রেজভিনা পারভীন:
বাবা দিবসে যখন সব বাবাদের আমরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, তখন মনে হলো যারা যেকোনো কারণেই সিঙ্গেল মাদার হিসেবে বাবা মা দুজনের দায়িত্ব একাই কাঁধে নিয়ে প্রতিদিনের লড়াইটা করে সন্তান মানুষ করার যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে কেন আমরা বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানাবো না? আমি সেইসব মায়ের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর অভিনন্দন জানাতে চাই। কারণ এইসব মায়েদের যে কী পরিমাণ মূল্য দিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হয়, তা কেবলমাত্র সেইসব মায়েরাই বলতে পারবেন!
এই লেখার উদ্দেশ্য কোনো বাবার অবদানকে ছোট করে দেখা নয়, বরং যে মায়ের অবদানকে গুরুত্বদিয়ে বিবেচনা করা হয়না, সেই মায়েদেরকে শুধুমাত্র অভিনন্দন জানানোর প্রয়াশ মাত্র!
এই প্রসঙ্গে কয়েকজন মায়েদের জীবনের কঠিন লড়াইয়ের কথা মনে পড়লো যার কিছুটা দেখেছি আর কিছুটা শুনেছি আর সবসময়ই মনে হয়েছে কতটা ঝক্কি সামলিয়ে এই ‘সিঙ্গেল মাদার/মায়েরা তার সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।
এই প্রসঙ্গটা আমার মাথায় খুব ছোটবেলায় ঢুকেছিল ৭১ এ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি দিয়ে। যখন টিভিতে নিহত বুদ্ধিজীবীর পরিবারের মায়ের সংগ্রাম আর তার সন্তানদের লড়াই ও কষ্টের কথা শুনেছি, বিভিন্ন লেখায় পড়েছি, তখন মনে হয়েছে এই মায়েরা একই সাথে বাবা ও মা এই দুই দায়িত্ব একাই পালন করছেন, তাদের কতটা ত্যাগ তাদের শিকার করতে হয়েছে তা আর বলার অবকাশ রাখে না! বুদ্ধিজীবী পরিবারের লোকজন তবুও কিছুটা হলেও সমাজে অগ্রসরমান, কিন্তু যারা প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন, সেইসব মায়েরা কীভাবে পাড়ি দেন বিশাল সমুদ্র?
এরপর আসি নিজের অভিজ্ঞতায়, আমার বাবা যথেষ্ট পরিশ্রমী আর দায়িত্ববান বাবা ছিলেন। ১৯৯৮ সালে আমার বাবা সরকারি চাকুরিরত অবস্থায় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান, পাঁচ ভাই-বোন এর সংসার, বাবা মারা যাবার বছর খানের আগে আমার বড় বোনকে বিয়ে দিয়ে যান, আর বাকি চার ভাইবোন তখন লেখাপড়া করছি। আমার মা তার চাকুরির সামান্য পয়সা আর বাবার পেনশনের কয়টা টাকা যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখে কীভাবে যে আমাদের সবার লেখাপড়া সব ঠিকঠাক ভাবে চালিয়েছেন, যে কারণে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
আমাদের মা বাবা ও মা দুজনের আদর দিয়ে মানুষ করেছেন, সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন সামাজিকতা রক্ষা করে! সাফল্যটা সবাই দেখেছেন আর পেছনের গল্পটার সাক্ষী আমরা কয় ভাইবোন। বিনিময়ে মা আজ হয়েছেন কৃপণ, ভালো খাবার বেশি খেতে পারেন না, একটার জায়গায় দুইটা কাপড় কিনলে বিরক্ত হন, পুরনো কিছু ফেলতে দেন না, ফেলে দেয়া জিনিস তুলে পুনরায় ব্যবহার করেন, নাতি-নাতনিরাও এখন ঠাট্টা করে বলে, “নানুর কাছে তো সবচেয়ে কম মজার জিনিস ও মজা লাগে” তো, এই মা’কে আমি বাবা দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন দিতে চাই!
আমাদের গল্পটা তো তাও কিছুটা মসৃণ, কারণ আব্বুর চলে যাওয়াটা প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটেছিল। আর যেসব মায়েরা স্বামীর নির্যাতন থেকে মুক্তি বা আত্মসম্মান রক্ষায় সন্তান নিয়ে আলাদা বসবাস করছেন, বা যাদের স্বামী নিজেই দায়িত্ব অবহেলা করে পরিবার ফেলে চলে গেছেন তাদের লড়াই এর পথটা আরও কণ্টকময়! একে তো সন্তানকে মানুষ করার আর্থিক দায়িত্ব, অপরদিকে সামাজিক নানা চাপ, স্বামীর ঘর কেন করতে পারলো না, নিশ্চয়ই চরিত্র ভালো ছিল না, এসব নানান অপবাদ মাথায় নিয়েই হাসিমুখে সন্তানকে বাবা ও মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তো, আমি সেইসব মাকে ও বাবা দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে চাই!
এমন অনেক সহকর্মী ও বন্ধুদের গল্প আমাদের সবারই জানা যারা সন্তানের দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলে নিয়েছেন! সেইসব সংগ্রামী সিঙ্গেল মা সবাইকে আজকে ‘বাবা’ দিবসের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!