ফারহানা মিলি:
আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। পূর্ববঙ্গের এক মহকুমা শহরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বড় দুবোন কলেজে পা দিয়েছেন কেবল। সময়টা ছিল অন্যরকম। তাই বড় দুবোনের মধ্যে মাঝে মধ্যে কোনো একটা বিষয়ে ফিসফাস হলেও মেয়েটি বুঝতে পারত না কী আড়াল করা হচ্ছে তার কাছে।
শহরের ছোট্ট একতলা বাসার রান্নাঘরের পাশের স্যাঁতস্যাতে জায়গাটুকুতে দড়ি টানানো। সেখানে দুবোন টুকরো কাপড় নেড়ে রাখতেন। কাপড়গুলো সবার নজর থেকে আড়াল করার জন্য তাদের সে কী চেষ্টা! এগুলো বাবা বা ভাই দেখে ফেললে বড়ই নাকি লজ্জার বিষয়। কিশোরীটি তখনও বুঝতে পারে না কিছু। শুধু শোনে বোনেদের সঙ্গে এসব নিয়ে মায়ের ফিসফাস, চাপা ধমক।
ওদিকে ক্লাসের বেশিরভাগ বান্ধবীও মেয়েটিকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলত, ‘ও ছোট মানুষ, বুঝবে না।’ আকারে ছোটখাট বলেই কি মেয়েটিকে তখনও ‘ছোট’ বলেই মনে করত বান্ধবীরা? নাকি ছিল অন্য কোনো কারণ?
সে বছরের হেমন্তের এক সকালে হঠাৎ পিঠে তীব্র ব্যথা শুরু হয় ওর। মা তখন ব্যস্ত রুটি তৈরি নিয়ে। সবার সকালের খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। বাবাকে তিনি বললেন মেয়ের পিঠে তেল মালিশ করে দিতে। স্নেহশীল পিতা কন্যাকে বিছানায় উপুড় করিয়ে শুইয়ে আলতো করে তার ফ্রকটুকু তুলে পিঠে গরম তেল মালিশ করে দিলেন্। তখনও বাবার কাছে ‘ছোট্টটি’ সেই মেয়েটি এমন ব্যথা-বেদনা হলে বাবার কাছে লুকোত না।
ব্যথার জন্য ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটি বুঝতে পারেনি শরীরের পরিবর্তনের বিষয়টি। দুপুরে গোসলের সময় হাফপ্যান্ট বদলে বাথরুমে রেখে এসেছিল। মা-ই তখনও কাপড় ধুয়ে দেন। প্যান্টে লেগে থাকা রক্তের দেখা পেয়ে চমকে গেলেন তিনি। বড় দুটো মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত— তিন নম্বরটিকে ফ্রক-হাফপ্যান্ট পরিয়ে রাখেন। ভাবছিলেন, ও বুঝি ছোটই থাকবে অনেকদিন।
যাহোক, বিকেল না গড়াতেই দুবোন ডেকে নিলেন মেয়েটিকে। ছোট ওয়াশরুমটির ভেতরে তাকে বললেন, ‘এখন তোমার শরীর বদলে গেছে। সারাজীবন চলবে এটা। সব মেয়েদেরই হয়।’
মেয়েটির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ‘সারাজীবন?’
‘হ্যাঁ, সারাজীবনই তো। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তো চলবেই। আর এটা না হলে কোনো মেয়ের তো বাচ্চা হবে না’— বোনেদের চাঁছাছোলা উত্তর।
তারপর ওরা শিখিয়ে দিলেন কীভাবে এ সময় দড়ি দিয়ে কাপড় বেঁধে শরীরের নিম্নাঙ্গ থেকে ঝরে পড়া রক্ত ঠেকাতে হবে। তারপর সেসব কাপড় গোপনে খরখরে কাপড় ধোয়ার সাবান দিয়ে ধুয়ে সবার নজরের আড়ালে শুকাতে হবে। প্রতি মাসেই ছ-সাত দিন এভাবে চলতে হবে। এভাবেই স্কুলে যাওয়া— এভাবেই সব কিছু।
তবে হ্যাঁ, রক্ত যাতে জামা-কাপড়ে লেগে না যায়। কারণ সেটা কেউ দেখে ফেললে লজ্জা। আর কাউকে বলাও যাবে না বিষয়টা। প্রতি মাসেই ‘মিন্স’ হবার কথাটি কেবল মা-বোন-খালাদের বলা যাবে। আর বান্ধবীদেরও বলার দরকার নেই। কারণ সব মেয়েরাই বিষয়টা লুকায়!
সেই থেকে শুরু। জীবনের দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে মাসের কয়েকটি দিন নিজের নিম্নাঙ্গ থেকে ঝরে পড়া রক্তের কথা লুকোতে লুকোতে সময় পার। তারপর আবার ব্যবহৃত কাপড় নিয়ে লুকোচুরি— ভাই-বাবার নজরে পড়ে গেলে বড়দের বকা শোনা। নানার বাড়িতেও বেড়াতে গিয়ে সেই বিশেষ দিনগুলো পড়ে গেলে কত যে সমস্যা! স্বজনরা অনেক সময বিরক্ত— ‘মেয়ে ত্যানাগুলো সামনে নেড়েছে, ওর মামা দেখে ফেলেছে, বলেছিলাম, লুকিয়ে ওপাশে নাড়তে।’
তারপর অশুচি ব্যাপারটা তো রয়েছেই। ‘মিন্স’ একদম অশুচি একটা বিষয়। মেয়েরা এ সময় পুরা অপবিত্র হয়ে যায়। এ সময় জায়নামাজ, কোরান শরীফ হাতে ধরা যাবে না। নিজেকে একটু লকিয়ে-ছাপিয়ে রাখতে হবে।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার বলে অবশ্য খানিকটা রক্ষা। কথা বলা যেত সেখানে। বইপড়ুয়া মেয়েটি তাই খুব তর্ক করত এসব নিয়ে। যদিও নারীবাদী কোনো বই বা কিছু সে তখনও হাতে পায়নি, চোখেও দেখেনি। কিন্তু মনটা ওর ছিল এমনিতেই বিদ্রোহী।
‘কেন, কী সমস্যা? বাচ্চা হবার জন্য যখন এটা দরকার তাহলে এত লুকানোর কী আছে? আর কাপড়গুলো লুকিয়ে কেন শুকাতে হবে? এসব আমার বিরক্ত লাগে।’
মুরুব্বি নারী স্বজনদের মনে হত, এসব তো ভিনগ্রহের কথাবার্তা। তাতে কেবল তিরস্কার জুটত ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটির কপালে।
সেই আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মেয়েদের কেউ কি মাসিক ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করত? জানে না কিশোরীটি। তবে দশকের শেষার্ধ্বে খুব সম্ভব তাদের শহরের ফার্মেসিগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্যাড পাওয়া যাচ্ছিল। নামধাম মনে নেই, কিন্তু ওরা তিন বোনও প্যাড ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন থেকে মিলল কাপড় ধোয়া আর শুকানো থেকে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।
এর মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল মেয়েটি। রোকেয়া হলে সিট পেল সে। ১৯৮৯ সালের কথা। হঠাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ হল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের এক নারী কর্মকর্তার। তাদের কোম্পানি থেকে কিছু প্রডাক্ট বের হচ্ছে, সেগুলোর বিপণন শুরুর আগে তারা বাজার যাচাই করতে চান। কেউ চাইলে পণ্যগুলো হলের মেয়েদের কাছে বিক্রি করতে পারে। তাতে বিক্রেতা ছাত্রীদের কিছু আয় হল, আর কোম্পানিও পণ্যগুলোর সম্ভাব্য বাজার বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন।
পণ্যগুলোর মধ্যে ছিল জুঁই নারিকেল তেল আর সেনোরা স্যানিটারি প্যাড। মেয়েটি তখন তরুণী। এক সহপাঠীকে নিয়ে সে পণ্যগুলো বিক্রি করতে শুরু করল। ছোট্ট করে একটা বিজ্ঞাপনও দিল। কাগজে হাতে লিখে হলের বিভিন্ন জায়গায় সাঁটিয়ে দিল সেটি। শিরোনাম ছিল এরকম— ‘আর দোকানে নয়’।
দলে দলে মেয়েরা মূলত ভিড় করল স্যানিটারি প্যাডের জন্য। কয়েক মাস চলল এই পরীক্ষামূলক বিক্রি। প্যাড আনলেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির কাছে রিপোর্ট পজিটিভ মনে হচ্ছে। এরপর ওরা বাণিজ্যিক বিপণনে যাবেন। ফলে আপাতত এ উদ্যোগে ইতি।
আশির কিশোরীটি নব্বইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণী। ততদিনে তার সচেতন মন অনেক খোলা জানালা পেয়ে গেছে। প্রচুর পড়তে পারছে। মুভি দেখছে বিভিন্ন দেশের ঢাকাস্থ কালচারাল সেন্টারগুলোতে গিয়ে। সংগঠন করছে। মুক্তির পথ সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে তখন। বন্ধুদের সঙ্গে পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা করা যাবে না, এমনতর সংস্কার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে বিপরীতটা করছে।
মেয়েরা নিজেরা আড়ালে কোনোরকেম ‘মিন্স’ শব্দটি উচ্চারণ করলে অশ্লীল মনে হত কিশোরীটির কাছে। এখন এই তরুণী পুরুষ সহপাঠী বা সংগঠনের সহযোদ্ধাদের কাছে, এবং আরও পরে অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের কাছে ‘পিরিয়ড’ শব্দটি বলেছে অবলীলায়— তার কাছে সেটা একেবারেই অশ্লীল মনে হয়নি।
তারপরও সমাজ থেকে সংস্কার কি দূর হয়েছিল? হয়নি। হলে-হোস্টেলে জীবন কাটাতে গিয়ে তরুণী দেখেছে, পিরিয়ড নিয়ে মেয়েদের নিজেদেরই কত-যে লজ্জা, বিভ্রান্তি। যেন ঋতুমতী নারী একজন পাপিষ্ঠা!
আরও অনেক পরে, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সেই তরুণী পরিপূর্ণ নারী। তার কন্যার বয়স এখন নয়। তিনি ভাবলেন, ‘আজকাল মেয়েদের পিরিয়ড হচ্ছে তাড়াতাড়ি, তাই মেয়েকে এখনই বিষয়টা নিয়ে বলতে হবে।’
কন্যার সঙ্গে মায়ের কথোপকথনের পর মেয়ে খুব স্মার্টলি বলল, ‘ওহ আচ্ছা, বুঝলাম তাহলে। এটাকে ‘পিরিয়ড’ বলব। আর হয়ে গেলে এভাবে প্যাড পরতে হবে। তারপর অনেক বয়স পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে।’
মেয়ের যখন ১১ বছর তিন মাস বয়স, তখনই এক সকালে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল। ‘মা, আমার পিরিয়ড হয়েছে।’
মা দেখলেন, রক্তে ভরে গেছে বিছানার চাদর আর মেয়ের পরনের হাফপ্যান্ট-জামা। তারপর হালকা গরম পানিতে মেয়ের গা মুছিয়ে দিয়ে পিরিয়ডের প্রস্তুতি নিতে শিখিয়ে দিলেন মা।
গদ্যটা এতটুকুই। অতি সামান্য। অভিজ্ঞতা হিসেবে খানিকটা মূল্যবান হতে পারে হয়তো। বাংলাদেশে আমাদের আগের প্রজন্ম থেকে শুরু করে পরের দুটি প্রজন্মের নারীরাও মাসিক ঋতুস্রাব নিয়ে ভয়ানক সব সংস্কার আর এবিউজের মধ্যে বড় হয়েছেন। তাদেরকে সবার কাছে লুকোতে হয়েছে বিষয়টি। একসময় কাপড় বা ‘ত্যানা’ ব্যবহার করে সেগুলো আড়ালে-আবডালে শুকোতে হয়েছে। রোদের দেখা পায়নি সেসব কাপড়। তাতে কত জনের শরীরে কীরকম রোগ-জীবাণু বাসা বেঁধেছিল কে জানে।
তারপর আবার অফিসে পিরিয়ডের কথা লুকোতে হবে। ব্যথায় কাতর হলেও বলা যাবে না। মুখ বুজে কাজও করে যেতে হবে। পরিবারেও একই অবস্থা। ফলে এ সময় নিজের নানা সমস্যার কথা আপনজনদের কাছেও লুকিয়ে নারীরা পরিবারে শ্রম দিয়ে গেছেন।
নারীর মাসিক ঋতুস্রাব যে একটি বিশেষ ও স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থা—এটি না লুকিয়ে পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে নারীরা বিষয়টি জানাবেন এবং তারপর সেভাবে যত্ন পাবেন— এমন অবস্থা এখনও এদেশে আসেনি। অথচ নারীর সাধারণ স্বাস্থ্য এবং প্রজনন-স্বাস্থ্য দুটোর জন্যই জরুরি ছিল বিষয়টি।
বছর দুয়েক আগে মাসিক ঋতুস্রাব নিয়ে একটি কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে এসেছেন বেশ কজন তরুণ সাংবাদিক– বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করেন তারা। তিন দিনের কর্মশালায় বদলে গেল তরুণদের এটিচ্যুড। সবাই এক বাক্যে বললেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, নারীদের এই বিশেষ শারীরিক অবস্থা নিয়ে কর্মশালায় অফিস কেন পুরুষদের পাঠাচ্ছে? এখন বুঝতে পারছি, এ বিষয়ে আমাদেরই জানা বেশি দরকার। নইলে আমরা নিজের মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে কীভাবে বুঝব? তাদের এ সময়কার বিশেষ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা যে জরুরি, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও যে বিষয়টির সম্পর্ক থাকে, সেসব জানা সব পুরুষের জন্যই দরকার।’
খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের মহাকাব্য ‘মহাভারত’-এ বর্ণিত আছে, পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী ও ইন্দ্রপ্রস্থের সম্রাজ্ঞী দ্রৌপদীকে হস্তিনাপুরের রাজসভায় আয়োজিত এক প্রবঞ্চনার পাশা খেলায় জিতে নিয়েছিলেন যুবরাজ দুর্যোধন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর আপন জেঠতুতো ভাই তিনি। এরপর ছোটভাই দুঃশাসনকে বললেন দ্রৌপদীকে রাজসভায় হাজির করতে। দ্রৌপদী জানিয়েছিলেন, তিনি রজস্বলা, তাই তিন দিন নিজের কক্ষের বাইরে পা রাখবেন না।
তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে রাজসভায় নিয়ে আসা হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল তাঁর বস্ত্রহরণের।
ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, আজকের যুগেও কিছু অপোগণ্ড তরুণ সেনোরা স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন নিয়ে তোলপাড় তোলে। তাদের বক্তব্য, ঋতুস্রাবের বিষয়টি এখনও মেয়েদের লুকোতে হবে। কারণ এ যে বড় লজ্জার। এদের কাছে ঋতুমতী বা রজস্বলা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত। ওরা জানে না, নারীদের জন্য মাসিক-সংক্রান্ত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরি।
ওরা প্রত্যেকেই আসলে একেকটি দুঃশাসন যারা রজস্বলা দ্রৌপদীদের শরীর ও মনের মর্যাদা ও যত্নের কথা বোঝে না। এদের পক্ষেই সম্ভব এমনসব অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দেওয়া।