বাবাদের একাল ও সেকাল

জেবুন্নেছা জোৎস্না:

তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি, কেন ছোটবেলা আমার হ্যান্ডসাম নানা ক’দিন পর পরই রাজ্যের খাবার-দাবার দুই হাতে জড়ো করে আমাদের বাসায় আসতেন… তারপর অনেক দিন থাকতেন, আর যাবার সময় আম্মা আর নানার সে কী কান্না! সত্যি তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি আম্মা নানার অতি আদরের বড় মেয়ে, আম্মাকে ক’দিন না দেখে থাকতে পারতেন না, তাইতো ক’দিন পর পর মেয়ে-নাতিদের পছন্দের সব জিনিষ নিয়ে হঠাৎ চলে আসতেন।

আসলে বাবা মানেই বিশাল বটবৃক্ষ, নিশ্চিন্ত এক ছায়া। সন্তানদের শিক্ষিত এবং যথাযোগ্যভাবে মানুষ করার প্রয়োজনে আগেকার দিনে বাবা’রা যেমন রাশভারি থাকতেন, আজ সময়ের সাথে সাথে সেই বাবা’দের ভূমিকা অনেকখানিই বদলে গেছে। এক জীবনে অজস্রবার অভিভূত হয়েছি বাবা’দের ভিন্ন ভিন্ন রুপ আর ভূমিকায়।

আমার নিরপত্তা, পড়াশুনা, ভালো থাকার জন্য অন্য সব বাবা’র মতো আমার আব্বাও সবকিছু করেছে….আগাছা কাটার মতো আমার চারদিকের প্রেমিকদের যখন সে সমূলে নিধন করে চলছে, তখন এক সুর্দশন, পরিচিত বনেদী ঘরের ছেলে আমাকে পাওয়ার জন্য আব্বার কাছে চিঠি লিখেছিল। ছেলেটির বাংলা লেখায় ভুল ছিল, আর তাই তার সকল যোগ্যতা ম্লান হয়ে গিয়েছিল আমার আব্বার কাছে। সে ছেলে আমার আত্মীয়-স্বজন সকলের কাছে যেয়ে কেঁদেছে, সবাই আব্বাকে বুঝিয়েছে, কিন্তু আমার আব্বার মন গলেনি, কারণ ঐ ছেলে বাংলা লেখে ভুল… এমনই অগাধ তাঁর পড়াশুনার ওপর ভালবাসা। আমার আজও যে পড়াশুনার জন্য প্রাণান্ত লড়াই, নিঃসন্দেহে সেটা আব্বার থেকে প্রাপ্ত জীনে’র বৈশিষ্ট্য। খুব বেশি রকমের অবাধ্যতা করলে আব্বার থেকে একটাই শাস্তি ছিল, বই-খাতা বেঁধে পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়া, আর তখন সুড়সুড় করে সোজা না হয়ে কোন উপায়ও ছিল না, কারণ পড়া যে আমারও রন্ধ্রে রন্ধ্রে গাঁথা।

অনার্স ফাস্ট ইয়ারে উঠার পর এক প্রবাসী পাত্র এলো বিয়ের জন্য, আর তাতে নানা এবং আব্বা দু-জনেই একদম নারাজ; এতোদূরে মেয়ে বিয়ে দিলে তারা মেয়েকে দেখতে পাবে না। তাঁর চিন্তা যে মেয়ে মশারি টাঙাতে পারে না সে কীভাবে বিদেশে কোনো সাহায্যকারী ছাড়া সংসার করবে? আমি যখন যুক্তি-তর্ক দিয়ে আম্মাকে বুঝিয়ে আব্বা আর নানা’কে রাজী করালাম, আব্বা তখন বিছানায় শুয়ে চোখের পানি ঝরায়, উঠে দাঁড়াতে পারে না, তাঁকে বললাম, আমি মাস্টার্স শেষ না করে বিদেশে যাবো না, এবং সেই অনুযায়ী পাত্র’র কাছ থেকে ওয়াদা নিয়ে তারপর বিয়েটা হয়, আর আব্বাও তাতে খুশি। অনার্স পাশের পর ঢাকা গেলাম আমেরিকা আসার জন্য, তখন বাধা দিল আমার মামা, আমাকে মাস্টার্স করে তবেই যেতে দিবে, কারণ আমি দুই বংশের বড় নাতী, আমি পড়ালেখা শেষ না করলে বাকি ভাইবোনগুলোও আমাকে ফলো করবে! কী আর করা কাঁদতে কাঁদতে আবার বাড়ি চলে এলাম, এবং মাস্টার্স শেষ করেই এলাম হাজবেন্ডের সাথে সংসার করতে।

আমার অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মা’র যখন আব্বার সাথে বিয়ে হয়, আব্বা তখন খুলনা বি. এল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে যশোর শিক্ষা বোর্ডে চাকরি নেয়। আম্মার এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার জন্ম হওয়াতে আম্মা তখন পরীক্ষা দিতে পারেনি। তারপর কয়েক বছরের ব্যবধানে আমরা তিন ভাই-বোন পৃথিবীতে এলাম, আর আমরা একটু বড় হবার পর আম্মা আবার লেখাপড়া শুরু করলো। আম্মা’কে বাসায় মাষ্টার’রা এসে পড়িয়ে যেত, আর আব্বা অফিস থেকে এসে আমাদের দেখাশুনা করতো। আম্মা’কে আমরা ছোটবেলায় শুধু পড়তেই দেখছি, সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য আব্বা আমাদের জামা-কাপড় আয়রন করে, জুতা-মোজা পরিয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠায়ে নিজে অফিসে যেত, আর দুপুরে বাসায় এসে আমাদের নাকের-চোখের পানি এক করে উচ্ছে ভাজি, শাক, মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ায়ে আবার অফিসে যেত। কাজের লোক না এলে আব্বা নিজে ঘর ঝাড়ু দিয়েছে, কাপড় কেচেছে, কিন্তু আম্মাকে পড়ার টেবিল থেকে উঠতে দেয়নি। এভাবে শুধু আব্বার সহযোগিতায় আম্মা তার গ্রাজুয়েশন শেষ করে। শুধু আম্মা না, আমার ফুফাতো-চাচাতো ভাইবোন, আমার সুন্দরী পাঁচ খালা সবার লেখাপড়া এবং বিয়ে দেওয়ার দিকে ছিল আব্বার তীক্ষ্ণ নজর।

আমার আব্বা কাজী আব্দুল জলিল, যশোর শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা হওয়াতে তখন বরিশাল জেলার সকল মাষ্টার -প্রফেসররা আমাদের বাড়িতে আসতো। আর গাধা টাইপ স্টুডেন্ট এবং তাদের পরিবারের ধারণা ছিল আব্বার পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে, তাই তারা যখন মিষ্টি, ফল, মাছ নানারকম উপহার সামগ্রী নিয়ে আসতো, আব্বাকে দেখতাম এসব সামগ্রী আনবার জন্য তাদের খুব বকা-ঝকা করতে। আব্বাকে তখন খুব বদমেজাজি মনে হতো, নয়তো যারা আমাদের জন্য এতো খাবার, উপহার আনে তাদের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করে!

এখন বুঝি, কারণ আমাকেও কিছু অশিক্ষিত লোকের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে যে বোর্ড পরীক্ষায় আমার বাবা নাকি আমাকে পাশ করিয়ে দিয়েছে। তবে আব্বার বদৌলতে আমি বরিশাল জেলার সকল নামকরা মাষ্টার-প্রফেসরদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি। তাঁরা যশোর এলে আমাদের বাসায় মেহমান হয়ে থাকাকালীন আমাকে ভালো নোট এবং পড়া বুঝিয়ে দিয়েছেন। যশোর শহরে যখন সবাই কম্পিউটার শিখতে বাইরে যেতো, আমার আব্বা তখন আমাদের জন্য বাসায় কম্পিউটার, টাইপরাইটার এনে শিক্ষক রেখে দিয়েছেন। যখন হোস্টেল থাকতাম, সপ্তাহের অধিকাংশ দিন বাসে’র লোক মারফত অথবা লোক দিয়ে আমাকে মিষ্টি, বড় চিংড়ি মাছ, যা কিছু ভালো ভালো রান্না হতো বাসায়, সব আমাকে পাঠিয়ে দিতো। আবার হোস্টেলে ভালো খাবার না থাকলে আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে খেতাম, তাই অন্য মেয়েদের তুলনায় আমার হাত খরচটাও ছিল তখন ডাবল। আর হোস্টেল থাকাকালীন আমার ছাদ বাগান আর খরগোশের দেখাশুনাটাও করতেন আব্বা।

সেই আব্বাকে এখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। আমরা প্রবাসী ভাই-বোনেরা যেহেতু দেশে কোন এসেট করিনি, ঢাকা যেয়ে কোথায় দাঁড়াবো, এই চিন্তায় সে শেষ বয়সে এসে ঢাকায় আমাদের জন্য জমি কিনে বাড়ি করে দিয়েছে… যুগে যুগে বাবা’রা কেবল সন্তানদের জন্য করেই যান, সন্তানদের আর সময় অথবা যোগ্যতা হয় না সে ঋণ শোধ করবার।

শেয়ার করুন: