দিলু দিলারা:
আমার এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার লাস্ট ধর্ম পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে দেখলাম জয়নাল ভাই বারান্দায় বসে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে আরাম করে খাচ্ছে, আর ওনার সামনে আব্বা-আম্মা দুইজনেই বসা। জয়নাল ভাই হচ্ছেন আমার ছোট ফুফুর বাড়ির পুরনো কাজের লোক। জমিজমা দেখাশোনা করেন।
আমি ঘরে বসেই স্কুলের সাদা জুতা খুলতে খুলতেই শুনতে পেলাম আব্বা বলছেন, জয়নাল শোনো, বেগম (আমার ছোট ফুফু আম্মার নাম)কে কইও যে আমার শরীর ভালো না, আমি যাবার পারবো না।
আচ্ছা, আব্বা কই যাবে? আমি কান খাড়া করি।
না, না, মামু, আপনাক নিয়া যাওয়ায় নাগবে। আপনাক সাথে করি না নিয়া গেলে চাচি আম্মা মোক বাড়িত ঢুকপ্যার দিব্যার নোয়ায়।
কী মুশকিলত ফেলালু ক তো জয়নাল?
হাঁটেন মামু এডি (রেডি) হন।
আমি স্কুলের ইউনিফর্ম পরেই কৌতুহলি হয়েই দরোজায় এসে দাঁড়াই। জয়নাল ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, কী হছে জয়নাল ভাই? আব্বা কই যাবে?
একটা সুখবর আছে।
কী?
জাহিদ ভাইজানের বিয়ার কন্যা দেখপ্যার যাবে। মামুক তাই নিব্যার আচ্চি। (জাহিদ ভাইজান হচ্ছে ফুফু আম্মার ছোট ছেলে)।
আমি খুশিতে দেই তিন লাফ। বায়না ধরি আব্বার সাথে আমিও যাবো মেয়ে দেখতে। আমার পরীক্ষাও শেষ। কয়েকদিন তো পড়বোই না। সেই সময় এতো পড়ার প্রেশারও ছিল না।
ঠিক হয় আমি আর আব্বা যাবো, তাছাড়া আব্বার শরীরটাও খুব একটা ভালো না। আম্মা বারবার বলে দিলেন, আমি যেন আব্বার দিকে খেয়াল রাখি।
জয়নাল ভাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি আর আব্বা রিকশায়। আমাদের গন্তব্য আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দশ পনের মাইল দূরে তুলসি ঘাট আমার ফুফুর বাড়ি। আমি আর আব্বা রাস্তার দুই পাশের ধান ক্ষেত আর গাছপালা দেখতে দেখতে একটা সময় ছোট ফুফু আম্মার বাড়ি পৌঁছে যাই।
ফুফু আম্মা আমাদের দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
আব্বার হাত ধরে ঘরে এনে বসায়। আমার জন্যে আসে গরম দুধ, সবরি কলা আর চিঁড়া। আমি খেতে খেতেই শুনলাম ফুফু আম্মা বলছে, তার ভাই মানে আব্বার পছন্দই ফাইনাল। দেখলাম আব্বার হাতে উনি আলমারি খুলে একটা আংটি বের করে দিলেন। বলে রাখি, আমার এই ছোট ফুফু খুব কম বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। আমরা শুনেছি, ফুফা যখন মারা যায় তখন জাহিদ ভাইজানের বয়স এক মাস । আর বড় ছেলে শাহেদ ভাই মাত্র সাত বছরের। শাহেদ ভাই কে আব্বা নিজের কাছে এনে পড়িয়েছেন তখন আব্বা নাকি বিয়েই করেননি। আম্মার সাথে আব্বার বিয়ের পরও শাহেদ ভাই তাদের কাছে ছিল মানে মামু আর মামানির কাছে। ছোট ফুফু আম্মা ছিলেন ভাই বলতে অজ্ঞান। তাই আব্বার উপরই জাহিদ ভাইজানের বিয়ের কনে দেখার দায়িত্ব চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলেন, তবে বড় ছেলে শাহেদ ভাইকে ফুফু নিজেই দেখে শুনে বিয়ে করিয়েছিলেন।
সিদ্ধান্ত হলো, মেয়ে পছন্দ হলে আমরা রাতে সেই বাড়িতে থাকবো, ভোরে এসে জাহিদ ভাইকে কেউ এসে নিয়ে যাবে। আর সেদিনই বিয়ে হবে। শুধু আকদ করে রাখা হবে, পরে অনুষ্ঠান করে বউ তুলে আনা হবে।

বলে রাখি, সেই সময়টায় বর নিজের বিয়ের কনে দেখতে খুব কমই যেতো, আর বিয়েতে মায়েরাও যেতেন না। মুরুব্বিদের উপর নির্ভর করতেন।
বেলা থাকতে থাকতে আমরা ৭/৮ জন চারটা রিকশায় করে কনে দেখার জন্যে রওনা দিলাম। গন্তব্য ঢোল ভাঙ্গার একটা গ্রাম (গ্রামটার নাম এই মুহূর্তে আমার মনে নেই)। আমরা যখন সেই বাড়ির বাইরের উঠানে এসে পৌঁছালাম তখন বাড়ি বাড়ি কুপি বা হারিকেনের আলো জ্বলতে শুরু করেছে। এই গ্রামে কারেন্ট আসেনি তখনও।
এটা অবস্থাপন্ন গেরস্থ বাড়ি। বাইরের উঠানে বড় বড় দুই তিনটা খড়ের গাদা। পাশেই গোয়াল ঘর সেখান থেকে ঘুঁটে পোড়ানর গন্ধ আসছে। রিকশার বেলের শব্দ শুনে বাড়ির লোকজন বেরিয়ে আসে। আমাদের সাদরে বাইরের কাচারি ঘরে এনে বসায়। কনে দেখতে আসা আমি একমাত্র মেয়ে বলে আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।
দেখলাম বিশাল উঠান। তিন চারটা বারান্দাওয়ালা ঘর আর সেই সব বারান্দায় একটা করে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা। আমাকে যে ঘরটায় বসালো সেখানে দেখলাম পড়ার টেবিল সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। টেবিলে টেবিল ক্লথ, একটা টিনের ফুলদানি, তাতে টাটকা চন্দ্রমল্লিকা। কী রুচিশীল পরিবেশ! একটা শরৎ রচনাবলীও আছে। আর আমার পড়ার টেবিল দেখলে কাউয়াও তাকাবে না, এতো এলোমেলো!
আমাকে অনেকেই উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখে গেল।
আমি তখন মনে মনে বউ খুঁজছি। আমার সামনে যিনি নাস্তা আনলো তাকেই বউয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, ওমা দেখি সে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, সেই নাকি বউ। আমার কলিজার মধ্যে চিপ দিয়ে উঠলো। আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত এই মেয়েকে কেউ পছন্দ করবে না।
আমি কথায় কথায় জানলাম এই ঘরটা নাকি ওনার, বই পড়তে ভালবাসেন। ওনার যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করলো, তা ওনার ভুবন ভুলানো হাসি।এদিকে আমার মনটা খারাপ হতে থাকলো।
নাস্তা খাওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পর –
আমরা সবাই সেই কাচারি ঘরে বসে আছি। এক সময় পানের বাটা হাতে কনে প্রবেশ করে সবাইকে সালাম দিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে এসে বসলো। আমি মন খারাপ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি বেগুনি রঙের শাড়িতে হারিকেনের আলোয় গল্পের বই পড়তে পছন্দ করা মেয়েটিকে। দেখলাম কনে দেখতে আসা সবার মুখ নিমিষেই কালো হয়ে গেল। ধবধবে ফর্সা জাহিদের জন্যে এই কালো মেয়ে!
কিন্তু!
আমার আব্বা, আমার দিলখোলা আব্বা সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে সেই মেয়ের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলেন, সাথে ১০১ টাকা। আমি দেখলাম কনের মুখে কী এক স্বর্গীয় আভা। ইচ্ছে করছিল আব্বাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি! আমার আব্বাটা এতো ভালো কেন! শুনলাম বাড়িতে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেছে। মোরগ জবাই দাও রে, পোলাও রান্না কর রে।
এদিকে একজন জাহিদ ভাইকে আনার জন্যে ছোট ফুফু আম্মার বাড়িতে রওনা দিল।
রাতে খাওয়া দাওয়ার এলাহি কাণ্ড!
আমি রাতে সেই ঘরটাতেই ঘুমালাম, সাথে সেই ভুবন ভুলানো হাসির মেয়েটি, যার নাম সুলতানা। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি জাহিদ ভাইজানকে আনা হয়েছে। সেদিন ছিল শুক্রবার সকালেই জুম্মাঘরে বসেই বিয়ে হয়ে গেল জাহিদ ভাই আর সুলতানা ভাবির। দুপুরে খাসি জবাই দেওয়া হলো। আমরা সেদিনই ফিরে এলাম। জাহিদ ভাইকে বৌয়ের বাড়ির লোকজন আসতে দিল না। উনি থেকে গেলেন।
ঘটনা বাঁধলো অন্যখানে।
প্রায় তিনদিন পর আষাঢ়ের মেঘের মতো মুখ থমথমে করে ছোট ফুফু আম্মা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। আব্বাকে রীতিমতো জেরা করতে লাগলেন কেন আব্বা এতো কালো মেয়েটাকে তার এমন সুন্দর ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন! সে কি কনে পক্ষের থেকে টাকা খেয়েছে কিনা! আব্বা বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। ফুফু আম্মা শেষে আমাদের বাড়িতে জীবনেও আসবেন না, তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না বলে হাঁটা পায়ে বাইরে দাঁড়ানো রিকশায় গিয়ে উঠলেন। আমরা আব্বাকে দেখলাম লজ্জা আর অপমানে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে।
শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারণে দুই ভাইবোনের সম্পর্ক প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমরা পরে জেনেছি বউকে ফুফু তুলে এনেছেন ঠিকই, তবে কোন অনুষ্ঠান করেননি।
এই ঘটনার পাঁচ বছর পর ফুফু আম্মা কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঠিকই এলেন, তবে অনেক দেরিতে। যেদিন আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ঠিক সেদিন।
২০০৫ সাল
বাড়িতে গিয়ে শুনলাম ছোট ফুফু আম্মা খুব অসুস্থ। আমরা সব ভাইবোনেরা মিলে ওনাকে দেখতে গেলাম। ওনাকে যে অবস্থায় দেখলাম, না দেখলেই ভালো ছিল। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। কংকালসার হয়ে গিয়েছেন। তবে যা যত্ন করার সেই কালো মেয়েটাই করছে, মাথায় তেল দেওয়া থেকে শুরু করে গোসল করানো। ফুফু আম্মা নিজে যাকে পছন্দ করে ফরসা দেখে বড় বউ করে এনেছিলেন, সে নাকি অসুস্থ শাশুড়িকে উঁকি দিয়েও দেখেন না। সেদিন ফুফু আম্মা কাঁদতে কাঁদতে শুধু এ কথাই বলছিলেন, এই জীবনে তিনি যদি তার এক মাত্র ভাইকে ফিরে পেতেন, তাহলে তার দুই পা ধরে ক্ষমা চাইতেন।
আমরা ভাইবোনেরা ফুফু আম্মাকে ঘিরে বসে থাকি।
আর সেই মিষ্টি হাসির কাল সুলতানা ভাবি কোমর বেঁধে রান্নাবান্না সেরে আমাদের তাড়া দিতে থাকেন, আমরা যেন তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে আসি। কারণ তিনি নাকি বুঝতে পেরেছেন আমাদের অনেক ক্ষুধা লেগেছে।