নতুন বাবা’র পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন

রোকসানা বিন্তী:

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন শুধু নতুন মায়েদেরই হয় না, নতুন বাবাদেরও হয়! শুনতে একটু অবাক লাগতে পারে! যেখানে মায়েদের পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনই আমলে আনা হয় না, এককথায় বলে দেয়া হয় “ঢং”, সেখানে আবার বাবার ডিপ্রেশন? কী জানি বাপু, আমাদের আমলে তো এইসব ছিল না, কোনোদিন শুনিও নি! হ্যাঁ, আপনি কোনোদিন না শুনে থাকতে পারেন, কিন্তু পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন আপনাদের আমল, আমাদের আমল, মুঘল আমল, আলেক্সান্ডারের আমল, এরকম সব আমলেই ছিল! এবং তা বাবা-মা দুইজনেরই ছিলো! ইদানিং বাচ্চা জন্ম নেবার পর মায়েদের ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা হলেও বাবাদেরও যে এমন ডিপ্রেশন হতে পারে, তা একেবারেই আড়ালে রয়ে গিয়েছে।

একটি শিশু জন্ম নেবার প্রক্রিয়ায় মায়ের শত শত হরমোন এদিক-সেদিক হয়, যার ফলে মায়ের আবেগের জগতটা উলটপালট হয়ে যায়। তার সাথে বাচ্চার সীমাহীন দায়িত্ব, শারীরিক অসুবিধা, রাত্রি জাগরণ সব মিলিয়ে মা একটা হতাশার মধ্যে পড়ে যান। বাবাকে এতোকিছু হয়তো করতে হয় না, কিন্তু বাবা হওয়ার মাধ্যমে তারও কিছুটা হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয় যার মাধ্যমে তার সাথে বাচ্চার একটি আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠে, বাচ্চার সাথে তার মায়া মমতার বন্ধন তৈরি হয়, সেইসাথে তিনি শিকার হোন পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনেরও। বিশেষ করে প্রথমবার বাবা হওয়ার ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। হরমোনাল ইমব্যালেন্সের সাথে বাবার আগের কোন ডিপ্রেশনের ইতিহাস, বাচ্চার মায়ের ডিপ্রেসড অবস্থা এবং আগের মতো তার মনোযোগ না পাওয়া, দায়িত্ব বৃদ্ধি, পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক টানাপোড়েন, অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণসহ আরও অনেক কারণে তার পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হতে পারে, যা বাচ্চা জন্মের একবছর বা তারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে। এর ফলে বাবা-মা, বাচ্চা, পরিবার সবকিছুর উপরে একটি খারাপ প্রভাব পরে এবং ভুল বোঝাবুঝির চূড়ান্ত পর্যায় থেকে সংসার ভেঙে যাবারও সম্ভাবনা থেকে যায়।

বাবা আর মায়ের পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের মাঝে কিছুটা পার্থক্য থাকে। মায়ের ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো খুব প্রকট বলে তা সহজেই ধরতে পারা যায় ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো প্রায় স্বাভাবিক থাকে বলে সেই ডিপ্রেশন সহজে বোঝা যায় না। যেমন- দিনের বেশিরভাগ সময়ে বাবার নিজেকে হতাশ এবং অসহায় লাগবে। চারদিক খালি খালি লাগবে যা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আগে যেসব কাজ করতে তার ভালো লাগতো, এখন আর সেগুলো ভালো লাগবে না। খাবার গ্রহণের পরিমাণ এবং ঘুম হয় খুবই বেড়ে যাবে বা একেবারেই কমে যাবে। কাজেকর্মে অনীহা বা অতি উৎসাহ দুটোই হতে পারে। কোন পরিশ্রম না করেই ভীষণ ক্লান্ত লাগবে। ধূমপানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। উপেক্ষা করার মতো সামান্য শারীরিক সমস্যা নিয়ে খুব বেশি অভিযোগ করবে। পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীদের সাথে মতানৈক্য, বাক বিতণ্ডা ও ঝগড়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে। সামান্য কারণে বা বিনা কারণে কান্নাকাটি করবে। একদম জটিল পর্যায়ে আত্মহত্যার কথা ভাববে।

বাবা যদি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে তাহলে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বাচ্চার। বাচ্চা যদি তার বাবাকে মনমরা বা হতাশাগ্রস্ত দেখে বড় হতে থাকে তাহলে বাচ্চার আচরণগত বিকাশ ব্যাহত হয়। শিশুটি তখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ করে। তার সামাজিকতা শিখতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। এছাড়া সে সময় বাচ্চাটির মাও ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে, ফলে পারিবারিক অশান্তি বেড়ে পাহাড়সম হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে তা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায়। কাছের মানুষ ও সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশন চলতে থাকলে বড় ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে এবং দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

বাবা ও মায়ের পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ আলাদা হলেও তা থেকে বাঁচার উপায় অভিন্ন। এটি একটি মানসিক সমস্যা বলে প্রায় সময়ই উপেক্ষিত থাকে। কিন্তু ডিপ্রেশন উপেক্ষা করার মতো কোন বিষয় তো নয়ই, বরং অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এর সমাধান করতে পারলে সবচেয়ে উত্তম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিজে থেকেই সেরে যায়। যদি না সারে তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা এন্টি ডিপ্রেশন ড্রাগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, নিয়মমাফিক ঘুম এ ধরনের হতাশাকে দূরে রাখে। ধূমপান, মদ্যপান বা যেকোনো নেশাজাতীয় দ্রব্যকে না বলতে হবে। পরিবার ও সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি যে সাহায্য করতে পারবে তিনি হলেন বাবা নিজেই। তিনি নিজে যদি নিজের আবেগকে বুঝতে পারেন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেন তাহলে খুব সহজেই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে পারেন। যার ফলে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবার গড়ে উঠতে পারে এবং বাচ্চাটি বেড়ে উঠতে পারে অনাবিল আনন্দে!

লেখক পরিচিতি:

উপ পরিচালক,বাংলাদেশ ব্যাংক

তথ্যসূত্র: গুগল

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.