অণুগল্প: ‘সুখের অসুখ’

মলি জেনান:

রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বিছানা থেকে নামি, অন্ধকার হাতড়ে মোবাইলটা চাপি- রাত পৌনে একটা বাজে। সেই এগারোটা থেকে চেষ্টা করে করে এই মাত্র ঘুমালো!
বাচ্চাটা কিছুতেই রাতের বেলা ঘুমাতে চায় না। চোখ ঘুমে ঢুলে পড়ে, একটুতেই কান্নাকাটি জেদ শুরু করে দেয়, বোঝা যায় প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে। কিন্তু বিছানায় গেলেই শুরু হয় যন্ত্রণা! “আমি ঘুমাতে চাই না, আমি ঘুমাবো না।” করোনার এই ঘরবন্দী জীবনে ও আরো জেদি হয়ে উঠছে, ওর কী দোষ, আমাদের বড়দের মনোজগতই তো দিনকে দিন উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।

ওপাশের ঘরে হালকা নীল আলো। পর্দাটা সরিয়ে দাঁড়াই, অমিয় হেড ফোন লাগিয়ে ল্যাপটপে বসে। হয়তো নতুন কোন সিরিজ বা সিনেমা। নেটফ্লিক্সের টপ টেন তো এখন চোখের নাগালেই।

মিনিটখানেক ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ও টের পায় না। ফিরে এসে রান্নঘরে চুলায় চায়ের পানি বসাই, দুইকাপ চা বানিয়ে আবার অমিয়’র কাছে গিয়ে দাঁড়াই; পর্দায় মানব-মানবীর ঘনিষ্ঠ দৃশ্য চলছে, ও বুঁদ হয়ে আছে সেই রসায়নে। আমি এক কাপ ওর সামনে রেখে আস্তে বেরিয়ে আসি ছাদে। মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। চেয়ার পাতা আছে, চা হাতে নিয়ে বসি। এতো সুন্দর! এতো বিশাল লাগে চারপাশ, নিজেকে খুব একলা মনে হয়।

ভাড়া বাড়িতে এমন একটা ছাদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, ঠিক ছাদ নয় যেন নিজের একটা উঠোন। এমন ভাগ্য নিয়ে চন্দ্রালোকিত আকাশের নিচে বসে আমার নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হতে থাকে।
মনে পড়ে আমাদের ভালোবাসাবাসির সময়টাতে আমরা এমন একটা ঘরের স্বপ্ন দেখতাম যে ঘরের বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখা যায়, আর এমন একটা বারান্দা চাইতাম যেখানে সমস্ত দিন শেষে একসাথে বসে চা পান করা যায়।

হাতের চা টা রেখে দিই, তৃষ্ণাটা মরে গেছে। অভ্যাস বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকি কার সাথে কথা বললে ভালো লাগবে, নাহ কেউ নেই যাকে এই রাত দুপুরে ফোন করে বলা যায়, আমার খুউব একলা লাগছে। ফেসবুকে ঢুকি, স্ক্রল করতে থাকি, সারা হোম পেইজ জুড়ে সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যায় হাহাকার। এক একজন বিষন্নতার বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে, কেউ কেউ কেন সুইসাইড করলো বা তখন তার কী করা উচিত ছিল বা তার কাছের লোকজনের কতটা কেয়ার নেয়া উচিত ছিল, দেদারসে তার পরামর্শ দিয়েছেন।

অমিয়’ও একটা পোস্ট দিয়েছে দেখছি, “কাছের মানুষকে এবং আপনজনদের সময় দিন, কেউ বিষন্ন থাকলে তার মানসিক পরিচর্যা করুন। মনে রাখবেন আপনার খানিকটা মানসিক সাপোর্টই তাকে বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে, ফিরে আসবে সুন্দর ও আনন্দময় সময়।” পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই প্রায় হাজার খানেক লাইক!

আমার খুব ক্লান্ত লাগতে থাকে; মনে হয় এখানেই একটা শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ি, জোছনা গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়ি আর যেন না জেগে উঠি। চেয়ারে হেলান দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হতে থাকে জীবনটা ক্লান্তিকর এক জার্নি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.