছোটবেলায় ওর বাবা মারা যান বলে পরিবার ধরে বেঁধে ওর মাকে আবার বিয়ে করতে বাধ্য করান। মা সরকারি চাকুরে, যে সময়টা ওর মা থাকতেন না ওই সময়ে প্রায় তার ‘স্টেপ ফাদার’ ওকে ধর্ষণ করতেন। একটা সময় পর ওর মাকে বিষয়টা জানান৷ মা বলেন, “চুপপপপপ থাক, না হলে লোক জানাজানি হলে, ছি: ছি: পড়ে যাবে, আমার সংসার ভেঙে যাবে”… ও একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো, কী ভেবেছিলাম জানি না, তবে মার সংসারটা ভাঙতে দেইনি। অনেক বছর ওই অত্যাচার সহ্য করেছি। আমার স্টেপ আরও দু’বোন আছে। কখনও ওদেরও বুঝতে দেইনি। শুধু মাধ্যমিক দেয়ার পর মাকে বলেছি অন্য জায়গায়, অন্য শহরে গিয়ে পড়বো। মা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ও বলছে, ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে, আমাদের সবার চোখের কোল ভিজে উঠছে।

একসময় ও ওই নরক থেকে বেরিয়ে আসতে ঠিক সক্ষম হয়। শুধু ওই বিভীষিকাময় স্মৃতিগুলো ফেলে আসতে পারে নাই। ব্যক্তিগত জীবনে ও এখন দারুণ প্রতিষ্ঠিত, শুধু ‘বিয়ে’ শব্দটা শুনলেই এখনও কেঁপে উঠে। হয়তো ‘বিয়ে আর সংসার’ শব্দগুলো ওকে ওর শৈশব, কৈশোরের নির্মম দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। জানি না এখন আর কেউ ওই শব্দগুলো ওর সামনে পারতপক্ষে উচ্চারণ করে কিনা!

ওর দেখাদেখি শুরু হলো একে একে সবার জীবনের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া অধ্যায়ের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা, ও যেন মশাল জ্বেলেছে, আমরা তার আলোয় আমাদের অন্ধকারের কথা বলে কিছুটা মনের কোণে আলো ফেলছি।

ধরে নেই এরপর বলছে সুমাইয়া। খুব ছোটবেলায় আমার কাজিন রাতে আমার যৌনাঙ্গে হাত ঘষতো। আঙ্গুল চালাতো, ভ্যাজাইনায় থু থু লাগিয়ে যৌনাঙ্গ ঢুকাতে চেষ্টা করতো। আমি ছোট, লজ্জায় চোখ খুলতে পারতাম না, ভয়ে চিৎকারও করতে পারতাম না, মরার মতো ঘুমের ভান করে পরে থাকতাম। আর এই কারণে আমি জানতামই না আমার ঠিক কোন কাজিন আমার সাথে এই কাজ করে। দিনের আলোয় সবার চেহারার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম, কিন্তু ওরা সবাই স্বাভাবিক, নির্বিকার। শুধু আমি এদিক-সেদিক থম ধরে বসে থাকতাম, কিচ্ছু ভালো লাগতো না। এটা তখনই হতো যখন বাড়িতে অনেক লোক আসতো, তখন বাচ্চারা সবাই একসাথে ঘুমাতো নিচে টানা বিছানা করে।

বলছে নিশি। টেম্পুতে করে রাতে গানের ক্লাস থেকে ফিরতে হতো। টেম্পুতে বেশ চাপাচাপি করে বসতে হয়। আমি বেশিরভাগ সময় বাবার গায়ে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন ওই সুযোগে একটা হাত আমার থাই, আরেকটু নিচে ঘুরপাক খেতে টের পাই। যদিও আমি সাথে সাথে চিৎকার করে উঠি। পরে অবশ্য লোকটা বেদম মার খেয়েছিল।

চলছে আমাদের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা, আজ যেন আর শেষ হতে চায় না। প্রতিটি পাতায় লেখা আছে দম চাপা কষ্ট।

হঠাৎ নয়ন আর সজল আমাদের আড্ডায় এসে যোগ হয়। আমরা এতোক্ষণ ভাবছিলাম মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ। প্রতি পদে পদে এদের গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। কিন্তু ওদের কথা শুনে আমরা যথেষ্ট ভেঙে পড়েছি। বয়েজ স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের বড় ভাইরা প্রায়ই ওদের ওয়াশরুমে ডাকতো। খেলার মাঠেও দু’একজন টিচ করতো। অনেক সময় টিচাররাও পশ্চাৎপদ লোভ ছাড়তে পারতো না।

যৌন হয়রানি, খুব কম সংখ্যক শিশুই আছে যে এর শিকার হয় নাই। সে ঘরে কী বাইরে! সাধারণত ঘর থেকেই এর শুরু। সে নিকট আত্মীয় পরিজন থেকে ঘরের সদস্য, প্রাইভেট শিক্ষক, স্কুলের দারোয়ান, কে নেই এই লিস্টে?

আমরা সব বন্ধুরা মিলে সেদিন একটা প্রতিজ্ঞা করি, যা হয়েছে হয়েছে, আর না। আমাদের সন্তানদের এই কালো ছায়া থেকে আমরা রক্ষা করবো।

আমরা মানি আর না মানি, বেশিরভাগ যৌন হয়রানির শিকার শিশুরা ঘর থেকেই হয়, এরপর স্কুল, অর্থাৎ আমাদের পরিচিত মহল। আমরা অভিভাবকরা যে জায়গায় সবচে বেশি নির্ভরতা পায়, ভাবি ঘরে সবাই আপন, এখানে কে কি করবে? অনেক সময় শিশুরা বললেও যা আমরা বিশ্বাস করি না বা শিশুদের বলার সুযোগ দেয় না, এমন জায়গাগুলোই যৌন হয়রানির সুযোগ তৈরি করে।

পৃথিবীতে পিডোফাইল (শিশু যৌননিপীড়ক বা শিশুদের সঙ্গে যৌনতায় আগ্রহী) মানুষের সংখ্যা জনসংখ্যার ভালো একটি অংশই। কম করেও ৫ শতাংশ। আমেরিকার একটি জরিপ বলছে, ১২ বছরের কমবয়সীদের ধর্ষকদের বিশ শতাংশ আপন পিতা। পরিসংখ্যান সত্যিই গুরুতর।

তাই এবার ভাবতে না বসে কার্যত কিছু করার পালা-
– সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিন, সারাদিন ও কী কী করেছে, কোথায় কার সাথে কীভাবে মিশেছে তা গল্প করতে করতে জেনে নিন।

– সন্তানের সাথে এমনভাবে সম্পর্ক তৈরি করুন, যেন ও যেকোনো কথা খুব সহজে আপনাকে এসে জানাতে পারে।

– ওদের অন্যদের থেকে শারীরিক দূরত্ব কতটা রাখতে হবে সেটা ভাল করে বুঝিয়ে বলুন। লজ্জা না রেখে বলুন, শিশুরা বরাবরই বুদ্ধিদীপ্ত হয়, ওদের বললেই ওরা বুঝবে ওদের সীমারেখা কতটুকু।

– পাশাপাশি নিজে সচেতন আর সতর্ক থাকুন।

– পিডোফাইল চিহ্নিত করুন, একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেই এদের চেনা খুব কঠিন কাজ না। সাধারণত বলা হয় যারা খুব তাড়াতাড়ি ছোটদের সাথে মিশতে পারে, তাদের থেকে বাচ্চাদের একটু সাবধানে রাখা ভালো।

– ভয় নয়, সচেতন থাকলে এদের হাত থেকে আমরা আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে পারবো।

– যেসব শিশু যৌন শিকারের সম্মুখীন হয় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রমায় আক্রান্ত থাকে, আর এসব শিশুরা পড়ালেখা থেকে খেলাধূলা কিছুতেই সঠিক মনোযোগ দিতে পারে না, পাশাপাশি মানসিক ভারসাম্যহীনতাও এর একটি কারণ।

– লজ্জা, ভয় আর সংকোচ না রেখে এদের চিহ্নিত করুন। মনে রাখবেন, সন্তান আপনার, ওর বর্তমানটা আলোকিত রাখবার দায়িত্বও আপনার।

আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, শিশুকে এসব থেকে দূরে রাখুন। হাসি, আনন্দে আর খেলায় যেন ওর বর্তমানটা সুন্দর রাখতে চেষ্টা করুন, সুন্দর ভবিষ্যৎ আপনাতেই আসবে। যৌন শিকার হওয়া ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো যারা জানেই না কেন ওর সাথে এমন হচ্ছে, অথচ বড়দের কাছে বলবারও জো নেই। এমন বাচ্চাদের কথা একবার ভাবুন, ঠিক কতটা কষ্ট ওরা ওই সজীব মনে থামাচাপা দিয়ে কতটা মানসিক অশান্তি নিয়ে বাস করে। আর কোন শিশু যেন, এমন জঘন্য অপরাধের শিকার না হয়৷ সেদিকে আমাদের সবার একটু সচেষ্ট থাকা উচিত। তবে কতটা সম্ভব তা বলা মুশকিল। যেখানে তার আশ্রয়স্থল সেখানেই যখন ও প্রতিনিয়ত শিকার হয়, সেখানে কতটা নিরাপদ রাখা সম্ভব! যদি না আমাদের সমাজের সকল স্থরের মানসিকতা পরিবর্তন হয়!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.