মগজে কারফিউ কতদিন চলবে?

জিন্নাতুন নেছা:

ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস ঘুরছে তা হলো, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুম মুনিরাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।এমনকি তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে। কারণ হলো তিনি প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে কটূক্তিমূলক একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। অথচ তিনি কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে তা ডিলিটও করেছিলেন। এমনকি ক্ষমা চেয়ে পুনরায় স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন। এই একই কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়েছে গতকাল বুধবার রাতে।

কী চলছে এসব? এটা কি কোনো ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ এর চিত্র হতে পারে? আমার সত্যিই জানা নাই। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটা মুক্ত চিন্তার, আলোচনার আবাস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। যার নিজস্ব আইন আছে। সিরাজুম মুনিরা কিংবা জাহিদুর রহমান যদি অপরাধ করেই থাকেন, মামলার বাদী যেই হোক না কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে, পেনাল কোডে কেন তার অপরাধের বিচার করা হলো না বা হচ্ছে না? উল্টো দুটো স্ট্যাটাসই স্ক্রিনশট দিয়ে স্ক্রল করেছেন সরকার দলীয়রা! তাহলে প্রসঙ্গত প্রশ্ন আসতেই পারে প্রশাসনের স্বাধীনতা কোথায়? শুধু কি গভীর রাতে গিয়ে তুলে নিয়ে আসা?

বাংলাদেশের জন্য দৈনন্দিন ভাত, মাছ খাবার মতো এটা একটা ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াতেই সিরাজুম মুনিরা এবং কাজী জাহিদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনায় আজ তাদের নিয়ে এতো এতো প্রতিবাদ হচ্ছে! তবে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেটাই বা কম কিসে? আজকাল হরহামেশাই এতো এতো লোককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে, কই প্রতিবাদ তো হচ্ছে না সেরকম? কত কত ব্লগারদের ব্লগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, প্রতিবাদ তো হচ্ছে না, হয়নি! ব্লগার অভিজিতকে হত্যা করা হলো প্রকাশ্যেই, কই বিচার তো হয়নি এখনও? কেবল মৃত্যু দিবসে একটু মানববন্ধন আর দু’একটা মিডিয়া কাভারেজ। একেই কি বলে প্রতিবাদ? তাহলে কি প্রতিবাদও অনেক বেশি শ্রেণিভিত্তিক, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দোসর?

এতোক্ষণ যা বললাম তা অবশ্য রাষ্ট্র ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নানান প্রপাগান্ডা চালিয়ে হেজেমনিক বৈধতা প্রায় দিয়েই ফেলেছেন। আমি বলতে চাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের মগজের কারফিউ জারি করে কীভাবে আমাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী করে তুলছে সেটি!

তার আগে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দুটো কথা, যা না বললেই নয়। আমার এক বন্ধু এডভোকেট প্রায়ই বলতেন, শোনো, “আইন যত তৈরি হবে আইনের ততো ফাঁকফোকর থাকবে আর আমজনতা ততই হেনস্থার শিকার হবে।” ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে এটা মনে হয় একটু বেশিই প্রযোজ্য। তবে ভিন্নতা হলো আমজনতা নয়, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিকের মগজের লকডাউন চলছে। যা অনেক বেশি ভয়ংকর আপনাকে নিঃশেষ করে দেবার জন্য।

৫৭ ধারা বাতিল হলেও ২০১৮ সালের সংশোধিত ১৭ থেকে ৩৮ ধারার বর্ণনায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও তার জন্য শাস্তির বর্ণনা দেয়া আছে। যেখানে একবার চোখ রাখলেই বোঝা যায় এর মাধ্যমে আপনার বাক স্বাধীনতা, মগজের স্বাধীনতায় কীভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, নতুন আইনের ২৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোড [ Act No. XLV of 1860) 499 এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তিনি অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন’।

এখানে এই “মানহানিকর” শব্দটি হলো তুরুপের তাস। আপনি যদি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের গঠনমূলক সমালোচনা করেন তাহলে তা হয়ে যায় মানহানিকর। আপনি চোরকে চোর, ডাকাতকে ডাকাত বললেই তা হয়ে যায় মানহানিকর, আপনি দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বললেই তা হয়ে যায় মানহানিকর! কী আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না! কখনো কি ভেবে দেখেছেন শুধু একটা আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র আপনার সাথে কি খেলায় মেতেছেন? আপনার বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন, আপনার মগজের স্বাধীনতায় বাদ সাধছেন! রাষ্ট্র কখন এমন খেলায় নিমগ্ন হয়! এটা বোধকরি আমার, আপনার কারোরই বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়!

আন্তনিও গ্রামসির “কারাগারের ডায়েরী” বইটির কথা খুব মনে পড়ছে। জেলে আটকিয়ে যে মগজের স্বাধীনতা আটকানো যায় না তা হয়তো রাষ্ট্র ভুলে গিয়েছে। এর অন্যতম উদাহরণ আন্তনিও গ্রামসির কারাগারের ডায়েরী বইটি। ঠিক যেমন ১৯২৮ সালে আন্তনিও গ্রামসিরও মগজের স্বাধীনতা হরণের জন্য প্রচলিত আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির সরকার তাকে ২০ বছর জেল দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কারাগারের বদ্ধ ঘরটাতেও নিজের কলম যুদ্ধ বন্ধ রাখেননি। কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে লিখেছিলেন ৩০টি খাতা আর তিন হাজারেরও বেশি পাতা, যা পরবর্তীতে বই আকারে বের হয় তার স্ত্রীর প্রচেষ্টায়। তখনকার আইন দমিয়ে রাখতে পারেনি গ্রামসির মগজের স্বাধীনতা। বোধকরি কোন আইনই মগজের স্বাধীনতা দমিয়ে রাখতে পারেনি কোনকালে। ১০০ বছর আগে কিংবা পরে যাই হোক না কেন প্রকাশ হবেই।

এক্ষেত্রে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নূর হোসেনকে পাগল আখ্যায়িত করেছিলেন জনৈক নেতা। কিন্তু এই আন্দোলনই ছিলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল হাতিয়ার। কই তখন কোন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিলো না! তাহলে কি এই আইন কেবল আপনার আমার কিংবা তাহার স্বার্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে বা হয়ে থাকে? খুব কি ভুল বলে ফেললাম নাকি!

কয়েকদিন আগে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলি: একটা সিটিজেন জার্নালিজম ভিত্তিক গ্রুপ, যার নাম Public Voice of Amtali. গ্রুপটি বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার সাধারণ জনগণের কথা বলার একটা প্লাটফর্ম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রুপটি দেশে-বিদেশে খুব ভাইব্রান্ট হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই গ্রপের এডমিন এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন উপজেলা প্রশাসন। যেখানে উল্লেখ করা হয় এই গ্রুপে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে করোনা সংকটের সময়ে। কিন্তু পুরো গ্রুপ ঘুরে আপনি দেখবেন “মানহানিকর”, “অবমাননাকর” কিছু পাওয়া যায় কিনা? এই মর্মে উপজেলায় মাইকিং করে গ্রুপ বন্ধও করা হয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক।

আমার পর্যবেক্ষণ হলো একজন মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে শুধু তারই বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা যায়, কিন্তু এই ধরনের সিটিজেন জার্নালিজম ভিত্তিক গ্রুপ বন্ধ করার মাধ্যমে হাজার হাজার সাধারণ লোকজনের কথা বলার স্বাধীনতা বন্ধ করা হয়েছিলো। কারণ এসব গ্রুপ, যেখানে সবাই লিখতে পারে নিজেদের অধিকারের কথা, সুখ আর দুঃখের কথা।
এগুলো হলো আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। কই প্রতিবাদ তো হতে দেখিনি সেরকম? বরং লিঁয়াজো করে গ্রুপটি সচল করেছে আবার। আমার বিশ্বাস যার ফলাফল স্বরুপ গ্রুপটি তার স্বকীয়তাও হারিয়েছে কিছুটা। হারিয়েছে সাধারণ জনগণ তাদের নিজস্বতা, প্রতিবাদের ভাষা, স্বাধীনতা। এগুলো একান্তই আমার মতামত বর্তমানে গ্রুপটির স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করে।

টুকটাক লেখালেখির অভ্যেস আছে আমার। প্রতিটা লেখার পরই আপনজনরা ফোন করেন তুই ঠিক আছিস তো? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন একটা আইন যা আপনার কথা বলার স্বাধীনতা কেবল হস্তক্ষেপ করেনি শুধু, আপনার মাঝে ভয়ও ঢুকিয়ে দিয়েছে। আপনি আপনার মুক্ত চিন্তার, মস্তিষ্কের, মগজের ক্রিয়েটিভিটিকে হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন। কিছুদিন আগে এক কার্টুনিস্ট যিনি কার্টুন এঁকে গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, তাকে গভীর রাতে গ্রেফতার করা হলো! নানান হেনস্থা করা হলো। আপনার কী মনে হয় তার যে উদ্দামতা, ক্রিয়েটিভিটি তাতে কি কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েনি এই স্ট্রেস এর? আমি তো বলবো, অবশ্যই পড়েছিলো। এরকম হাজারও উদাহরণ আছে। শুধুমাত্র সচেতন নাগরিক নয়, সুশীল সমাজ নয়, এমনকি সাংবাদিকরাও এই আইনের ফলে স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারছে না। যখন একজন মানুষ তার লেখায় যা দেখে, যা সত্য, যা বিশ্বাস করে তা ফুটিয়ে তুলতে না পারে, তার কষ্ট কী করে বুঝবে রাষ্ট্র?

কল্পনা করুন একটা কিছু ভাবার পর, লেখার পর আপনার যদি ঘুমাতে যাবার সময় মনে হয়, অনেক রাতে কেউ আপনার দরজায় টোকা দিচ্ছে আর আপনি দরজা খুলে দেখলেন কালো বা খাকি পোশাক পরিহিত লোক আপনাকে তুলে নিতে এসেছে। ভাবুন তো আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? তাহলে কি এই আইন কেবলই আপনার মগজের কারফিউ জারি করেছে, স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করেছে নাকি আপনাকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে তুলছে? আমার তো মনে হয় সবই করছে এক সাথে।

পরিশেষে শুধুই বলবো ইতিহাস পর্যালোচনা করুন মাননীয় রাষ্ট্র, আইন দিয়ে কোনকালেই কিছু দীর্ঘমেয়াদী দমন করা যায়নি, যায় না, যেতে পারে না।
নাগরিক হিসেবে সকলেরই বাক স্বাধীনতার অধিকার আছে, গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার আছে যা একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যতম হাতিয়ার।

তাই বলছি প্লিজ ভাবুন! নাগরিকের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিন। আমি বিশ্বাস করি ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর গঠনমূলক সমালোচনা নেবার মানসিক শক্তি আছে।আর আপনি এতে বিশ্বাসও করেন। তাই বলছি নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঠিক প্রয়োগ করুন। আখেরে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’ গড়তে তা আপনাকেই সহযোগিতা করবে।।

লেখক:
নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক।

শেয়ার করুন: