সৈয়দা নূর-ই-রায়হান:
বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর মানসিক স্বাস্থ্য ও এর গুরুত্ব নতুন করে স্থান পেয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে মেইনস্ট্রিম আলোচনার ক্ষেত্রগুলোতেও। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের জনজীবনে শুধু অবহেলিত নয়, বরং চরমভাবে স্টিগমাটাইজড। তবে আশার কথা হচ্ছে, আজকাল এই বিষয়ে সচেতনতার বৃদ্ধি বেশ চোখে পড়ার মতোই। অন্তত আলোচনার একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ এই বিষয়ে কোন রকম পেশাগত দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার সূত্র ধরে একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ডিপ্রেশনের আলাপটা করতে এসেছি। ডিপ্রেশনে ভুগছেন, এমন ব্যক্তির কেয়ারগিভার যারা, তাদের নিয়ে আজ বলতে চাই। ডিপ্রেসড ব্যক্তি যদি প্রফেশনাল হেল্প না নেন, তাহলে এই কেয়ার গিভার হোন সাধারণত তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, সঙ্গী, ভাই-বোন, আত্মীয় অথবা অসংজ্ঞায়িত সম্পর্কের কেউ। ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা ব্যক্তি নিজেই হয়তো তার আশপাশের অসংখ্য চেনা পরিচিত ও আপনজনদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নেন বিষন্নতার কথা বলতে। কখনও ডিপ্রেসড ব্যক্তির কাছের মানুষেরা নিজে যেচে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন।

কেয়ারগিভার যে-ই হোন না কেন, তাদের উপর যে মানসিক চাপটা যায়, সেটা খুব সামান্য কিছু না। ভালোবেসেই হোক, দায়িত্ববোধ থেকেই হোক, কাছের মানুষের ডিপ্রেশন মোকাবেলায় সহায়তা করতে এগিয়ে যেতে হলেও আপনাকে যথেষ্ট সহমর্মী হতে হবে। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাবতে হবে, অনুভব করতে হবে। এই ভার খুব হালকা না। আমি একজনকে চিনি, যে রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতো না, কারণ তখন সে আরেকজনকে অনবরত মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, এবং সেইসব দুঃসহ সময়ের চাপের কারণে সে প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে যেত। এটা হয় সমানুভূতি বা এমপ্যাথির কারণে। ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা ব্যক্তিকে প্রফেশনাল হেল্প নিতে বলাও কেয়ারগিভারের জন্য খুব সহজ বিষয় হয় না। কারণ তখন ডিপ্রেসড ব্যক্তি ধরে নিতে পারেন, the one person they are confiding in does not really care about them enough to take responsibilities.
এমনকি ডিপ্রেসড ব্যক্তির যে কোনো কাজ বা সিদ্ধান্তের দায়ভার অনেক সময় কেয়ারগিভার নিজ দায়িত্বে নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। আমি নিজে লম্বা সময় ডিপ্রেশনে ভুগেছি। আজ সেই জায়গা থেকে অনেকটা উত্তরণ করে এতোটুকু মনে হয়েছে, সেই ভয়াবহ সময়গুলোতে পৃথিবীর অন্য কারও কোন দুঃখ-কষ্ট, অসুবিধা, বিপদ, কিছুই তখন আমাকে স্পর্শ করেনি। নিজেকে টিকিয়ে রাখাই ছিলো আমার কাছে সবচাইতে জরুরি। কখনও কখনও বুঝতে পারি, আমাকে যারা ভালোবেসেছে, বা বাসে, তাদের জন্য সেই সময়টা কতোটা চ্যালেঞ্জিং আর কঠিন ছিলো। কিছু মানুষ পাহাড়ের মতো রক্ষাব্যুহ তৈরি করেছিলো, কেউ দিয়েছিলো বট গাছের মতো আশ্রয়, আর কেউ ধরেছিলো হাত। তাদের জন্য এই রোলগুলো প্লে করা সহজ ছিলো না। আপনি যদি ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন, আপনার কেয়ার গিভারদের জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের জন্য খুব আনন্দের কাজ না এটা। And most importantly, they are not well-equipped to do this for you.
হ্যাঁ, এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা প্রফেশনালি কাউন্সেলিং করেন বা থেরাপি দেন, তাদের নিজস্ব পদ্ধতি আছে নিজেকে ডিব্রিফ করার। আপনার কাছের মানুষটির সেই সুযোগ নাও থাকতে পারে। বরং, আপনার ডিপ্রেশন তাকেও সেই একই গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে। সেই সাথে, আপনার ভালো চাইতে গিয়ে কেয়ার গিভার যে নিজের অজান্তেই কোন ক্ষতিকর চিন্তা আপনার মাঝে বপন করে দিবে না, তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। কিংবা তার নন-প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ আপনার রিকভারি পিরিয়ডকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। এই সবই নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে, কারণ আপনার কেয়ার গিভার একজন নন-প্রফেশনাল। কিন্তু একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে সাহায্য নিলে এই দুর্যোগের সম্ভাবনা অতি অবশ্যই অনেক কম থাকে। তাদের পেশাগত দক্ষতা এখানে বিবেচ্য।
ডিপ্রেশন একটা রোগ। সামান্য সর্দি জ্বরেও আমরা এক্সপার্ট ওপিনিয়ন চাই। এই রোগে কেন নয়?
একটা প্যানডেমিকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা পুরো মানবজাতি। জীবাণুর মহামারী শেষ হলে শুরু হবে মানসিক রোগের মহামারী। তার ছায়া টুকটাক এদিক ওদিক চোখে পড়তে শুরু করেছে। যারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তাদের পাশাপাশি আমরা যেন কেয়ার গিভারদেরও মনে রাখি। কার উপর কতোখানি চাপ দেওয়াটা মানবিক, সেটা যেন একটু ভেবে দেখি। বিশেষ করে, প্রফেশনাল হেল্প নেওয়ার সুযোগ থাকলে আমরা যেন শুধুমাত্র আলসেমি বা স্টিগমার কারণে সেখানে যাওয়ার পরিবর্তে কাছের মানুষদের খুঁজে না নেই, এতোটুকু বোধ সবার মধ্যেই থাকা কাম্য। আজকাল অনেক সংস্থাই প্রো-বোনো মানসিক সহায়তা প্রদান করছে। একটু খোঁজ করলেই তা পেয়ে যাওয়ার কথা।
চলুন, শরীরের মতো, নিজের মনের যত্নেও আরেকটু যত্নবান হই।