সন্তানের মনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিষ্ঠাতা তো বাবাই

জান্নাতুল নাঈম পিয়াল:

বাবা দিবস এলে বাবাদের নিয়ে বহু আবেগঘন রচনা লেখা হয়। বাবাদেরকে মহিমান্বিত করা হয়, বাবাদের জয়গান গাওয়া হয়। কিন্তু আমার এই লেখাটা অনেকটাই স্রোতের বিপরীতে। স্বাভাবিকভাবেই এই লেখাটা অনেককেই হয়তো আহত করবে। তাদের কাছে শুরুতেই ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।

না, আমি ঢালাওভাবে পৃথিবীর সব বাবার নিন্দে করছি না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীতে সিংহভাগ বাবাই খুব ভালো। কিন্তু আমি বিরোধিতা করতে চাই সেই প্রবণতার, যেখানে জগতের সব বাবাকে মহত্ত্বের মুকুট পরিয়ে দিয়ে এক ধরনের সাধারণীকরণ করতে চাওয়া হয়। আমি বিরোধিতা করতে চাই সেই মানসিকতার, যে মানসিকতা থেকে উৎসারিত হয় যে পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।

আমরা স্বীকার করবার মতো মনের জোর নিজের মধ্যে ধারণ করি বা না করি, এটি একদম নির্জলা সত্য যে পৃথিবীর সব বাবা ভালো নয়। কিছু খারাপ বাবাও আছে। সাধারণভাবে চিন্তা করলে খারাপ বাবা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তাদেরকে, যারা সন্তানকে ছোটবেলা থেকে শাসনের নামে নিপীড়ন করে। খারাপ বাবা হিসেবে আঙ্গুল তোলা যায় তাদের দিকে, যারা সন্তানকে জন্ম দিয়েই কাঁধ থেকে সব দায়ভার নামিয়ে ফেলে, সন্তানের আর কোনো খোঁজখবর নেয় না। কিংবা আজকাল বাবা কর্তৃক মেয়ের ধর্ষণের শিকার হওয়ার মতো ভয়াবহ খবরও তো হরহামেশাই শোনা যায়। কোনো সন্দেহ নেই, ওইসব বাবাও খুব খুব খারাপ।

তবে আমি আজ কথা বলতে চাই সেইসব বাবাদের নিয়ে, যারা আপাতদৃষ্টিতে ভালো, কিন্তু আদতে খারাপ। তারা হলো সেইসব বাবা, যাদের কারণে ছেলে সন্তানেরা নারীকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে জানে না। এবং তারা হলো সেইসব বাবা, যাদের কারণে মেয়ে সন্তানেরা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের নারীজন্ম নিয়ে এক ধরনের গভীর হীনম্মন্যতায় ভোগে, কিংবা হয়ে ওঠে প্রচণ্ড রকমের পুরুষবিদ্বেষী।

একটু খোলাসা করা যাক। আমি বলছি মূলত সেইসব পাষণ্ড স্বামীদের কথা, যারা ঘরে স্ত্রীর উপর আধিপত্য বিস্তারের নামে অকথ্য নির্যাতন চালায়। যারা স্ত্রীকে উঠতে বসতে অকথা-কুকথা শোনায়। যারা স্ত্রীর সাথে কুকুর-বেড়ালের মতো আচরণ করে। যারা স্ত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, স্ত্রীর নিজস্ব সত্তাকে গলা টিপে মারে। মোদ্দা কথা, যারা স্ত্রীর উপর নিজেদের যাবতীয় ‘পুরুষত্ব’ প্রয়োগ করে চলে।

এমন স্বামীদের অনেকে কিন্তু বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি খুবই সদয়। তাদের অনেকের সন্তানও তাদেরকে “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা” বলে মনে করে। কিন্তু সেই শ্রেষ্ঠ বাবাদের কাছ থেকে সন্তানেরা আসলে কী শেখে?

একটি ছেলে শিশু যখন ছোটবেলা থেকে দেখে যে তার “আইডল” বাবা তার মাকে কখনো প্রাপ্য সম্মানটুকু দিচ্ছে না, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই ছেলে শিশুটির মনেও গেঁথে যায় যে নারীদের সাথে এমন আচরণই করতে হবে, তাদেরকে এভাবেই সকল ক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখতে হবে। ফলে ওই ছেলে শিশুটি নিজে যখন বড় হতে থাকতে, সে-ও নারীদের প্রতি মনে মনে সমান অসম্মানই লালন করে, যা এক পর্যায়ে তাকে তার বাবার মতো অমানুষে পরিণত করে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গুণাবলি কাজে লাগিয়ে সে নিজেও সমাজের সকল নারীকে অসম্মান করে, তাদের অধিকার হরণ করে, এমনকি সুযোগ পেলে নিজের ঘরের বউ কিংবা বাইরের যেকোনো নারীর উপর নিপীড়ন চালাতেও দ্বিধাবোধ করে না।

এদিকে মেয়ে শিশুদের কাছে বাবা তো শুধু আদর্শই নয়, তাদের স্বপ্নের নায়কও বটে। তো, সেই স্বপ্নের নায়কদেরই যখন তারা দেখে যখন-তখন স্ত্রীর উপর হামলে পড়ছে, তখন ওই মেয়ে শিশুদের মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়? স্বাভাবিকভাবেই বাবার উপর মায়ের আগ্রাসন দেখে তাদের মনে ধারণা জন্মায় যে এটাই হয়তো জগতের নিয়ম, এভাবেই হয়তো পুরুষরা সবসময় নারীদের উপর চড়াও হবে, জোর খাটাবে। ফলে ওই ছোটবেলা থেকেই তাদের মনটা এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, তারা আর নিজেদেরকে কিছুতেই পুরুষের সমান বলে মনে করতে পারে না, সবসময় নিজেদেরকে অন্তত এক ধাপ নিচে রাখে। তাই তো তারা জীবনের যেকোনো পর্যায়ে পুরুষ কর্তৃক বঞ্চনার শিকার হলেও খুব সহজে মুখ খুলতে পারে না, নীরবে সব সহ্য করে যায়।

তবে সব মেয়ে শিশুর মানসিকতা তো আর এক আদলে গড়ে ওঠে না। অনেকে মায়ের প্রতি বাবার পাশবিকতা দেখে সেই ছোটবেলা থেকেই বাবার প্রতি মনের মধ্যে তীব্র ঘৃণাবোধ লালন করতে থাকে। এবং যেহেতু ঘরের বাইরে পা রাখার আগ পর্যন্ত বাবাই মূলত তাদের দেখা নিকটতম পুরুষ, তাই তারা ধরে নেয় সমাজের সকল পুরুষই হয়তো এমন নির্মম, নিষ্ঠুর। সুতরাং এক বাবার নমুনা দেখেই তারা দুনিয়ার তাবৎ পুরুষের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে নেয়। সহজ কথায়, তারা হয়ে ওঠে পুরুষবিদ্বেষী। জীবনে চলার পথে বহু সত্যিকারের ভালো পুরুষের সম্মুখীন হলেও, তাদেরকে তারা ভালো বলে মানতে পারে না। মনের কোণে শঙ্কা রয়েই যায় যে ওই পুরুষরাও হয়তো নিছকই ভালোমানুষির মুখোশ পরে রয়েছে।

কথায় আছে, চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। আসলেও তা-ই। ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের মনে সেই ছোটবেলা থেকেই যে পুরুষতন্ত্রের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে, এর সূচনাটা হয় তাদের ঘর থেকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, তাদের বাবাদের কাছ থেকে। বাবাকে দেখেই সন্তানরা পুরুষতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়, কিংবা পুরুষতন্ত্রকে ঘৃণা করতে গিয়ে গোটা পুরুষজাতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দেয়।

তবে শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য বাবাদেরকে অসম্মান করা নয়। দুই অক্ষরের এই বাবা শব্দটির বিশালতা কখনোই ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, বেশিরভাগ বাবাই খুব ভালো, খুব মহৎ। কিন্তু তারপরও, কতিপয় খারাপ বাবার কারণে সমাজে এখনো নারী-পুরুষের সমতাটা আনা যাচ্ছে না, সমাজ নারীবান্ধব হয়ে উঠছে না।

তাই যেসকল বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ বাবা এই লেখাটি পড়ছেন, তাদের প্রতি বিনীত নিবেদন: দয়া করে নিজের ঘরের নারীদেরকে, বিশেষত নিজের স্ত্রীকে কখনো অসম্মান করবেন না। সন্তানের সামনে কোনো বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না। মনে রাখবেন, ভালো বাবা হওয়ার পূর্বশর্ত হলো একজন ভালো স্বামী হওয়া।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.