সম্পর্কে ওভার পজেসিভনেসকে ‘না’ বলুন

জান্নাতুল নাঈম পিয়াল:

“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার।” তাহসানের ভীষণ জনপ্রিয় একটি গানের প্রথম লাইন। ইংরেজিতে ”ইউ আর অনলি মাইন” খুব প্রচলিত একটি বাক্য। এই শিরোনামে গানও আছে। বাংলা সিনেমাতেও হরহামেশাই শোনা যায় সংলাপ, “তুমি শুধু আমারই।” এমনকি এই ধরনের নাম বিশিষ্ট আস্ত সিনেমাও হয়েছে বেশ কিছু।

অনেকের কাছেই হয়তো এই জাতীয় বাক্যকে অসম্ভব রোমান্টিক মনে হয়। আসলেই তো, কারো প্রতি ভালোবাসা ঠিক কতটা তীব্র হলে তাকে একদম নিজের করে পাওয়ার বাসনা জাগে মনে! সুতরাং এ জাতীয় কথা যারা বলে, তাদের ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা তো দূরে থাক, বরং পরম শ্রদ্ধায় মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছা হয়!

কিন্তু আমি যদি এখন বলি যে এই ধরনের প্রেমালাপ, কিংবা এই জাতীয় মানসিকতা পোষণ করা মোটেই ভালো নয়, বরং এগুলো বিষাক্ত সম্পর্কের নিদর্শন, তাহলে অনেকেই হয়তো রাগ করবেন আমার উপর। তেড়ে এসে বলবেন, “তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন, নিজের প্রেমিক/প্রেমিকাকে বা স্বামী/স্ত্রীকে আরো পাঁচজনের সাথে ভাগ করে নেব? আমার চোখের সামনে সে অন্য কারো সাথে প্রেম করে বেড়াবে, আর আমি মুখ বুজে তা সহ্য করে যাব?”

শুরুতেই পরিষ্কার করে নিচ্ছি, কাউকে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চাওয়ার বিরোধিতা বলতে আমি একদমই রোমান্টিক সম্পর্কের বহুগামিতার হয়ে ওকালতি করছি না। সবসময় শুধু ওই একটি দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবলে চলবে না। কেননা এমন অনেক দৃষ্টান্তও আছে, যেখানে একজন ব্যক্তির মনে প্রেমিক/প্রেমিকা বা জীবনসঙ্গীকে শুধু নিজের করে পেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এতটাই দুর্নিবার হয়ে থাকে যে, তার দ্বিতীয় কোনো বন্ধু থাকাও তারা সহ্য করতে পারে না, পরিবারের সদস্যদের সাথে বেশি দহরম-মহরমও ভালো চোখে দেখে না, এমনকি কেউ কেউ এতটাই আগ্রাসী যে, নিজেদের সম্পর্কের মাঝে সন্তানের আগমনকেও তারা মেনে নিতে পারে না স্রেফ এই ভয়ে যে তাহলে ভালোবাসায় অন্য কেউ এসে ভাগ বসাবে!

সম্পর্কের এই বিশেষ দিকটি নিয়ে বাংলা ভাষাতেই দারুণ একটি উপন্যাস রয়েছে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সেই উপন্যাসের নাম ‘আলো ছায়া’। সেখানে এমন একটি চরিত্রকে দেখা যায় যে ছোটবেলা থেকেই এতটা আত্মকেন্দ্রিক যে, নিজের অধিকার অন্য কারো কাছে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া একেবারেই সহ্য করতে পারে না। বিয়ের পর তার প্রতি বউয়ের নির্মল ভালোবাসা দেখে সে ভেবেছিল, বউয়ের পুরো দুনিয়াজুড়ে রয়েছে কেবলই সে। অথচ বিয়ের কিছুদিন পর বউ যখন দিন দশেকের জন্য বাপের বাড়ি থাকতে যায়, তা সহ্য হয় না তার। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এমন অশান্তি করে যে শ্বশুর-শাশুড়ি পরদিনই তার বউকে “ফিরিয়ে দিয়ে যেতে” বাধ্য হয়। এরপর যখন শোনে বউ সন্তানসম্ভবা, তখনো এতে খুশি হওয়ার বদলে বিচলিত হয়ে ওঠে সে। ভাবে, এবার আরেকজন আসতে চলেছে তার প্রাপ্য ভালোবাসায় ভাগ বসাতে। তাই প্রথমে সে বউকে গর্ভপাতের পরামর্শ দেয়, আর বউ তা না শুনলে নিজেই ফন্দি এঁটে বউয়ের পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দেয়।

অনেকের কাছেই গোটা বিষয়টি অবাস্তব লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা নিজের সন্তানের প্রতিই ঈর্ষান্বিত। কেননা তারা মনে করে, সন্তানের আগমনের ফলে সঙ্গীর সাথে তাদের ভালোবাসাবাসিতে ভাটা পড়েছে। আবার এমন অনেকেও আছে, যারা এই আশঙ্কা থেকে সন্তানই নিতে চায় না।

এই যে প্রেমিক/প্রেমিকা বা সঙ্গীর প্রতি এত গভীর ভালোবাসা যে সবসময় তাকে মাকড়সার জালের মতো নিজের, এবং শুধুই নিজের ভালোবাসার চাদরে বেষ্টিত করে রাখতে চাওয়া, তাকে অন্য কারো কাছে ঘেঁষতে না দেয়া, এর নাম হলো ওভার পজেসিভনেস বা অতি অধিকারবোধ। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই অবশ্য এই দখলদারিত্বের প্রবণতাকে সাধুবাদই জানায়। বলে, “ও কত ভালো! নিজের ভালোবাসার মানুষকে চোখে হারায়!”

কিন্তু আসলেই কি সবসময় এই চোখে হারানো ভালো? না, একদমই ভালো না। কারণ একজন মানুষের প্রতি ভালোবাসার নামে এই অতি অধিকারবোধ ফলাতে যাওয়া মানে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া। ভালোবাসার মানুষটিরও যে একটি নিজস্ব জগৎ আছে, জীবন থেকে নিজেরও কিছু চাহিদা ও প্রত্যাশা আছে, সেই ধ্রুব সত্যটিকে অস্বীকার করা।

জীবনে প্রেম-ভালোবাসার অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু শুধু প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে যেমন পেট চলে না, তেমনই সামাজিক জীব হিসেবে টিকে থাকাও যায় না। নিজেদের প্রয়োজনেই পরিবার-পরিজন কিংবা কাজের জায়গায় আরো কিছু মানুষের সান্নিধ্যে আসার প্রয়োজন পড়ে। কিংবা মানুষের মনের খোরাক মেটানোরও তো দরকার আছে। নিজের মনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা ভাগ করে নিতেও মানুষের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দরকার পড়ে, তাদের সাথে একান্ত কিছু মুহূর্ত কাটানোর ইচ্ছা জাগে। সব কথা শুধু প্রেমিক/প্রেমিকা বা স্বামী/স্ত্রীর সাথে ভাগ করে নেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। একজন ব্যক্তির সাথেই সব ধরনের কথোপকথন জন্ম দিতে পারে একঘেয়েমিরও।

কিন্তু এই বাস্তবতাটা মেনে না নিয়ে কেউ কেউ ভাবেন, “আমি তো আমার ভালোবাসার মানুষটিকে এত ভালোবাসি, তারপরও কেন ওর অন্য কারো সাথে মেলামেশার ইচ্ছা জাগবে? তবে কি ও আমাকে অত বেশি ভালোবাসে না, যতটা আমি ওকে ভালোবাসি?” তাদের এই ভাবনা একেবারেই ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। শুধু ভালোবাসার দোহাই দিয়ে এমন ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেয়ারও কোনো মানে হয় না।

তাই আমাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো, ভালোবাসার সম্পর্কে এই অতি অধিকারবোধকে মহিমান্বিত না করা, বরং এটি যে আসলে একটি মানসিক সমস্যা, তা স্বীকার করে নেয়া। একটি সমস্যাকে অস্বীকার করা বা আড়াল করার বদলে, সেটিকে প্রকৃতপক্ষেই সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে সমস্যার সমাধান অর্ধেকটা হয়েই যায়।

এবার আসা যাক এমন মানসিকতা থেকে পুরোপুরি মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। আপনার যদি নিজের প্রতি, এবং নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস থাকে, তাহলে আপনি কেন ইনসিকিউর হবেন? কেন ভাববেন আপনার ভালোবাসার মানুষটি আপনাকে ধোঁকা দিতে পারে বা আপনার থেকে দূরে সরে যেতে পারে? আপনার ভালোবাসার জোরেই তো সে বারবার আপনার কাছে ফিরে আসবে, আপনাতেই খুঁজে পাবে পরম নির্ভরতার আশ্বাস। আর নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপনের পর, আপনার বিশ্বাস আনতে হবে আপনার ভালোবাসার মানুষের প্রতিও। আপনাকে আস্থাশীল হতে হবে যে আপনার ভালোবাসার মানুষটি আপনাকে ঠকাবে না।

এছাড়াও দরকার ওভার থিংকিং বা অতিচিন্তা না করা। মনে রাখবেন, মানুষের অবচেতন মন কিন্তু সেই পথেই যায়, যে পথে তার সচেতন মন তাকে পরিচালিত করে। আপনি যদি সচেতনভাবেই বারবার চিন্তা করতে থাকেন যে আপনার ভালোবাসার মানুষ তার কোনো আত্মীয়, সহকর্মী বা বন্ধুবান্ধবের সাথে সময় কাটাতে গিয়ে আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তবে একসময় আপনার অবচেতন মনও আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলবে। অবস্থা এমন হবে যে আপনি কখনো নিজেকে শান্ত রাখতে পারবেন না। সুতরাং নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খাতিরে আপনার অতিচিন্তা বন্ধ করতে হবে।

এর পরের ধাপ হলো নিজেকে সময় দেয়া। সেই “মি টাইম” খুঁজে বের করা, যেখানে আপনি মানে শুধু আপনিই। এই সময়টা আপনি ভালোবাসার মানুষকে ছাড়াই একদম নিজের মতো করে কাটাবেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবেন, খেলা বা সিনেমা দেখতে যাবেন, বই পড়বেন, বাগান করবেন, কিংবা নিজের যেকোনো শখ মেটাবেন। যখন আপনি নিজে শতভাগ ভালোবাসার মানুষের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া থেকে বের হয়ে আসবেন, নিজের মতো করে কিছু সময় উপভোগ করবেন, তখন আপনি এটিও খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে এমন কিছু “মি টাইম” আপনার সঙ্গীরও প্রয়োজন। তাছাড়া যখন আপনার একেবারে নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি হবে, নিজের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব থাকবে, তখন ভালোবাসার মানুষের নিজস্ব জগৎ কিংবা বন্ধু-বান্ধব থাকাও আপনাকে আর পীড়িত করবে না।

একে অপরের বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়দেরকে ভালো করে চিনে নেয়াটাও খুব ফলদায়ী হতে পারে। ধরুন আপনার সঙ্গী হয়তো তার কোনো বন্ধুর সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করে। এখন আপনি কেন খামোকা সেই বন্ধুটিকে হিংসা করবেন? বরং তাকে ভালোভাবে চিনে নিন। তাহলে তার ব্যাপারে আপনার মনের অবিশ্বাস দূর হবে। কিংবা কে জানে, হয়তো আপনিও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠবেন। এতদিন যে আড্ডায় তারা কেবল দুজন থাকত, এবার থেকে সেখানে জায়গা হবে আপনারও!

এই সবকিছুর পরও যদি আপনি অতি অধিকারবোধ থেকে বের হতে না পারেন, ইনসিকিউরিটি আপনাকে কুরে কুরে খেতে থাকে, তাহলে আপনি আপনার সঙ্গীর সাথে সরাসরি এই ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতে পারেন। না, গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা অন্য কোনোভাবে নয়। সরাসরি কথা বলেই আপনি সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারেন। আপনার সঙ্গী যদি আপনাকে আসলেই বুঝতে পারে, তাহলে সে অবশ্যই আপনার এই সমস্যাটিকেও আমলে নেবে, এবং আপনাকে নিশ্চিন্ত করতে পারবে যে আসলেই এখানে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, কথা বলতে গিয়ে যেন মেজাজ হারাবেন না, কিংবা সঙ্গীকে সরাসরি দোষারোপ করে বসবেন না। মনে রাখবেন, কোনো সমস্যা নিয়ে শুরুতেই ঠাণ্ডা মাথায় কথা না বললেই একসময় সেই সমস্যা বিশালাকার ধারণ করে। অথচ একটি আদর্শ জুটির তো যেকোনো সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়েই পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে সেটির সুরাহা করে নেয়ার কথা!

এই ছোট ছোট কিছু বিষয়ে সচেতন হলেই অতি অধিকারবোধ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব, এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব সম্পর্কের বিষিয়ে যাওয়াও। এবং এটি আসলেই খুব জরুরি। কেননা গোড়াতেই যদি এই সমস্যাকে নির্মূল করা না যায়, এবং কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে যদি আপনার সঙ্গীর মনে হয় যে আপনি তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন, আপনার আগ্রাসী আচরণের ফলে তার নিজস্ব সত্তা হারিয়ে যেতে বসেছে, আপনার ভালোবাসা তার পায়ে শেকল পরিয়ে রেখেছে; তখন কিন্তু আপনার ভালোবাসায় সে আর আপ্লুত হবে না, বরং এতে বিরক্ত হয়ে যাবে, হাঁপিয়ে উঠবে। আর দিনের পর দিন যদি এমনটি চলতে থাকে, তখন আপনার অসুস্থ, অনিয়ন্ত্রিত ভালোবাসার প্রতি তার ঘেন্নাও ধরে যেতে পারে। ফলে সম্পর্কে ভাঙনটাও হয়ে যাবে অবধারিত।

শেষ করার আগে আরেকটি বিষয় যোগ করা জরুরি। এই অতি অধিকারবোধ যে শুধু রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় বাবা-মা তাদের সন্তানদের প্রতিও এই অতি অধিকারবোধ দেখায়, সন্তানের উপর নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়, এমনকি সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তার স্বাধীনতা হরণ করে। একই চিত্র বড় ভাইবোন কর্তৃক ছোট ভাইবোনের প্রতি, কিংবা সম্পর্কের আরো নানা ক্ষেত্রেই দেখা যায়। সেগুলোও কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, আপনি কাউকে ভালোবাসেন মানে এই নয় যে সে আপনার নিজস্ব সম্পত্তি, কিংবা আপনার খেলার পুতুল, যাকে আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচাবেন। ভালোবাসার মানুষের মনের সিংহভাগ অংশে জায়গা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকুন, পুরোটা দখল করতে গিয়ে উল্টো পুরোটাই খোয়াবেন না।

 

লেখক: শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.